আমার কৈফিয়ত!
জীবনের একটি দিন:
প্রথম দিনটি ছিল একটা হরতালের দিন, ৬ই জানুয়ারী, ২০১৩: ২৩ শে পৌষ। কিছুটা অনিচ্ছা নিয়ে বিকালে পৌনে ৫ টার দিকে বাসা থেকে বেরুলাম উত্তরা সংলগ্ন “কাজী বাড়ী”তে যাবো বলে। “কাজী বাড়ী মসজিদে যখন ঢুকলাম, তখন মাগরিবের সালাতের জামাত দাঁড়িয়ে গেছে। পৌষের শেষ ভাগের সন্ধ্যায় সালাতে দাঁড়িয়ে হঠাৎ খেয়াল করলাম, বেশ ঠান্ডা পড়েছে অথবা, হয়তো কার্পেটের উপর দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া এই আমার পায়ে, কেবল চটবস্ত্রের ম্যাটে দাঁড়ানোতে ঠান্ডাটা এক পড়তা বেশী লেগে থাকবে। মাগরিবের পর পাশেই একটা ধানক্ষেতে খাটানো প্যান্ডেলের দিকে এগিয়ে গেলাম আমরা। আমি এই ধরনের আয়োজনে জীবনে একবারই গিয়েছিলাম ছেলেবেলায় সিলেটে। অগ্রহায়ণ মাসে পরিপক্ক হওয়া ধান কেটে নেবার পর, রেখে যাওয়া নাড়া পড়ে আছে – কিছুটা অসমতল উঁচু নীচু মাঠে। তারই উপর চটের ম্যাট বিছানো হয়েছে যা আবার কাপড় দিয়ে মুড়ে দেয়া হয়েছে; উপরে বহুরঙ্গা বাহারী শামিয়ানা টানানো। প্যান্ডেলে যাবার পথে গজা-মুরালীর “ওপেন এয়ার” দোকান আর একটা বইয়ের স্টল দেখলাম। পথে বেশ কিছু পরিচিত চেহারার সাথে কুশল বিনিময় হলো। ২০০৬ সালের মাঝামাঝি থেকে নিয়ে ২০০৯ সালের শেষ পর্যন্ত আমরা উত্তরায় ছিলাম- তখন আমি সপ্তাহে কখনো একদিন, কখনো বা ২ দিন ঐ মাদ্রাসায় পড়াতে যেতাম, স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। আমার অনেক ছাত্রই এখন প্রায় পরিণত মানুষ তারা অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসে হাস্যজ্জ্বল মুখে কেউ হাত মেলাচ্ছিল, আর কেউবা আমার সাথে কোলাকুলি করছিল। আমি আমার সঙ্গী দ্বীনী ভাইসহ প্যান্ডেলের মাঝামাঝি একটা অংশে মাটির উপর বিছানো ম্যাটে অবস্থান নিলাম। “ওয়াজ মাহফিলের” আদলে আয়োজিত দ্বীনী আলোচনা সভাটি শুরু হতে যাচ্ছিল হয়তো প্রথাগতভাবেই লোকজনকে প্যান্ডেলের ভিতর নিয়ে আসতে, “ইসলামী সঙ্গীতের আয়োজন ছিল প্রথমেই।
যাহোক “কাজী বাড়ী মাদ্রাসা”র প্রতিষ্ঠাতা, বিশিষ্ট আলেম আকরামুজ্জামান বিন আব্দুস সালাম যিনি ঐ ওয়াজ মাহফিলের প্রধান আয়োজকও তিনি এসে যখন পৌঁছলেন, আমাকে এক প্রকার জোর করেই স্টেজে নিয়ে গেলেন। বক্তাদের বক্তব্য শুরু হলো: পৌষের সন্ধ্যায় ধান ক্ষেতের শিশির ভেজা নাড়ার সোঁদা গন্ধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ মাটি ও মানুষের কথা শুরু হলো জীবন সংশ্লিষ্ট, গণসাধারণ সংশ্লিষ্ট ইসলামের কথা।
ঐ অঞ্চলটাকে Suburb বলা যায়। ধানক্ষেতটা রাস্তার পাশে হওয়াতে, যারা রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়া করছিলেন, তারাও যেতে যেতে মাইকে বক্তব্য শুনে হয়তো খানিক দাঁড়িয়ে থেকে কিছু কথা শুনে যাচ্ছিলেন। মেয়েদের জন্য মূল প্যান্ডেলের বাইরে এক পাশে একটা আলাদা প্যান্ডেলের বসার ব্যবস্থা ছিল তবে মাইকের শব্দ বেশ চড়া হওয়াতে, তা অনেক দূর পৌঁছাবার কথা। সুতরাং, আশে পাশের বাসা বাড়ী থেকে মা-বোনদের আর কষ্ট করে প্যান্ডেলে আসার খুব দরকার ছিল না।
যা হোক, সভা এগিয়ে চললো। হরতাল থাকাতে ঢাকা থেকে মূল বক্তাদের প্যান্ডেলে এসে পৌছুতে বেশ সময় লাগছিল আর তাই ওয়াজ মাহফিল “জমতে”ও বেশ সময় লাগছিল। বক্তাদের ভিতর Peace TV-র বক্তা থেকে শুরু করে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা বেশ কিছু interesting চরিত্র ছিলেন। এদের ভিতর একজন প্রাক্তন “পীর” ছিলেন যার এককালে প্রায় লক্ষাধিক মুরীদ ছিল। “কাজী বাড়ী” মাদ্রাসার দায়িত্বশীলের কথায় convinced হয়ে যিনি তার “পীর-dom” ত্যাগ করে, এখন সহীহ-শুদ্ধ ইসলামের দাওয়াত দিয়ে বেড়ান। আমার খুব ইচ্ছা ছিল ভদ্রলোকের কথা শুনবো। কিন্তু সে দিন আর শোনা হয় নি।
একসময় ঘোষণা করা হলো যে, সন্ধ্যা ৭:২৫ মিনিটে আজান দিয়ে তারপর ৭:৩০-এ ইশার সালাত হবে। তাই হলো। আমরা আনুমানিক ১০০/১৫০ লোক প্যান্ডেলের ভিতর বিশাল লম্বা কয়েকটি লাইনে দাঁড়িয়ে ইশার সালাত আদায় করলাম। খেয়াল করলাম আমার অপর সঙ্গী, আমাদের গাড়ীর চালকও আমাদের জামাতে শরীক হয়েছেন। নামাজ শেষে আমরা আরো কিছুক্ষণ থেকে ৮:১৫-এর দিকে সভা ত্যাগ করলাম। “ওয়াজ মাহফিল” তখন কেবলই জমে উঠছে বলা যায়।
জীবনের আরেকটি দিন:
এবার আরেক জগতের একটি গল্প। উত্তরায় কিছুদিন আগে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে একটা স্কুল খুলেছে একটি বিদেশী স্কুলের আদলে, একজন বিদেশী ইসলামী ব্যক্তিত্বের ধ্যান-ধারণার অনুকরণ ও অনুসরণ করে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত। স্কুলটির প্রতিষ্ঠা লগ্নে, এর একজন “শেয়ার হোল্ডার” পরিচালক, আমাকে বিশেষভাবে দাওয়াত করেছিলেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যেতে। আমার বয়সে অনেক ছোট ঐ দ্বীনী ভাইটিকে আমি কোন রাখ-ঢাক ছাড়াই বলেছিলাম যে, স্কুলটির ধ্যান-ধারণার সাথে আমি যেহেতু একমত নই, তাই আমার সেখানে উপস্থিত থাকার কোন অর্থ হয় না – তিনি বুঝেছিলেন আমি কি বোঝাতে চেয়েছিলাম।
আমরা (আমি ও আমার স্ত্রী) যখন প্রায় প্রতি মাসে আমাদের মাকে দেখতে একবার করে সিলেট যেতাম, তখন আমার স্ত্রী এই তরুণ ভাইটির বাসায় তার মা-বোন সহ আরো কিছু মহিলাদের নিয়ে বসে দ্বীন ইসলাম সম্বন্ধে আলোচনা করতেন। ভাইটির মা, তার জন্য সম্ভাব্য পাত্রীরও খোঁজ করে থাকেন তার জন্য। ২০১২-এর ডিসেম্বর মাসে আমরা বাড়ী গেলে জেনেছিলাম: ৭ ই জানুয়ারী তার ঐ স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে, আমাদের ঐ তরুণের মা সিলেট থেকে ঢাকা আসবেন; স্কুলের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে; তিনি এমন আগেও এসেছেন।
সম্ভবত জানুয়ারীর ৪ তারিখে, ঐ তরুণ আমাকে অত্যন্ত informally দাওয়াত করলেন ঐ অনুষ্ঠানে যেতে। আমার ভাবার যথেষ্ট কারণ ছিল যে, তার মা যেহেতু ঢাকায় আসছেন, সেই সুযোগে তিনি আমার স্ত্রীর সাথে তার সাক্ষাৎ আশা করছেন। আমি reluctantly “চেষ্টা করবো” ধরনের একটা জবাব দিয়ে veneue-টা জানতে চাই। তিনি বললেন, ‘উত্তরা ক্লাব’-এ অনুষ্ঠানটার আয়োজন করা হয়েছে। আমি তাকে বললাম উত্তরা ক্লাবের ঠিকানা আমাকে এসএমএস করে পাঠিয়ে দিতে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আমি প্রায় সাড়ে তিন বছর উত্তরায় বসবাস করে থাকলেও, উত্তরা ক্লাবটা ঠিক কোথায় জানতাম না এমন কি ময়মনসিংহ রোডের পূর্ব না পশ্চিম পাশে অবস্থিত তাও জানতাম না। আমি যখন উত্তরায় থাকি, তখন বাংলাদেশের জাতীয় দলের অধিনায়ক একজন প্রাক্তন ক্রিকেটার, তার ইসলামপ্রিয় উচ্চ শিক্ষিতা স্ত্রীকে নিয়ে আমার বাসায় এসেছিলেন শিশুদের ইসলাম-আশ্রিত শিক্ষা-দীক্ষা নিয়ে আলাপ করতে। তার মুখে প্রথম উত্তরা ক্লাবের নাম শুনেছিলাম কিন্তু তাতে একটা ধারণা হয়ে ছিল মাত্র। “উত্তরা ক্লাব” যে মদ-জুয়া ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদির অভয়াশ্রম, সেই সত্যটা পরিষ্কার হয়নি তখন।
যা হোক, অনুষ্ঠানের দিন অর্থাৎ ৭ই জানুয়ারী আমার ঐ তরুণটি আবারো আমার যাওয়া নিশ্চিত করতে আমাকে ফোন করলেন। তখন বললেন যে, আমার নামও অতিথি-তালিকায় দেয়া হয়েছে। আমি তখনো কথাটার “শানে নুজুল” বুঝি নি। বুঝলাম সন্ধ্যায়, মাগরেবের পর পর যখন গিয়ে ওখানে পৌঁছলাম।
আমাকে নামিয়ে দিয়েই গাড়ীসহ আমার ড্রাইভারকে বাইরে চলে যেতে হলো। ওখানে অতিথিদের গাড়ীর স্থান সংকুলান হয় না। আমি জানি না ব্যাপারটা কি সব অতিথিদের জন্যই প্রযোজ্য, না ইসলামের গন্ধযুক্ত অনুষ্ঠানের অতিথিদের জন্য “খাস”। অনেক রেস্তোঁরায় বা কাফিরদের অনুকরণে তৈরী দোকান-পাটে বাচ্চাদের জন্য, তাদের ভুলিয়ে রাখার জন্য একটা “কর্ণার”-এ কিছু খেলাধূলার ব্যবস্থা থাকে। “মদ-জুয়ার” অভিজাত আয়োজনের স্থাপনার একপাশে মনে হলো, ইসলাম-ইসলাম খেলতে আসা “শিশু”দের জন্য তেমনই একটা কর্ণার বরাদ্দ করা হয়েছে। আমাকে বলা হলো lift-এর অমুক বোতাম চেপে যেতে হবে। নির্দিষ্ট তলায় পৌঁছুলে বুঝলাম, অতিথি নিয়ন্ত্রণের বেশ “টাইট” বেড়াজাল পেরিয়ে সবাইকে ভেতরে যেতে হচ্ছে।
যা হোক আমাকে দাওয়াত দেয়া ঐ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক শ্রেণীর তরুণটি খবর পেয়ে ছুটে এসে আমাকে যে একেবারে অন্তর থেকে স্বাগত জানালেন তা আমি বুঝলাম (আমি সেজন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ, আর মানুষের প্রতি যেটুকু কৃতজ্ঞতাবোধের অনুমোদন রয়েছে, ঐ তরুণের প্রতি আমি সেটুকু কৃতজ্ঞতা বোধ করলাম)। আমার স্ত্রীকে মেয়েদের বসার স্থানটি দেখিয়ে দিয়ে, আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো একেবারে সামনের সারিতে, মাঝখানে। ওখানে দেখলাম দেশবরেণ্য তিনজন আলেম আগে থেকেই বসে আছেন, যাদের দু’জনের সাথে আমার রয়েছে অনেক দিনের পরিচয় ও সখ্যতা। অপরজনের সাথে আমার টেলিফোনে কথা হয়েছে, কিন্তু সাক্ষাতে কথা হয়নি। যে আলেমের সাথে আমার আগে সাক্ষাতে হয়নি, তিনি হচ্ছেন ঐ প্রতিষ্ঠানের “কেতাবী” কর্ণধার। তিনি আমাকে খুবই উষ্ণতাসমেত স্বাগত জানালেন এবং অল্পক্ষণের ভিতরই আমার পাশে এসে বসলেন। অনুষ্ঠান যথা সময়ে শুরু হলো। একজন বিদেশী (সম্ভবত মিশরীয়) শিক্ষক অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে মঞ্চে আসলেন স্যুট টাইয়ের সাথে একটা “জালি” গোলটুপী মাথায়। তিনি তার ভুল-শুদ্ধ ইংরেজী উচ্চারণে, কুর’আন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরুর ঘোষণা দিলেন। একটু খটকা লাগলো আমি হয়তো আশা করেছিলাম যে “খুতবাতুল হাজা”র মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হবে। আমি/আমরা টিভি দেখি না প্রায় ১২ বছর। যার। যাদের অনুকরণে প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত, তার/তাদের অনুষ্ঠান কি করে শুরু হয় আমি জানি না হয়তো এভাবেই শুরু হয় কারণ সব কিছুতেই যখন একটা cult ভিত্তিক অনুকরণ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তখন এটা ব্যতিক্রম হবার কোন কারণ নেই।
স্টেজটা সাজানো হয়েছিল পশ্চিমা ব্যান্ড বা পপ-তারকাদের অনুষ্ঠানের মঞ্চের মত করে রঙীন ঘূর্ণায়মান বাতির সাথে স্টেজকে কৃত্রিমভাবে “ধোঁয়াশাচ্ছন্ন করার আয়োজন ছিল। স্টেজটার উজ্জ্বল রঙিন আলো ও বর্নাঢ্য প্রতিবেশ আমার মনটাকে আলোকিত না করে বরং তিক্ত করে দিল- ভাবছিলাম আমরা কোথায় চলেছি (কুর’আনের ভাষায়: فأين تذهبون – অর্থাৎ, অতঃপর তোমরা কোথায়
চলেছো?) – এখন ভাবছি রাসূল (সা.) আমাদের মাঝে থাকলে, এই আয়োজন দেখে কি বলতেন?
এখানে কেউ আমার সাথে তর্ক জুড়ে দিতে পারেন যে, রাসূল (সা.)-এর সময় কোন একটা ব্যাপার প্রচলিত ছিল না বলে কি আমরা সেটা করতে পারবো না?১
অনুষ্ঠান এগিয়ে চললো ইংরেজী ও আরবী ভাষায় নানা রকমের “ইসলামী” আয়োজন সমেত – কুর’আন বা হাদীসের অনুবাদ, গল্প, নবী বা সাহাবীদের কোন ঘটনার বর্ণনা ইত্যাদি ইত্যাদি। কথা বলায় মুহাম্মদ (সা.)-এর চেয়ে বরং বিখ্যাত কোন একজন মিডিয়া ব্যক্তিত্বের মত করে হাত নাড়া, হাত বাঁধা এমন কি উচ্চারণ প্রবণতা খুবই লজ্জাস্কর বোধ হচ্ছিল আমার কাছে – পাপেটের মত বা পোষা তোতা পাখির মত যান্ত্রিক ভাবে শেখানো বুলি আওড়ানো দেখে আমার জীবনের জাহিলিয়াতের যুগে পড়াশোনা: “চিরতন, হরতন, ইস্কাপন….” গানটির কথা মনে হচ্ছিল। এটা অবশ্য worldview-এর ব্যাপার ওখানে উপস্থিত অনেকের চেহারা দেখেই মনে হচ্ছিল যে, তারা রীতিমত enjoy করে চলেছেন অবস্থাটা। আমার একরকমের কান্না পাচ্ছিল দুনিয়া ও আখেরাতের মঙ্গলের কথা বলে মানুষকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কোন দিকে ডাকা হচ্ছে ভেবে খুব কষ্ট হচ্ছিল।
প্রতিষ্ঠানের “সত্যিকার” নির্বাহী এক সাহসী যুবক এক সময় তার বক্তব্য রাখলেন – সাহসী এজন্য যে, এতবড় একটা কাজে যেভাবে তিনি আত্মনিয়োগ করেছেন সেটা নিঃসন্দেহে সাহসের কাজ। তিনি খুব “আত্মবিশ্বাসী” উদ্যোক্তা ও জড়তা কাটিয়ে ওঠা মানুষও বটে – তার পুরো বক্তব্যটাই তিনি “বাঙালী” ইংলিশে রাখলেন। প্রায় প্রতিটি বাক্যে ইংরেজী ব্যকরণগত ভুল থাকলেও, তিনি খুবই আত্মবিশ্বাসের সাথে তার পুরো বক্তব্যটা স্টেজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ইংরেজীতে উপস্থাপন করলেন।
আমার জন্য আরো বিস্ময় বাকী ছিল: মঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হলো যে, তাদের প্রতিষ্ঠান এই মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, এখন থেকে ইসলামী দাওয়াতের কাজে অবদান রেখেছেন, এমন ৫ জন করে ব্যক্তিকে তারা প্রতিবছর সম্মাননা প্রদান করবেন।
ইতিমধ্যে দেশ বরেণ্য আরেকজন ডক্টরেট আলেম আমাদের সাথে এসে যুক্ত হয়েছিলেন – তিনিও আমার একপাশে এসে বসলেন। সদ্য আগত এই আলেমের সাথেও আমার বেশ ভালো পরিচয় ছিল। আছে ২০১১ আমাদের হজ্জ গ্রুপে তিনি আমাদের সাথে মিনায়/আরাফায় একত্রে ছিলেন। যা হোক, ঐ প্রতিষ্ঠানের ৫ জন ব্যক্তিত্ব স্টেজে উঠে দাঁড়ালেন। আমি হয়তো এই সংক্রান্ত ঘোষণার সময় কিছুটা অন্যমনস্ক ছিলাম, তাই ভাবলাম এঁদেরই বুঝি সম্মানিত করা হবে। পরে বুঝলাম, না – অস্কার পুরস্কার প্রদানের স্টাইলে একজন “বিশেষ” ব্যক্তি, অপর একজনকে সম্মানিত করবেন।
যা হোক, প্রথম দু’জন আলেমের নাম ঘোষণা করা হলো, যাদের সাথে আমার অনেক দিনের পরিচয় ও সখ্যতা, আপনাদের আগেই বলেছি। সামনের সারিতে যেহেতু খুব বেশী মানুষ ছিলেন না, আমি প্রমাদ গুনলাম – অজানা আশঙ্কায় আমার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো। এর পর ডাকা হলো দেরীতে আসা শেষোক্ত ঐ আলেমকে – তাতে আমার বেশ স্বস্তি লাগলো! কেন যেন মনে হলো আমার আশঙ্কাটা হয়তো অমূলকই। কিন্তু আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে এবং আশঙ্কাকে সত্যায়িত করে, এরপরই আমার নাম ডাকা হলো। একবার মনে হলো আমি অপারগতা জানাই, কিন্তু পর মুহূর্তে মনে হলো সেরকম করলে ব্যাপারটা গোটা আয়োজনে একটা চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। একমত হতে না পারলেও, আরেক জনের ক্ষতি করা হয় তো ঠিক হবে না।
স্টেজে উঠতে হয় পেছন দিক থেকে। উঠতে উঠতে আমার পরিচিত আর একটি সিলেটি ছেলেকে দেখলাম গ্রীনরুম মত জায়গাটাতে। আমাকে বিব্রত করার জন্য তাকে এক ধরনের তিরষ্কার করতে করতে আমি স্টেজে ঢুকলাম। তারপর পশ্চিমাদের অনুকরণে সাজানো গোটা অনুষ্ঠানের মতই, পশ্চিমাদের কাছ থেকে শেখা রীতি অনুযায়ী একটা crest তুলে দেয়া হলো আমারও হাতে – বলা বাহুল্য ঘটনাটার বহু ছবি তোলা হলো। আমার পরে ৫নং যাকে সম্মাননা দেয়া হলো, তিনি ছিলেন অত্র প্রতিষ্ঠানের “কেতাবী” কর্ণধার ঐ আলেম যার কথা আগেই আপনাদের বলেছি। পরে দেখলাম crest-এর মোড়কের ভিতর একটা চেকও রয়েছে। এমনিতে সাদাকাহ করতে হয় চুপি চুপি – তবে এখানে বলা আবশ্যক যে, তাদের দেয়া ৫ অংকের ঐ চেকের একটি কানা-কড়িও আমার জীবনে মেশে নি – আমি তা সাদাকা করেছি! সাদাকা বলাটা হয়তো প্রযোজ্যই নয়, বলা উচিত, আমি মানুষের পয়সা মানুষকে ফেরত দিয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ!
যা হোক, এরপর রাত প্রায় ৮:৩০-এর দিকে অনুষ্ঠান ভাঙ্গলো শীতের রাতে রাত ৮:৩০ অনেক রাত। বলা বাহুল্য যে, নিয়মিত মসজিদগুলোতে ‘ইশার জামাত বহু আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। বের হতে হতে পরিচিতদের বললাম: ইসলামের নামে পরিচালিত অনুষ্ঠান শেষে জামাতে সালাত আদায় না করে যে যার মত বাসায় চলে যাবো এটা কেমন কথা! আরো বললাম, ক্লাব প্রাঙ্গণে ঢোকার মুখে একটা মুসাল্লাহ বা “নামাজ খানা” দেখেছি – ওখানে আমরা জামাতে নামাজ পড়ে বাড়ী যেতে পারি। এ ধরনের ক্লাবে সাধারণত নামাজ পড়তে বা নামাজ পড়বেন মনে করে কেউ আসেন না। তবু ব্যতিক্রমী কেউ যদি কখনো এসে নামাজের জায়গা খোঁজেনই, তবে তার জন্য, আর ক্লাবে কর্মরত “নিম্নবর্ণের” মুসলিমদের জন্য নামাজের একটা ব্যবস্থা রাখা হয়। “নিম্নবর্ণ” বলার পেছনে একটা কারণ আছে। আপনাদের সাথে শেয়ার করা যাক: বেশ ক’ বছর আগে আমাদের চেয়ে বয়সে বড় এক প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তার সাথে পরিচয় হয়েছিলো, যিনি সদ্য ইসলামের পথে এসেছেন বলা যায় – নিয়মিত নামাজ পড়তে শুরু করেছেন। তিনি ছিলেন ঢাকার আরেকটা স্বনামধন্য ক্লাবের একজন কর্মকর্তা। তিনি বললেন যে, ক্লাবে তিনি যখন কোন ওয়াক্তের নামাজ পড়েন, তখন তার সাথে জামাতে যারা শামিল হোন তারা হচ্ছেন বয়/বোয়ারা শ্রেণীর কর্মচারীরা। এ নিয়ে মদ খেতে বা ফুর্তি করতে আসা তার সতীর্থরা তাকে ঠাট্টা বিদ্রুপ করতেন: যেমন, “যাও তোমার বন্ধুরা তোমার জন্য (নামাজের জন্য) অপেক্ষা করছে।” এসবের ভিতর প্রচ্ছন্ন যে ইঙ্গিতটা রয়েছে তা হচ্ছে: “নামাজ রোজা” এখন হচ্ছে “নিম্নবর্ণের” মুসলিমদের ব্যাপার (নাউযুবিল্লাহ)!
যা হোক, আমাদের কথার মূল ধারায় ফিরে আসি। ঐ মুসাল্লাহ যা নামাজ খানায় বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বুঝলাম যে আর কেউ আসবেন না! তখন আরেক ভদ্রলোক, আমি আর আমার স্ত্রী জামাতে এশার নামাজ সমাধা করে বাড়ী রওয়ানা হলাম।
*******
আপনাদের দু’টা দিনের দু’টো ঘটনা, দু’টো আয়োজন বর্ণনা করলাম ইসলামের নামে করা দু’টো অনুষ্ঠান। আমি আমার যুক্তি তর্কে আরো এগিয়ে যাবার আগে, আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই। এই দু’টো আয়োজনের কোনটিকে আপনাদের সুন্নাহর নিকটবর্তী বলে মনে হয়? আমি জানি এই দু’টো আয়োজনের কোনটাই perfect নয়, তবু, কোনটাকে আপনাদের সুন্নাহর নিকটবর্তী মনে হয়? ধরুন, আপনি একটা crossroads-এ দাঁড়িয়ে আছেন – আপনাকে একটা পথ বেছে নিতে হবে: এক দিকে রয়েছে “মাটি ও মানুষ” সম্পৃক্ত, সকলের জন্য উন্মুক্ত “সকলের ভাষায় কথা বলা” ধানক্ষেতের ঐ অনুষ্ঠানটি – আরেক দিকে রয়েছে “মদ-জুয়া”র আয়োজনের সুবধিাদানকারী বা সার্ভিস প্রভাইডার ক্লাবের “রঙিন নাচ-ঘর”-এ ইংরেজী ভাষায় পরিচালিত ঐ অনুষ্ঠান – আপনি একজন মুসলিম হিসেবে কোন দিকে যাবেন?
আমার কৈফিয়ত ও কৈফিয়তের পটভূমিঃ
যা হোক, কৈফিয়ত যখন দিতে বসেছি, প্রাথমিক আলোচনার সাথে সংশ্লিষ্ট আরেকটি প্রসঙ্গে একটু বলতে চাই। আল্লাহ মানুষকে একটা “আমিত্বের” element দিয়ে হয়তো সৃষ্টি করছেন, যা নিয়ন্ত্রণে রাখা সাধারণ ভাবে সকল মানুষের জন্য, আর বিশেষভাবে মুসলিমদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ইতিহাস ঘাঁটলে দেখবো পৃথিবীর অনেক প্রানহানি যা হানাহানির পেছনে “আনা খাাইরুম মিনহু” বা “আমি ওর চেয়ে শ্রেয়” বোধটা কাজ করেছে। অথচ, আমরা জানি যে, কুর’আনিক শিক্ষা অনুযায়ী কথাটা বা বোধটা হচ্ছে শয়তানের – এই বোধের জন্যেই শয়তান আল্লাহকে অমান্য করেছিল। ইসলামের স্কলাররা তাই সব সময় এই বোধটা সম্পর্কে আমাদের সাবধান করে থাকেন অনেকেই মনে করেন আল্লাহ অত্যন্ত করুণাময় বলে আমাদের “আমি” কথাটা ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন২।
আল্লাহ অত্যন্ত করুণাময় বলে আমাদের “আমি” কথাটা ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন। তা না হলে “আমি” “আমি” বলে কথা বলাটা মানুষের জন্য এক প্রকার অশোভন ঔদ্ধত্যই বটে। যা হোক, এই “আমিত্ব” বা “আনা খাইরুম মিনহু এই বোধ থেকেই মানুষ হয়তো নিজেকে সব সময় “বিশেষ” ভাবতে পছন্দ করে – চেষ্টা করে: to stand out। আমি আর সবার মত নই বরং আলাদা, distinct এটা ভাবতে হয়তো এক ধরনের আত্মতৃপ্তি অনুভব করে থাকবে মানুষ। আর তাই তো ফেসবুকে বা ব্লগে like বা “পছন্দ” পাবার জন্য মানুষের কি প্রাণান্তকর চেষ্টা। আমি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে বুঝি, যে মানুষের ভিতর “আনা খাইরুম মিনহু” যত বেশী, সে বা তার প্রকৃতি শয়তানের তত নিকটবর্তী – আর এই বোধটা যার যত কম, তিনিই বুঝিবা আল্লাহর প্রিয় বান্দাহ বা “ইনসান কামিল” বা “perfect human being”। সেজন্যই মদীনার মসজিদে অনেক সময় বাহিরাগতরা এসে রাসূলকে (সা.) সাহাবীদের মাঝে থাকা অবস্থায় দেখে চিনতে পারতেন না তিনি কোনজন। কারণ: to stand out from the rest এই ব্যাপারটা তাঁর ভিতর একদমই ছিল না!
স্বাভাবিক ভাবেই রাসূল (সা.)-এর প্রকৃতি ছিল শয়তানের প্রকৃতির একেবারে বিপরীত প্রান্তে। সেজন্যই আমরা তাঁকে, আরেকজন সাহাবীকে সাথে নিয়ে গাধার পিঠে চড়তে দেখি – যখন তিনি আক্ষরিক অর্থেই মদীনার অধিপতি – চাইলে আরবভূমির শ্রেষ্ঠ ঘোড়াটা তাঁর হতেই পারতো। একই কারণে ছদ্মবেশে ইসলামের খলিফা উমর (রা.) কে দেখতে আসা বিদেশী চরও প্রথাগত নিয়মে তাঁকে খুজে পায় না- to stand out from the rests এই ব্যাপারটা ইসলামের স্বর্ণযুগের সিংহপুরুষদের ভিতর একদমই ছিল না।
কিন্তু বলা বাহুল্য আমাদের দেশে রাজনৈতিক, সামাজিক জীবনে এবং কর্মকাণ্ডে to stand out from the rest ব্যাপারটা অনেকটা pathological পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এর আর্থসামাজিক কারণও রয়েছে। প্রায় কোন রকম ব্যতিক্রম ছাড়াই আমাদের দেশে “বিশেষ” ব্যক্তি হতে গেলে, প্রায় সব ক্ষেত্রেই “বিত্তশালী হতে হয়। আমরা ছোট বেলা থেকেই দেখি: “বিশেষ” ব্যক্তিদের কোথাও লাইন দিতে হয় না, অপেক্ষা করতে হয় না, কিছু পেতে তাদের দরজার দরজায় ঘুরতে হয় না – সবকিছু কেমন automatic হয়ে যায় তাদের জন্য। কার্যকারণের ব্যাপারগুলো তারা কোন অদৃশ্য শক্তি ও সহায়তায় কেমন যেন টপকে চলে যান। “লেখা-পড়া করে যে, গাড়ী ঘোড়া চড়ে সে” – এমন কথা পড়তে পড়তে বড় হলেও, বড় হয়ে দেখি “গাড়ী ঘোড়া” নিশ্চিত ভাবে কেবল একটা শ্রেণীই চড়ে – যাদের পূর্ব-পুরুষ well placed বা elite। এখানে আরেকটা প্রশ্ন এসেই যায় – আমাদের দেশের মত, পৃথিবীর হত-দরিদ্র দেশগুলোর অন্যতম একটা দেশে কয়েক হাজার কোটিপতি সম্বলিত এই elite শ্রেণীটা তাহলে কবে কিভাবে গড়ে উঠলো?
আমরা জেনেছি এতদঞ্চলের মানুষেরা সাধারণত “ছা-পোষা” কৃষিজীবী মানুষ ছিল। “আর কটা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি”, “ছেলে ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে” – এমন ছড়া এবং গান এজন্যই এদেশে মুখে মুখে প্রচলিত ছিল এবং এখনো আছে। হ্যা জমিদার, মহাজন, তালুকদার ইত্যাদির সমন্বয়ে গঠিত খুব ছোট্ট একটা সমষ্টি হয়তো তখনও ছিল, যারা শোষক ও অত্যাচারী বলে চিহ্নিত ছিল। তাদের বিশেষ মানুষ হবার “যাদু-মন্ত্র” ছিল মূলত বিদেশী সাদা-চামড়া প্রভুদের দালালি। শুনতে যত খারাপই লাগুক, আমাদের দেশের আজ থেকে ১০০/৫০ বছর আগের “বিশেষ” মানুষদের প্রায় সবাই ছিলেন বৃটিশদের পা-চাটা দালাল বা তাদের উত্তরাধিকারী বংশধর। আরেকভাবে আমরা বলতে পারতাম তারা হয় “বৃটিশদের রাজাকার” বা “বৃটিশদের রাজাকারদের সন্তান” ছিলেন। আজ রাজাকার পরিচয় যদি লজ্জাকর হয়, তবে সেটাও লজ্জাকরই হবার কথা। কিন্তু সেই লজ্জা হয়তো একটা মেকী আভিজাত্যের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। এখানে আমি একটা ব্যাপারই highlight করতে চাচ্ছি এতদাঞ্চলের ঐশ্বর্য্যশালীদের ঐশ্বর্য্যের সূচনা হয়েছে চোরা পথে, complicity-এর মাধ্যমে, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে, দালালির মাধ্যমে – নিজের এবং ঔপনিবেশিক মনিবের লোভের যোগান দিতে লাঠি ঘুরিয়ে শোষণ করে। একবার যখন একটা “pseudo আভিজাত” শ্রেণী তৈরী হলো, তখন সেই অর্থ-বিত্তভিত্তিক আভিজাত্যকে টিকিয়ে রাখতে, পরবর্তী প্রজন্মকে যখন যে দুর্নীতির আশ্রয় নিতে হয়েছে, তারা সেটাই নিয়েছে: behind every fortune there is a crime এই কথাটা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছে আমাদের elite শ্রেণীর বেলায়। উত্তরাধিকার বাদ দিলে, আমাদের দেশের বর্তমানে বিদ্যমান প্রথম সারির elite-দের ঐশ্বর্য্যের প্রধান উৎসগুলো হচ্ছে ঘুষ, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে গণমানুষের সম্পদ হাতিয়ে নেয়া, রাজনৈতিক প্রভাব ও পেশী শক্তির ছত্রছায়ায় সরকারী খাস জমি অথবা ব্যক্তি সাধারণের জমি দখল করা, সরকারী সম্পদ আত্মসাৎ করা বা/এবং সরকারী ক্ষমতা অপব্যবহার করা। এখানে একটা প্রশ্ন করে রাখি: আপনি কি আমাদের দেশে একজন এমন বিত্তশালী মানুষ চেনেন যিনি সৎভাবে শতকোটি বা কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন? বিত্তশালী হবার প্রক্রিয়ায় তিনি কখনো: প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ঘুষ নেয়া, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ঘুষ দেয়া, কোন মামা-চাচার প্রভাব খাটানো বা রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো, মানুষের সম্পদ চুরি করা, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অবৈধভাবে অত্যন্ত “লাভজনক” পণ্য আমদানী করা, অবৈধ হুন্ডির ব্যবসা করা বা আদম পাচার করা এসবের কিছুই না করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন?? আমি আমার ৫৮ বৎসর বয়সে এখনো এমন কাউকে দেখিনি!!
ঘুষ কিভাবে আদান প্রদান হয় সেটা হয়তো সবার জানা। অন্য ব্যাপারগুলো হয়তো কিছুটা ব্যাখ্যার দাবী রাখে। ধরুন চন্দ্রা বা ভাওয়ালের জঙ্গলে আপনাকে আমি আমার রাজনৈতিক ক্ষমতা বলে ৫০ বিঘা খাস জমি বা বনভূমির বন্দোবস্ত করে দিলাম প্রায় বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে – কাগজে কলমে আপনি একজন দারুন উদ্যোক্তা, যিনি এদেশে এমন একটা শিল্প-কারখানা স্থাপন করতে চান, যা দেশের শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মূদ্রার সাশ্রয় করবে। আসলে যা হলো আপনি রাতারাতি কর্পদকহীন থেকে কোটিপতি ও শিল্পপতিতে রূপান্তরিত হলেন; শুধু তাই নয় সাথে নতুন নতুন লুটপাটের একটা বিশাল দিগন্ত আপনার জন্য উন্মুক্ত হয়ে গেল – আপনি এখন ব্যাংক লোন, শেয়ার বাজারে নিবন্ধন, বিনিয়োগকারীসহ, লুটপাটের নতুন নতুন ক্ষেত্রে access পেয়ে গেলেন। আরেকভাবে বলা যায়, আপনি elite হবার একটা super highway-তে যুক্ত হলেন এবং নিতান্ত গাধা না হলে, আগে মাটির হাঁড়ি-পাতিল বিক্রী করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকলেও, এখন আপনি ‘ক’, ‘খ’ গ্রুপের মালিক হয়ে ৪০০০ কোটি টাকার ব্যাংক লোন পেতে পারেন এবং অতি অবশ্যই CIP/VIP হতে পারেন। এভাবেই তাহলে আমাদের দেশে in particular, আর বুঝিবা গোটা পৃথিবীতেই in general, “elite” শ্রেণী সৃষ্টি হয়ে থাকে।
এছাড়া আরো যে ভাবে “elite” সৃষ্টি হয়, তার অন্যতম একটি হচ্ছে পেশী শক্তি – যদিও পেশী শক্তি প্রয়োগ করতে হলেও, এর পেছনে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সমর্থন থাকতে হয়। একটা উদাহরণ দিচ্ছি: আমাদের দেশের প্রথম শ্রেণীর “elite”-দের সবাই না হলেও, অনেকেই আবাসন ব্যবসার সাথে জড়িত। এক্ষেত্রে “elite”রূপী ভূমি-দস্যুরা “পুরী হতে দূরে, গ্রামে নির্জনে” একটা এলাকা বেছে নেয়। তারপর দেখা যায় কিছু জমি কিনে বা অনেক সময় না কিনেও, একটা বিরাট অংশ জুড়ে তারকাঁটার সীমানা নির্ধারক স্থাপন করে নিজ কোম্পানীর সাইনবোর্ড/বিলবোর্ড লাগিয়ে দিল। কৃষকশ্রেণীর কোন গরীব মানুষ হয়তো খবর পেয়ে ছুটে আসেন তার জমির দাবী নিয়ে- তখন তাকে হয় নামমাত্র মূল্য অফার করা হয়, আর না হলে “ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করা হয়”। এভাবেই হবু এলিটদের “উপশহর” ও “সাম্রাজ্য” গড়ে উঠতে থাকে এবং ক্রমেই তারা elite থেকে eliteতর হতে থাকেন। এদেশেরে সবচেয়ে ধনীদের অনেকেই এভাবে “elite” বনেছেন। একবার “elite” হয়ে গেলে, তারা এবং তাদের সন্তানেরা এই গোটা দেশটাকেই একটা বস্তির মত জ্ঞান করে থাকেন। ছেলেমেয়েদের তখন নিউইয়র্ক, লন্ডন, দার্জিলিং-এ পড়তে যেতে হয়। বলা আবশ্যক যে, তারা শুধু ইংরেজী মাধ্যমেই পড়ে না বরং বাংলা ভাষা পড়তে, লিখতে, এমন কি শুনে বুঝতেও ভুলে যান। “elite” বাবা-মায়েরা শোষণের উৎস বজায় রাখতে বা বলা যায় শোষণের “পাইপ-লাইনের” উৎসমুখটার যত্ন নিতে, নাকে রুমাল চাপা দিয়ে হলেও এদেশে থাকতে বাধ্য হন। এভাবেই একদিন একসময়ের কোন গামছা-বিক্রী-করা অথবা পিয়ন বাবার ছেলে/মেয়ে কোন “elite” নিজেকে আর এদেশের “অস্পৃশ্য” গণসাধারণের একজন মনে করাটাকে দুঃস্বপ্নের মত জ্ঞান করেন। গুলশান, বনানী বা বারিধারার অভিজাত এলাকায় তাই নিজের “স্বপ্নপুরী” নির্মাণ করে, তার ভিতর নিজেদের আবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেন একটা “virtual -জান্নাত” তৈরীর চেষ্টা করেন তারা। তারা সবসময়ই বিশেষ বলে বিবেচিত হতে চান।
“elite” তৈরীর কিছু প্রক্রিয়া বর্ণনা করা হলো – যদিও একটু ভাবলেই যে কেউ বুঝতেন যে, “elites are not born, they are rather made (by various corruptions)”। এখানে চিন্তার আরো কিছু খোরাক যোগাতে দু’টো প্রশ্ন রেখে যাই – আপনারা ভাববেন:
১) কোন মুসলিম কি “elite” হবার এই প্রক্রিয়ায় জড়িত হতে পারেন বা নিজ মনে এই ধরনের “elite” হবার বাসনা পোষণ করতে পারেন?
২) কোন মুসলিম কি “elite” বলে, কারো প্রতি এক বিন্দু অতিরিক্ত শ্রদ্ধা পোষণ করতে পারেন?
অনেকদিন আগে, মেরিন একাডেমীতে থাকাকালীন ইংরেজী ভাষায় comprehension এর জন্য একটা গল্প পড়েছিলাম; গল্পের একটা অংশ এরকম: ভিন গ্রহ থেকে কোন প্রাণী এসে পৃথিবীর কোন একটা ব্যস্ত শহর পর্যবেক্ষণ করছে। সে অবাক হয়ে অনেক “শামুক সুলভ” প্রাণী দেখছে যারা শামুকের মতই লোহার শক্ত খোলসের ভিতরে থেকে চলাফেরা করছে। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গিয়ে, খোলস বা “shell” ত্যাগ করে, ভিতরের নরম/জীবন্ত অংশটা কোন বিল্ডিং-এর ভিতর ঢুকছে আবার কাজ শেষে ফিরে এসে “shell” এর ভিতর ঢুকে আরেক জায়গায় যাচ্ছে। মানুষের গাড়ীতে চলাফেরা করাটা খুব সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই বর্ণনাটা আমেরিকার একটু ছোট শহরগুলোর বেলায় বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আমার মনে আছে, জীবনে প্রথমবারের মত যখন ৮০-র দশকে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলাম, তখন Savannah শহরের উপকন্ঠে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে মনে হচ্ছিল যে, ঐ দেশে বোধহয় কোন মানুষই পায়ে হেঁটে চলাফেরা করে না। যতদূর চোখ যাচ্ছিল, নিজেদের ছাড়া আর কোন “পথচারী” দেখা যাচ্ছিল না। যাহোক, আজ যদি সত্যিই কোন ভিন গ্রহের প্রাণী এসে আমাদের “elite”দের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতো, তাহলে তার বর্ণনায় আরো কিছু তথ্য যোগ করতে পারতো: এই প্রাণীগুলো খোলা জায়গায় শ্বাস নিলে হাঁপিয়ে ওঠে ঠিক যেমন মাছ পানির বাইরে হাঁস-ফাঁস করে থাকে। প্রাণীগুলোর শ্বাস-প্রশ্বাস machine assisted – তারা একধরনের “মেশিন-পরিচালিত” বায়ু সেবন করে থাকে এবং সেটার ব্যবস্থা না থাকলে তারা হাঁপিয়ে ওঠে। আজ দেখবেন আমাদের “elite “রা বা এমনকি উচ্চ মধ্যবিত্তরাও এয়ার কন্ডিশন ছাড়া কেমন হাঁস-ফাঁস করতে থাকেন। অফিসে বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে তারা AC-তে থাকেন, বেরিয়ে AC গাড়ীতে ওঠেন, তারপর AC বাসায় যান আবার বাজার করতে AC mall এ যান – and so on…..। এভাবেই ধীরে ধীরে আমাদের eliteরা human থেকে humanoid হয়ে উঠছেন!
যাহোক, যা বলছিলাম, একবার elite হয়ে গেলে, তারা আর কিছুতেই আগের জায়গায় ফিরে আসতে চান না বা আরেকভাবে বলা যায় যে, আগের জায়গায় ফিরে আসার সম্ভাবনাটাও তাদের কাছে ভয়ঙ্করতম দুঃস্বপ্নের মত মনে হয়। তারা তখন যে কোন মূল্যে তাদের সেই elite অবস্থানটা ধরে রাখতে চান। জীবনের যে কোন ক্ষেত্রে সর্বদাই চান নিজেকে সাধারণের চেয়ে আলাদা করে দেখতে বা দেখাতে। এই ভাব-সাব আমার বা আমাদের – আমরা যারা অত্যন্ত সাধারণ পর্যায়ে ইসলামের দিকে মানুষকে ডাকার চেষ্টা করে চলেছি – তাদের জন্য তেমন কোন মাথা ব্যাথার কারণ হবার কথা নয়।
ঐ সব পরজীবী eliteরা তাদের জগতে সীমাবদ্ধ থাকলে আমাদেরও তেমন কোন সমস্যা হবার কথা নয়। কিন্তু আমাদের সংশ্লিষ্টতা আসে যখন এদের কেউ হঠাৎ করে আল্লাহর পথে চলতে শুরু করেন! ঐ ধরনের elite কেউ যখন আল্লাহর পথে চলতে শুরু করেন, তখন নিজের ভিতরে ও বাইরে – নিজের নফসের সাথে, নিজের পরিবার-পরিজনের সাথে, প্রতিবেশ ও পরিবেশের সাথে নিরন্তর সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন: কোনটা রাখবেন এবং কোনটা ছাড়বেন সেটা বুঝতে বুঝতেই হয়তো একজীবন চলে যায় – আর বোঝার পরেও সত্যি সত্যি ছাড়ার পর্ব তো রইলোই। আসুন তাত্ত্বিক পর্যায়ে এই ধরনের eliteদের Islamization সম্বন্ধে আমরা একটু জানতে চেষ্টা করি।
একজন টিন-এজার মুসলিমাহর কথাই ধরি আমরা। সেই মুসলিমাহ তার ইসলামের পথে আসার আগে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া, জিন্স টি-শার্ট পরা – চলনে, বলনে, কথনে তুখোড় স্মার্ট একজন টিন-এজার ছিলেন। ক্লাসের ছেলে বন্ধুদের তিনি “দোস্ত” বলে সম্বোধন করতেন তার চিবানো “ব্যঙ্গলিশে” – বলা আবশ্যক যে, তিনি আপনার আমার মতো বাংলা ভাষায় স্বাভাবিকভাবে লিখতে, পড়তে বা কথা বলতে পারেন না। বাসা, স্কুল, গাড়ী, মার্কেট ইত্যাদি – তার সকল বিচরণ ক্ষেত্রই ছিল AC। শুধু এই AC-র ব্যাপারই নয়, নিজের lifestyle-কে সাথে বহন করে নিয়েই চলতেন তিনি। যেখানেই যেতেন, বাবার দুর্নীতি-অর্জিত ঐশ্বর্যের স্পষ্ট ছাপ রেখে আসতেন। সবখানেই, সবাইকে বুঝিয়ে ছাড়তেন যে, তিনি বিশেষ, তিনি elite। জীবনের এরকম পর্যায়ে, হঠাৎ করেই তিনি ইসলামের দাওয়াত পেলেন। শতবর্ষের বন্ধ অন্ধকার দুর্গে, একসাথে কে যেন শত জানালা খুলে দিল – আর প্রতিটি জানালা দিয়ে যেন সরাসরি সূর্যের আলো ঘরে এসে প্রবেশ করলো – দুষ্ট সংস্কৃতির দুর্গে বন্দী রাজকন্যার, প্রথমে আলোর ছটায় অন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম! তীব্র আলোর অসহ্য যন্ত্রণায় চোখ বন্ধ হয়ে আসে। কিছুটা সময় পার হলে, আস্তে আস্তে চোখ খোলেন তিনি চেয়ে দেখেন বন্ধ দুর্গে তার চারপাশ জুড়ে আবর্জনার স্তুপ! এতদিন যা “দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া”। তিনি ভাবেন এসব জঞ্জাল সাফ করে জীবনটাকে একেবারে পরিচ্ছন্ন করে ফেলতে হবে! শুরু হয় জীবন garbage মুক্ত করার সংগ্রাম। কিন্তু garbage সত্যিই ছুঁড়ে ফেলে দিতে শুরু করলে, বোঝেন, এর অনেকগুলোই তার জীবনের অবিচেছদ্য অংশ – তখন চিন্তা-ভাবনা revise করতে শুরু করেন। “কিছু এর রেখে যাই, কিছু যাই লয়ে” মত একটা অবস্থা আসে জীবনে – কিছু কিছু ব্যাপার এমনও এসে যায়, যেগুলোকে ধরে রাখতে গিয়ে সেগুলোকে আরেকটা নাম বা রূপ দিতে হয়।
আমরা কি বলতে যাচ্ছি, একটু উদাহরণ সমেত বোঝার চেষ্টা করা যাক তাহলে। আগে সব সময় আমাদের কল্পিত টিন-এজার ইংরেজী সিরিয়াল বা কার্টুন বা মিউজিক ভিডিও দেখে দিন/সময় কাটাতেন। Friends জাতীয় ধারাবাহিকগুলো তার খুব প্রিয় ছিল। সমবয়সী ছেলেদের প্রতি “দোস্ত” “দোস্ত” ভাবের পেছনে Friends factor-এর অনেক অবদান রয়েছে। আমাদের টিন এজার এই মেয়েটির প্রিয় কার্টুন ছিল Simpsons। Anarchists-দের বানানো ঐ কার্টুনের অনেকাংশ জুড়েই থাকতো আমরা যাদের “মুরুব্বী” বলি – তাদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে ছোট করে দেখানো বা ridicule করা। বাবাদের ও শিক্ষকদের একধরনের নির্বোধ হিসেবে উপস্থাপন করার প্রবণতাটা আমাদের আলোচ্য তরুণীর কাছে দারুন উপভোগ্য ও মজার মনে হতো। আসলে ঐ কার্টুনটা তার জীবনে কিছু নতুন বোধ জাগ্রত করেছিল। কেবল বয়সে বড় হলেই কাউকে ভক্তি শ্রদ্ধা করতে হবে, বাবা বা শিক্ষক শ্রদ্ধেয় হবেনই – এই বস্তাপচা concept-গুলোর অবসান ঘটেছে তার জীবনে। এরপর থেকে বাবাকে বা শিক্ষককে নিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই তিনি যেমন মজা করেছেন, তেমনি তারা দোষের কিছু করলে তিনি তাদের দোষ ধরিয়ে দিতেও কৃষ্ঠা বোধ করেন নি! মিউজিক ভিডিওিতে তার অবশ্য ব্যাপক পরিসরের ভালো লাগা ছিল। বয়স্ক হলেও এবং নানা ধরনের দুর্নাম থাকলেও ম্যাডোনাকে তার অন্যরকম ভালো লাগতো। ম্যাডোনার “থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে” ভাবটা অথবা “***** rules” শ্লোগানটা এবং এসবের ভিতরের বিদ্রোহী ভাবটা তার দারুণ লাগতো – এক অজানা অনুভূতিতে তার নিজের দেহ-মনও শিহরিত হতো। এরকমই একটা অবস্থায়, হঠাৎই তিনি দ্বীনের দাওয়াত পান, আর বুঝতে শুরু করেন যে, এযাবত কালের ধ্যান, ধারণা চিন্তা-চেতনা, অনুভূতি – সবকিছুই মারাত্মক রকমের ভুল ছিল! time machine চড়ে যদি একবার জীবনের শুরুতে যেতে পারতেন, তবে হয়তো জীবনটাকে একদম নতুন করে আবার শুরু করতেন নতুন লাইনে – আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) নির্দেশ ও আদেশ অনুযায়ী জীবনের সূচনা করতেন একদম শুরু থেকেই। যাহোক, তা তো আর হবার নয়! তাই নিজের পুরাতন জীবনটাকেই মেরামত করতে শুরু করেন তিনি।
নিজের পুরাতন জীবনটাকেই মেরামত করতে গিয়ে, বলা যায়, জীবনের এক ধরনের Balancing Modernization-এর চেষ্টা শুরু করেন তিনি। প্রথেমেই জীবনে আমদানী ঘটে hardwareসমূহের কারণ এগুলো কিনতে পাওয়া যায়। পয়সা থাকলে যে কেউ কিনতে পারেন: হিজাব, নেকাব, হাত-মোজা, পা-মোজা, আবায়া (বোরকা) ইত্যাদি। আমি এগুলোর ব্যবহারকে মোটেও খাটো/ছোট করে দেখছি না। একজন কমবয়সী মেয়ে তার বেশ-ভূষা-রূপ কেউ দেখবে না, নিঃসন্দেহে এটা আল্লাহর জন্য বিশাল একটা ত্যাগ! তবে এসব ধারণ করার চেয়ে, অনেক অনেক কঠিন হচ্ছে নিজের “প্রকৃতি” ও “প্রবৃত্তি” বদলে ফেলা! Sofware পরির্বতন করা!! ১০, ১৫, ২০ বছর ধরে আমরা যা কিছু পছন্দ করেছি, ভালোবেসেছি – যা কিছু জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে বলতে গেলে রক্তধারায় মিশে গিয়েছে – সে সব ছাড়তে চেষ্টা করতে গেলে অনেকের জীবনেই এক বিশাল শূন্যতা এসে ভর করে। একটা উদাহরণ দেয়া যাক – আমি যে কাল্পনিক টিন-এজারের কথা বললাম, আগে, তিনি যখন ঘরে থাকতেন ও জেগে থাকতেন, সেই সময়টুকুর অবশ্যকরণীয় পড়ালেখার সময়টুকু বাদ দিয়ে যে অবসর সময়টুকু থাকতো, তার ৯৫% সময়ই হয়তো কাটতো স্যাটেলাইট চ্যানেলে ইংরেজী/হিন্দি সিরিয়াল দেখে, মিউজিক ভিডিও দেখে, ইন্টারনেটে বিচরণ করে, ফেসবুকে লাইক/ডিজলাইক দিয়ে অথবা শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে কোন “দোস্ত”-এর সাথে মোবাইলে বাক-বাকুম করতে করতে। তারপর হঠাৎই একসাথে জীবনে ওগুলোর সব কটিই পরিত্যাজ্য হয়ে দাঁড়ালো। অসংখ্য রঙের আর শব্দের সমাহারে পরিপূর্ণ জীবন হঠাৎই যেন বিবর্ণ হয়ে black and white হয়ে গেলো এবং pindrop silence-এ ভরে গেল। সবচেয়ে কাছের বন্ধুরাও এখন আর তার খোঁজ নেয় না – কারণ যে বিষয়গুলো নিয়ে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে কাটিয়ে দিতেন, সেগুলো হয় ছিল পরচর্চা বা গীবত, নতুবা কোন নায়িকা কত সাইজের অন্তর্বাস পরেন, অথবা এখন কার সঙ্গে কার “চলছে” ইত্যাদি। হঠাৎ করেই এসব নিয়ে কথাবার্তা যে শুধু অর্থহীন হয়ে গেলো তাই নয়, বরং একধরনের গর্হিত বলেও মনে হতে লাগলো। এই শূন্যতাকে পূরণ করতেই হয়তো অনেকের জীবনে রাত জেগে ইন্টারনেটে ‘ইসলামী সামগ্রী খোঁজার সূত্রপাত হয়। একটা ইসলামী সাইট থেকে আরেকটা, একটা ফেসবুক একাউন্ট থেকে আরেকটা, একটা “ইসলামী চ্যাটরুম” থেকে আরেকটা এভাবেই নিজেকে ব্যস্ত রাখতে শুরু করেন “হালাল ব্যাপারমূহে” – আর ব্যস্ত রাখতে গিয়ে বলা যায় “দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে থাকেন। আমাদের এই টিন এজার তরুণী কাল্পনিক হলেও, আমরা অনেককে চিনি, যারা এভাবে সারারাত কাটিয়ে ভোরে ফজরের সালাত আদায় করে ঘুমাতে যান এবং সকাল ১১টায় ঘুম থেকে ওঠেন। সম্পদশালী পরিবারের আদুরে মেয়েরা এটা afford করতে পারলেও, তারা আসলে পৃথিবীর বা মুসলিম উম্মাহর সত্যিকার কোন কাজে লাগার ব্যাপারে অযোগ্য হয়ে পড়েন। উম্মুল মু’মিনীনদের মত হবার চেষ্টা করে, অতি অল্পতে সন্তুষ্ট হবার মত কোন মা বা স্ত্রী হবার প্রচেষ্টার কথা না হয় বাদই দিলাম; আমাদের দেশের সনাতন পারিবারিক কাঠামোতে একজন মা বা স্ত্রীর যে ভূমিকা আশা করা হয়- তারা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তাও পালন করার প্রচেষ্টা করার কথাও কল্পনা করতে পারেন না। ইসলাম যা চায়, সেই মত করে নিজের Sofware অর্থাৎ “প্রকৃতি” ও “প্রবৃত্তি” কে পরিবর্তন না করে বরং ইসলামকে তারা নিজেদের সাথে খাপ খাওয়ানোর উপযোগী করে alter করে নেন ঠিক যেমন আমরা সস্তায় কেনা কোন রেডিমেড জামাকে নিজেদের মাপ মত কেটে ছেঁটে alter করে নিই।
সারাজীবন বাইরের বা বিদেশী ব্র্যান্ডের কাপড় পরেছেন, বাইরের জ্যুস-চকোলেট খেয়ে বড় হয়েছেন, বিদেশী/বিজাতীয় ভাষায় পড়াশোনা করেছেন, চার্লস ডিকেন্স বা ফ্র্যান্সিস বেকনের লেখা পড়েছেন, আর মেধার তেমন ধার না থাকলেও নিদেন পক্ষে এক্স ম্যান, স্পাইডারম্যান বা ব্যাটম্যান ইত্যাদি কমিকস বা “মিলস এন্ড বুন” মার্কা অখাদ্য তো গিলেছেনই; তার মগজটা সর্বদাই পশ্চিমা কাফিরদের দখলে ছিল৩ – তাদের চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখেছেন, তারা যা ভালো বলেছে সেটাকে ভালো জেনেছেন – আজ হঠাৎ করে একদম “দেশী ব্র্যন্ডের ইসলাম” গ্রহণ করে, কি করে তিনি মেধাহীন, পুষ্টিহীনতায় ভোগা সর্বসাধারণের একজন হয়ে যাবেন!! দেশে যাদের ইসলামের কথা বলতে শুনেছেন, তাদের সম্বন্ধে বেশী কিছু না জানলেও এলিট আত্মীয় বা পারিবারিক স্বজনদের মুখে যে সব কথা শুনেছেন, তা থেকে বুঝেছেন যে, এরা মিসকিন শ্রেণীর মানুষ; বেশীর ভাগই কোন এতিমখানায় বা “লিল্লাহ বোর্ডিং”-এ বড় হওয়া নিম্ন-মেধার মানুষ। এদের কাছ থেকে তার মত “শিক্ষিত” কারও শেখার কি থাকতে পারে? এখানেও তার বরং “বিদেশী ব্র্যান্ডের” ইসলামকেই বেশী নির্ভরযোগ্য মনে হয়েছে এবং সেখানে তিনি একটা স্বয়ংক্রিয় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন; ঠিক যেভাবে এদেশে থেকেও সারাজীবন তিনি এদেশের ভাষ্য, সামাজিকতা, আচার-অনুষ্ঠানের চেয়ে ইংরেজী ভাষাভাষী কাফিরদের ভাষা, আচার-অনুষ্ঠানে বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন। ঈদের দিনে বাবা-মায়ের পীড়াপীড়িতে বাসায় বেড়াতে আসা দূরসম্পর্কের কোন আত্মীয়-স্বজনের সামনে “হাজিরা” দিতে বা কোন আত্মীয় মারা গেলে মায়ের সাথে সেই বাড়ীতে যেতে তার অনেক সময়ই বিরক্ত লেগেছে। সেই তুলনায় বন্ধুদের সাথে Halloween বা Valentine’s day উদযাপনের আয়োজনে তিনি অনেক অনেক আনন্দ ও উচ্ছ্বাস অনুভব করেছেন এবং ব্যাপারগুলোকে দেশী ব্যাপারগুলোর চেয়ে অধিকতর অর্থবহ মনে হয়েছে।
তার নিজের মাতৃভাষা (বা মায়ের ভাষা) বাংলা হয়ে থাকলেও, তার মস্তিষ্কের “মাতৃভাষা” হচ্ছে ইংরেজী। ইসলামে “আসার” পর, তিনি ইউটিউবএ দেখেছেন Deenshow বা ঐ ধরনের আয়োজনে বিদেশী handsome শায়েখরা কি সুন্দর স্মার্টভাবে ইংরেজীতে ইসলামের উপর লেকচার দিয়ে থাকেন সেই তুলনায় আমদের বাসে ঝুলা, মলিনবস্ত্র আলেমরা কত নিষ্প্রভ, কত insignificant। বাংলাদেশে এভাবেই বিভিন্ন বিদেশী (পশ্চিমা দেশ থেকে আগত) ব্র্যান্ডের ইসলামের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। অথচ সৌদী আরবের মত স্থান ছাড়া, পৃথিবীর যে কোন দেশের তুলনায়, আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষিত ‘আলেমের সংখ্যা বেশ অবাক হবার মতই উল্লেখযোগ্য।
আমি ব্যক্তিগতভাবে অন্তত তিনজন ‘আলেমকে চিনি, যাদের মদীনার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে PhD রয়েছে: যারা পড়ালেখার জন্য সেখানে দীর্ঘ ১৫-১৮ বছর অবস্থান করেছেন। আমরা “ডট.কম” ও “ইউটিউব” মুসলিমরা, ইন্টারনেটের বদৌলতে, যে সমস্ত স্কলারদের রঙিন চকমকে প্রোগ্রাম দেখে পুলক অনুভব করি, তাদের একজনেরও মদীনার পিএইচডি লাভের সৌভাগ্য হয় নি – যদিও সেখানকার “লিসান্স” (ডিগ্রী) রয়েছে অনেকেরই। বিলাল ফিলিন্স, ইয়াসির কাজী, মুহাম্মাদ আল শরীফ, তৌফিক চৌধুরী থেকে শুরু করে আপনি যত নামী-দামী তারকাদের কথা বলবেন, এদের একজনেরও মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের PhD নেই। কেন নেই? মূলত এই জন্য যে, মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ডিগ্রী কোর্সে ভর্তি হলেই, স্বয়ংক্রিয়ভাবে মাস্টার্স বা পিএইচডি লেভেলে যাওয়া যায় না – তাই তাদের মাঝে যাদের ঐ পর্যন্ত যাবার ইচ্ছা হয়েছে অথচ মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ যাদেরকে বাছাই করেন নি, তারা অন্যত্র গিয়ে সেই শখ পূরণ করেছেন; যেমন ধরুন বিলাল ফিলিন্স ইসলামী বিষয়ে PhD করেছেন যুক্তরাজ্যের ওয়েলস থেকে – যেমন, পাকিস্তানী আমলে, আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার পন্ডিত আবদুল হাই তার PhD করতে ইংলন্ডে গিয়েছিলেন! মাস্টার্স বা পিএইচডি লেভেলে যেতে হলে, ওখানকার যোগ্যতা যাচাইয়ের অত্যন্ত “টাইট ছাঁকুনি” পার হয়ে যেতে হয়। সেই বিবেচনায় আমাদের দেশী স্কলার/ আলেমদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, ঐ সব বিদেশী তারকাদের তুলনায় ঈর্ষণীয় পর্যাযের শ্রেয়। কিন্তু আমাদের দেশী ‘আলেমরা হয়তো ঐ সব তারকাদের মত “বিকশিত” হতে পারেন নি। এই প্রসঙ্গে আমাদের প্রথমে বুঝতে হবে যে, শিক্ষাগত যোগ্যতা একটা ব্যাপার, আর সেই যোগ্যতাবলে “বিকশিত” হওয়াটা একটা ভিন্ন ব্যাপার! “বিকশিত” হবার সমীকরণটা অনেক জটিল: আপনি কোথায় জন্মেছেন, আপনি কোন দেশের নাগরিক, আপনি কোথায় থাকেন, আপনি সাধারণত কোন ভাষায় কথা বলেন, আপনার পাসপোর্টের রং কি, আপনি কোন রাজনৈতিক অক্ষে অবস্থান করেন, আপনার কোন “পৃষ্ঠপোষক” আছেন কি না- থাকলে তারা কারা, আপনি পশ্চিমা দেশে সমাদৃত কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নিয়েছেন কিনা, আপনি পশ্চিমা দেশগুলোর প্রশাসনের কাছে “পরিচিত” কিনা এবং “নিরাপদ” বলে পরিচিত কিনা, আপনি পশ্চিমা কাফির বিশ্বের মিডিয়া তথা প্রচার-প্রচারণায় স্থান পেয়েছেন কি না… ইত্যাদি অনেক ফ্যাক্টর কাজ করে। তাছাড়া যে কারো “বিকশিত” