বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আস সালামু ‘আলাইকুম

[লেখাটি মূলত বিশ্বাসী মুসলিম ভাইবোনদের জন্য লেখা]

আজকাল পৃথিবী জুড়ে একটা প্রেমময় বাণী প্রায়ই উচ্চারিত হয়ে থাকে – সেটা হচ্ছে: সকল ধর্মই মানুষকে এক অভিন্ন গন্তব্যের দিকে পরিচালিত করে অর্থাৎ – এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা যিনি – তাঁর দিকেই মানবকুলকে নিয়ে যেতে চায় সকল ধর্ম” ৷ এধরনের বক্তব্যের নিহিতার্থ হচেছ: সব ধর্মের সারকথা একই ৷ আমি যখনই কোন বিধর্মীর সাথে ধর্ম নিয়ে আলাপ করতে চেয়েছি, তখনই দেখেছি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করেই হোক, অথবা, peaceful coexistence-এর জন্যই হোক, তারা আলোচনার পরিবেশকে হালকা করতে, সব সময় এ ধরনের একটা কথা বলতে চেয়েছে যে, আসলে সকল ধর্মের মর্মকথা একই – পার্থক্য শুধু অভিব্যক্তিতে বা বাহ্যিক প্রকাশে বা rituals-এ ৷” অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, উচ্চশিক্ষিত এক শ্রেণীর মুসলিমও, জেনে হোক বা না জেনে হোক, এ ধরনের ফাঁদে পা দিয়ে থাকেন – বিশেষত সেপ্টেম্বর ১১-র পরে, কাফির-স্বর্গ থেকে বহিষ্কৃত হবার ভয়ে, কাফিরের সামরিক শক্তির ভয়ে, হালুয়া রুটি থেকে বঞ্চিত হবার ভয়ে, অথবা ইসলামের যে ‘স্বাতন্ত্র্য’ আমাদের কাছে নিজের অস্তিত্বের চেয়েও সত্যি হবার কথা, সেটাকে “শান্তির খাতিরে” বুঝেও না বোঝার ভান করতে চেয়ে – অনেকেই এধরনের “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই” ধাঁচের মর্মবাণী আওড়েছেন ৷ অথচ মুসলিম মাত্রেরই জানার কথা যে সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই” একটা কুফরী statement ।

এভাবে ভাবতে গেলে, অর্থাৎ সব ধর্মই (বৌদ্ধ ধর্মের ব্যতিক্রম ছাড়া) কোন না কোন চূড়ান্ত উপাস্য সত্তা বা আল্লাহর কথাই বলে – এটাই যদি একটা মূল ও কেন্দ্রীয় বিবেচ্য বিষয় হয়, তবে তো সত্যিই কিছু একটা ধর্ম পালন করলেই হয়, শুধু শুধু এত কষ্ট করা কেন – অথবা কখনো গরু, কখনো নদী, কখনো লিঙ্গ – একটা কিছুর পূজা করলেই তো হয়। কারণ সব কিছুর মাধ্যমেই আপনার বন্দনা শেষ পর্যন্ত ঐ চেইনের শেষে চূড়ান্ত “মহা-প্রভুর” বা “পরমাত্মার” কাছে গিয়ে শেষ হবে ৷ কিন্তু আসলেই কি তাই? কেবল আল্লাহ বা একজন চূড়ান্ত “মহা প্রভুর” ধারণাই যদি যথেষ্ট হত, তবে তো মুহাম্মদ (সা.)-এঁর মিশনের কোন প্রয়োজনই ছিল না – কারণ মক্কার পৌত্তলিকরা সবাই আল্লাহ মানতো – আবু জাহেল, আবু লাহাব সবাই আল্লাহয় বিশ্বাস করতো – কথায় কথায় আল্লাহকে নিয়ে শপথ করতো ৷ কিন্তু তবু আমরা তাদের কাফির ও মুশরিক বলে থাকি এবং কাফির ও মুশরিকের সাথে কিছুতেই মুসলিমদের প্রেম-প্রীতি, সহ-অবস্থান, সামাজিকতা বা নির্বিচার মেলামেশা যে সম্ভব নয়, সে কথা পবিত্র কুর’আনের বহু আয়াতে যেমন সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত রয়েছে, তেমনি রাসূল (সা.)-এঁর বহু হাদীসে মুসলিমদের সাবধান করে দেওয়া হয়েছে: সাধারণভাবে সকল কাফিরের ব্যাপারে – আর বিশেষভাবে আহলে কিতাবভুক্ত কাফিরদের ব্যপারে ৷

প্রেম-প্রীতি বা শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের জন্য বিধর্মীরা যখন “সকল পন্থা যেথায় মেশে” ধরনের প্রেমের বাণী ছড়ায়, তখন একটা ব্যাপার মনে রাখতে হবে যে, হয় ঐ বিধর্মী তার নিজের ধর্মে বিশ্বাস হারিয়েছে; সুতরাং ঐ ধরনের কোন বক্তব্যকে আসলে সে যে সত্য মনে করে উচ্চারণ করছে তা নয় – বরং জাগতিক সুবিধার জন্য কৌশলগত কারণে উচচারণ করছে মাত্র – না হয় – সে নিজ ধর্মের বক্তব্য গোপন করে বা চেপে গিয়ে, উপস্থিত সমস্যা বা সংঘাত এড়াতে আন্তধর্ম প্রেমের বাণী ছড়াচ্ছে ৷ মাননীয় পাঠক, এটা সত্যি যে, যুগে যুগে নবী-পয়গম্বরগণ যে সব বাণী নিয়ে এসেছিলেন, সেসবের মৌলিক কথা একই ছিল – অর্থাৎ “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌” বা “আল্লাহ্‌ ছাড়া কোন ইলাহ্ (উপাস্য) নেই”৷ কিন্তু আজ পূর্ববর্তী নবীগণের ধর্মসমূহ, যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপে পৃথিবীতে টিকে আছে এবং তার বাইরে অন্য যেসব ধর্ম রয়েছে, সেগুলোর নিরিখে আপনি কি এমন কোন ধর্মের কথা জানেন, যা স্বীকার করে যে, তার মতবাদে অনেক দোষ-ত্রুটি রয়েছে? অথবা, আপনি কি এমন কোন ধর্মের কথা জানেন, যা স্বীকার করে যে, অন্য কোন ধর্মের অমুক অমুক দৃষ্টিভঙ্গী উক্ত ধর্মের চেয়ে শ্রেয়? না, মোটেই নয়! ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনুধাবন করলেও, কোন ধর্মের মুখপাত্রই কখনোই সেই ধর্মপ্রচার করতে গিয়ে এ কথা বলবেন না যে, আমার ধর্মের অমুক অমুক ব্যাপার আসলে মানবিক যুক্তির বা বুদ্ধির জন্য গ্রহণ করা কষ্টকর, সুতরাং এর চেয়ে বরং আপনারা অপর ঐ ধর্মের অনুসারী হতে পারেন ৷ না, আমার তো মনে হয় কখনোই তা হবার নয়! বরং ইসলাম বা পূর্ববর্তী উচ্চতর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ইতর ধর্মসমূহ – সবাই তাদের অনুসারীদের নিঃশর্ত আনুগত্য দাবী করে ৷ তবে হ্যাঁ, ব্যক্তিগত পর্যায়ে যখন কেউ নিজ ধর্মের গাল-গল্পে আর বিশ্বাস ধরে রাখতে পারেন না – এবং, যখন অন্য কোন ধর্মের ভিতর যুক্তি ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপাদান অধিক বলে তার মনে হতে থাকে – তখন তিনি হয়তো স্বধর্ম ত্যাগ করে ঐ নতুন ধর্মে নিজেকে দীক্ষিত করেন ৷ যেমনটা, উদাহরণ স্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস নিবাসী এক কালের খৃস্টান ধর্মযাজক, শেখ ইউসুফ এস্টেসের বেলায় ঘটেছে ৷ মধ্যপ্রাচ্য নিবাসী জনৈক মুসলিমকে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করতে গিয়ে – সাধারণ ঐ মুসলিমের যুক্তির কাছে লজ্জা পেয়ে তিনি নিজেই তার ধর্মযাজক পিতাসহ সপরিবারে মুসলিম হয়ে যান (বিস্তারিতের জন্য দেখুন: Click this link… ) ৷

যাহোক, যে কোন বিশ্বস্ত মুসলিমের উচিত বাকচাতুর্যের এই ফাঁদ সম্বন্ধে সার্বক্ষণিকভাবে যথাসম্ভব সচেতন থাকা ৷ শুধু যে বিধর্মীদের সাথে কথোপকথনে তাই নয়, এমনকি স্বধর্মী ভাববাদীদের ব্যাপারেও অত্যন্ত সাবধান থাকা উচিত ৷ উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশের মরমী গান “সোনা বন্ধে আমারে পাগল বানাইলো”- এ ধরনের কোন ভাব-বিহবল ভাষায় “সোনা বন্ধু” বলে আল্লাহকে ডাকার কোন অবকাশ নেই ৷ আল্লাহকে কি বলে ডাকতে হবে, বা ডাকা যাবে তা আল্লাহই শিখিয়ে দিয়েছেন – যে ৯৯ নামে পবিত্র কুর’আনে আল্লাহ নিজেকে প্রকাশ করেছেন, ঐ সব নামের একটি বা সবক’টি উচ্চারণ করে আল্লাহকে সম্বোধন করা যাবে বা করতে হবে – ব্যাস! তার বাইরে কেবল মাত্র কোন ধরনের আবেগ,কাব্য বা ভাবের বশবর্তী হয়ে আল্লাহকে সম্বোধন করার চেষ্টা যে কেবল হাস্যকর বাহুল্য তাই নয় বরং এক ধরনের প্রগাঢ় বে-আদবীও বটে ৷ একইভাবে, পবিত্র কুর’আনে আল্লাহ নিজেকে যেভাবে প্রকাশ করেছেন, তাঁর সম্বন্ধে আমাদের বর্ণনা সেটুকুর মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে ৷ আবেগ, কাব্য, ভাব ইত্যাদি মিলিয়ে মিশিয়ে কখনো anthropomorphic (নরত্ব আরোপকারী) আবার কখনো পৌত্তলিকতার ধ্যান-ধারণার আশ্রয় নিয়ে তাঁর বর্ণনা করা যাবে না ৷ “মিলন হবে কত দিনে, আমার ’মনের মানুষের’ সনে” অথবা “এই দেহ ইস্টিমার, নূর নবী প্যাসেঞ্জার, নিজে খোদা টিকেট মাস্টার” এ ধরনের বন্দনা গীতির কোন অবকাশ ইসলামে নেই – কেন না আল্লাহ কখনো নিজেকে কারো “মনের মানুষ” বা “টিকেট মাস্টার” বলে বর্ণনা করেন নি ৷ শুধু তাই নয়, আল্লাহর চেয়ে সুন্দরভাবে যেমন কারো কোন কিছু বর্ণনা করার প্রশ্নই ওঠে না, তেমনি অভিব্যক্তির ব্যাপারে, আল্লাহর অভিব্যক্তিকে অসম্পূর্ণ মনে করা রীতিমত অবিশ্বাসের নামান্তর ৷ সুতরাং, আল্লাহর গুণাগুণ বর্ণনা করতে গিয়ে আমাদের অত্যন্ত সাবধান ও সচেতন থাকা উচিত ৷ আল্লাহ যখন কুর’আনে বলেছেন যে, আর কেউ বা কোন কিছুই তাঁর মত নয় (৪২:১১, ১১২:৪) , তখন তাঁর বক্তব্যের বিরুদ্ধে গিয়ে আমরা যদি অন্য কোন সত্তার সাথে তাঁর সাদৃশ্য খুঁজতে যাই, তবে তা ক্ষমাহীন বেয়াদবীর পর্যায়ে পড়বে ৷

(চলবে…ইনশা’আল্লাহ!)

আন্তঃধর্ম সংলাপ – ২

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আস সালামু ‘আলাইকুম

লেখাটি পুরানো, আগে অন্য ব্লগে প্রকাশিত। পূর্ব প্রকাশিতের পর………..এর আগের লেখাটা রয়েছে এখানে:
Click this link…

পশ্চিমা বিশ্বের বস্তুবাদী নাস্তিকরা, তাদের বিশ্বাস হারিয়ে এখন অন্তঃসারশূন্যতার এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, ডুবন্ত মানুষের মত যে, কোন খড়কুটা দেখলেই, তা আঁকড়ে ধরে ভেসে থাকার জন্য হাত বাড়াতে দ্বিধাবোধ করে না তারা ৷ যুক্তরাষ্ট্রের বা যুক্তরাজ্যের বইয়ের দোকানে তাই তান্ত্রিক যৌনলীলা থেকে শুরু করে “লর্ড শিবার” গুণকীর্তন করা বইয়ের ছড়া-ছড়ি ৷ যুক্তরাষ্ট্রের একটি টিভি চ্যানেলের খবরে দেখছিলাম: হিন্দুদের দ্বারা পরিচালিত একটি স্কুলে, তারা যে শিক্ষককে “নমস্তে” বলে সম্বোধন করে ক্লাস শুরু করে থাকে – এই ধারণাটা ঐ অঙ্গরাজ্যের শিক্ষা কর্তৃপক্ষের খুব মনে ধরেছে – তারা অন্যান্য স্কুলেও ঐ অভিবাদন রীতি চালু করার কথা ভাবছে ৷ “ডমিনেন্ট কালচারের” দাবিদার ‘সাদা-চামড়া’ বস্তুবাদী অবিশ্বাসীদের কি করুণ পরিণতি – তথাকথিত “উন্নত ধর্ম” থেকে আগত আমেরিকানদের কাছে, যিশু খৃষ্টের শিক্ষার চেয়ে পৌত্তলিকদের “নমস্তে” এখন অধিকতর মানবিক ও মধুর বলে বোধ হচেছ – অথচ, স্বাভাবিকভাবে আহলে কিতাব হিসেবে, মুসলিমদের অতুলনীয় সুন্দর “আস সালামু ‘আলাইকুম” সম্বোধন তাদের কাছে ভালো লাগবে, এটাই স্বাভাবকি ছিল ৷

যাহোক, বিশ্বাস হারানোদের একটা কিছু বিশ্বাস করার চেষ্টা করলেই কি আর না করলেই বা কি? কিন্তু আমাদের – নিজেদের চারদিকে জ্ঞান ও যুক্তিভিত্তিক বিশ্বাসের সুকঠিন রক্ষাব্যূহ তৈরি করা উচিত ৷ তা নাহলে আমরা শয়তান প্ররোচিত কুফ্‌রির ফাঁদে সহজেই পা দিতে পারি ৷ ইতিহাস প্রসিদ্ধ অনেক মুসলিম ব্যক্তিই এ ধরনের ফাঁদে পা দিয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত বস্তুত বা কার্যত কাফির হিসাবে তাদের জীবনের অবসান হয়েছে ৷ যুক্তরাষ্ট্রের একটা বইয়ের দোকানে দেখলাম হিন্দুদের লেখা একটি বই “Many forms of the formless”৷ কথাটা শুনতে খুব দার্শনিক একটা মেজাজের আভাস পাওয়া যায় ৷ কিন্তু মুসলিম ‘আকীদার দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যপারটা নির্ভেজাল কুফ্‌রি ৷ গরু, নদী, কুমারী ইত্যাদি নানা রূপের ভিতর অরূপ “ভগবানের” রূপ নিহিত – সুতরাং কেউ যখন গরুর পূজো করছে, তখন সে আসলে গরুর মাঝে ‘নিহিত’ ভগবানের পূজো করছে – যুক্তিটা অনেকটা এই রকম ৷ বলা আবশ্যক যে, মক্কার কাফির ও মুশরিকদের যুক্তিও এরকমই ছিল – নানা “demi god” এবং “petty god”এর মধ্যস্থতায়, আসলে আল্লাহরই উপাসনা করছে বলেই তারা মনে করতো ৷ অথচ, মুহাম্মদ(সা.) কি তাদের সাথে এ ব্যপারে কোন “সংলাপে” গিয়েছেন? কোন সমঝোতায় পৌঁছেছেন?? না মোটেই না, বরং এই একটি পয়েন্টেই সত্যিকার অর্থে মক্কার কাফিরদের সাথে তাঁর সংঘাত ঘনীভূত হয় – মক্কার কাফির মুশরিকরা দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাচিছল যে, আমাদের দ্বীনের মূলমন্ত্র বা সারকথা যে একটি বাক্যে সংকুচিত, সেই বাক্য অর্থাৎ “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌” মেনে নিলে, তাদের স্বপ্নের কাবা-ভিত্তিক পৌত্তলিকতার মিথ্যা স্বর্গরাজ্য ধবসে পড়বে ৷ এই একটা ব্যাপারে কোন সংলাপ নয়, কোন লেনদেন নয় বা কোন সমঝোতা হবার নয় – এ কথাটা বলতেই ঐ বিখ্যাত আয়াত “লাকুম দ্বীনুকুম ওয়াল ইয়া দ্বীন” নাজিল হয়েছে ৷ অথচ, অজ্ঞতাবশত আমাদের দেশের মূর্খ রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে “সংস্কৃতমনা” নির্লজ্জ নারী ব্যক্তিত্বকেও, এই আয়াতটিকে ঠিক উল্টোভাবে ব্যবহার করে, আন্তঃধর্ম প্রেমের বাণী ছড়াতে এবং ধর্মের ভিতরে সকল বিচ্যুত ব্যক্তিদের স্থান সংকুলান করার চেষ্টা করতে দেখা যায় ৷

পশ্চিমা দেশে হালে “আন্তঃধর্ম সংলাপ” (বা interfaith dialogue) বলে একটা কথা বেশ ঘন ঘন খবরের কাগজ বা গণমাধ্যমে দেখা যায় ৷ আমি বুঝি না মুসলিমরা কি করে ‘কোন ধর্মীয় ব্যাপারে’ বিধর্মীদের সাথে আন্তঃধর্ম সংলাপে যেতে পারে ৷ হ্যাঁ, অমুসলিম দেশে বসবাস করার জন্য মুসলিমদের উপরে আল্লাহর যে লা’নত রয়েছে (দেখুন: পবিত্র কুর’আন, সূরা নিসা, ৪:৯৭), তার স্বাভাবিক ফলশ্রুতিতে সামাজিক পর্যায়ে অনেক ধরনের লেনদেনের জন্য বা দর কষাকষির জন্য হয়তো অন্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে আলোচনায় বসতে হতে পারে – যেমন ধরুন, কোন একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠার কাজ যে ঐ লোকালয়ের অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য পরিবেশ দূষণকারী কোন ব্যাপার হবে না, এ ব্যাপারে বিধর্মীদের আশ্বস্ত করার জন্য আন্তঃধর্ম আলোচনার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে ৷ কিন্তু আমরা কি বিশ্বাস করবো, কি করবো না, বা আমাদের ‘আকীদা বা বিশ্বাসের কতটুকু আন্তঃধর্ম সুসম্পর্কের খাতিরে জলাঞ্জলি দেওয়া যেতে পারে, তা নিয়ে (অন্য কোন ধর্মাবলম্বীরা আলোচনায় যেতে পারলেও) মুসলিম থাকা অবস্থায় – অর্থাৎ মুসলিমত্ব অক্ষত রেখে – ঐ ধরনের কোন আলোচনায় যাবার কোন অবকাশ আমাদের নেই ৷ সুতরাং, এধরনের কোন প্রেম-প্রীতি বর্ধক আয়োজনের ফাঁদে পা দেবার আগে, আমাদের অত্যন্ত সাবধানতা সহকারে ঐ আয়োজনের আদ্যোপান্ত বিচার করা উচিত ৷

নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত “সাপ্তাহিক বাঙালী” পত্রিকার ১৩ জুন ২০০৪ সংখায়, ‘প্রবাসে বাঙালী’ নামক পাতায় একটা খবরের শিরোনাম ছিল ব্রুকলীনে মুসলমানইহুদীখৃস্টানদের ভ্রাতৃত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান” ৷ পত্রিকায় লেখা হয়: ”দ্য ফার্স্ট এ্যানুয়েল চিল্ড্রেন অফ আব্রাহাম পিসওয়াক” অত্যন্ত আনন্দপূর্ণ পরিবেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় গত ১১ জুন ব্রুকলীনের ম্যাকডোনাল্ড এভেন্যুর উপর বায়তুল জান্নাত মসজিদ প্রাঙ্গণে (আনন্দটা কি জন্য তা অবশ্য আমি বুঝিনি – ইহুদী খৃস্টানদের কাছে সারা পৃথিবীর মুসলমানদের নিগৃহীত হবার শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে কি-না কে জানে?) তাদের শ্লোগান বা বক্তব্য ছিল ‘সকলের জন্য শান্তি’ বিচার সকলের জন্য সমান হওয়া চাই (যেন মুসলিমদের প্রবল আপত্তির কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাশীল গোষ্ঠী প্যালেস্টাইন ও ইরাক সহ গোটা মুসলিম বিশ্বের প্রতি সুবিচার করতে পারেনি) ৷ আর কোন যুদ্ধ নয় ৷ জাতিগত বা ধর্মীয় কারণে কাউকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা চলবে না ৷… আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সমৃদ্ধি চাই … আমরা বিভিন্ন জাতিতে, বিভিন্ন ধর্মে জন্ম নিলেও আমাদের পথ একটাই – আর তা হলো শান্তি ৷..”.

উপর্যুক্ত উক্তির শেষ লাইনটিই হচেছ সবচেয়ে ভয়ঙ্কর! না, শান্তি চাওয়াটা ভয়ঙ্কর কিছু নয় ৷ একটা ব্যাপার বুঝতে হবে – মুসলিমরা গত দুই তিন শতাব্দীর সকল অশান্তির বা দুর্যোগের নির্যাতিত/নিগৃহীত পক্ষ, বঞ্চিত পক্ষ – অক্ষম পক্ষ (ইংরেজীতে যাকে বলা হয় receiving end) ৷ আমরা শান্তি চাইলাম কি না তাতে কিছু এসে যায় না – অলমার্ট বা নাথানইয়াহুকে শান্তি চাইতে হবে – ডোনাল্ড রামসফিল্ড বা রবার্ট গেটসকে শান্তি চাইতে হবে ৷ সে যাহোক, শান্তির কথা বলাটাও মুসলিমদের জন্য একটা নিস্ফল অপচয় ও অর্থহীন বাক্য ব্যয় ৷ ইহুদী ও খৃস্টানদের সাথে মুসলিমদের পথ ”এক” হতে পারে কেবল একটি মাত্র উপায়ে – মুসলিমরা যদি তাদের নিজেদের দ্বীন ত্যাগ করে তবেই ৷ কোর্টে গিয়ে এফিডেবিট করে নিজের দ্বীন পরিত্যাগ না করলেও, সামাজিক পর্যায়ে ও সাংস্কৃতিক বলয়ে তারা যে নিজেদের way of life বা ‘দ্বীন’ ত্যাগ করে ’ডমিনেন্ট কালচারের’ কাছে আত্মসমর্পণ করেই চলেছে, সেটা সাধারণভাবে সারা দুনিয়ার মুসলিমদের, আর বিশেষভাবে কুফ্‌ফারের স্বর্গে বসবাস করে ’নির্বাণ’ লাভকারী মুসলিমদের জীবনযাত্রা দেখলেই বোঝা যায় ৷ সংস্কারবশত তাদের মাঝে দ্বীনের যেটুকু অবশিষ্ট রয়ে গেছে, সেটুকুতে ছাড় দিলে “আমাদের একটাই পথ” কথাটা সার্থকভাবে প্রমাণিত হতে পারে ৷ আসুন আন্তঃধর্ম প্রেম সম্বন্ধে আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল (সা.) কি বলেন, আমরা একটু ভেবে দেখি ৷ পবিত্র কুর’আনের অনেক আয়াতেই বিধর্মীদের ফন্দি-ফিকিরের ফাঁদে পা দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের সাবধান করা হয়েছে৷ ৩:৮৫, ৩:১০০, ৩:১১৮, ৪:১৪০, ৫:৫১ এবং ৪:১৪৪ হচেছ এমন কয়েকটি আয়াত ৷ এর দুই একটি চলুন আমরা একটু পড়ে দেখি:

হে ঈমানদারগণ! তোমরা যদি আহ্‌লে কিতাবদের কোন ফেরকার কথা মান, তাহলে ঈমান আনার পর তারা তোমাদিগকে কাফেরে পরিণত করে দেবে ৷ (সূরা আলে ইমরান, ৩:১০০)

হে ঈমানদারগণ! তোমারা কাফিরদেরকে বন্ধু বানিও না মুসলমানদের বাদ দিয়ে ৷ তোমরা কি এমনটি করে নিজের উপর আল্লাহর প্রকাশ্য দলীল কায়েম করে দেবে? (সূরা আন্‌-নিসা, ৪:১৪৪)

হে মুমিনগণ, তোমরা ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না ৷ তারা একে অপরের বন্ধু ৷ তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত ৷ আল্লাহ জালেমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না ৷ (সূরা আল্‌-মায়েদাহ, ৫:৫১)

এরপর আসুন “Islam Q-A” নামক ওয়েবসাইট থেকে নেয়া একটা হাদীসের প্রসঙ্গে, যেখানে জনৈক প্রশ্নকর্তার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তারা লিখেছেন:

Abu Dawood (2787) narrated from Samurah ibn Jundub that the Prophet (peace and blessings of Allaah be upon him) said: “Whoever joins a mushrik and lives with him is like him.” [অর্থাৎ, “যে, কোন মুশরিকের সাথে যোগ দেয় এবং তার সাথে বসবাস করে, সে তারই (ঐ মুশরিকের) মত একজন”] This was also narrated by al-Haakim (2/141) with a different isnaad; his version says: “Do not live with the mushrikeen and do not join them, for whoever lives with them or joins them is not one of us.” [অর্থাৎ, “মুশরিকদের সাথে বসবাস কোর না এবং তাদের দলে যোগ দিও না, কেননা যে কেউ যদি তাদের সাথে বসবাস করে অথবা তাদের দলে যোগ দেয়, তবে সে আমাদের একজন (কেউ) নয়”] This hadeeth was classed as hasan by al-Albaani in al-Saheehah, 2330, when the two isnaads are taken together.

তাহলেই দেখুন নামসর্বস্ব মুসলিম হলেও এবং দ্বীনের উপর সামান্য বিশ্বাস অবশিষ্ট থাকলেও, কুর’আন এবং আল্লাহর বিরম্নদ্ধে গিয়ে কোন মুসলিম “আমাদের পথ একটাই” বলে ’দ্বীন-ই-ইলাহী’ প্রতিষ্ঠার মতাদর্শের সাথে একমত হতে পারে না ৷ তবে বিশ্বাস হারালে বা কাফিরে পরিণত হলে তখন “সুবিধাজনক সহাবস্থানের” খাতিরে কেউ ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ প্রতিষ্ঠা করতে চাইতেই পারেন – সম্রাট আকবরের মত ৷ দেশের বাইরে, কর্মস্থলে আমার হিন্দুস্থানী হিন্দু সহকর্মীরা প্রায়ই গর্ব করে বলে থাকে যে, সম্রাট আকবর আসলে মনে প্রাণে হিন্দু হতে চেয়েছিলেন – তবে সংঘাত এড়াতে এবং অন্যান্য জটিলতায় জড়িয়ে পড়া এড়িয়ে যেতে, তিনি বিকল্প হিসাবে ’দ্বীন-ই-ইলাহী’ প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াস পান ৷

মাননীয় পাঠক, তার মানে এই নয় যে, আমরা অন্য যে কোন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সদা খড়গহস্ত হবো ৷ কিন্তু এটাও ঠিক যে, জাগতিক ব্যাপারে মতবিনিময় করা গেলেও, দ্বীনের ব্যাপারে আমাদের বিনিময় করার কিছুই নেই বরং ধর্মীয় পর্যায়ে সহ অবস্থান হতে পারে কেবল ‘লাকুম দ্বীনুকুম ওয়াল ইয়া দ্বীনের’ ভিত্তিতে ৷ কেননা আল্লাহ নিজেই বলেছেন:

আর কেউ যদি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্মাবলম্বন করতে চায়, তবে তা কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না এবং পরকালে সে ক্ষতিগ্রস্তদের দলভুক্ত হবে ৷” (সূরা আলে ইমরান, ৩:৮৫)

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *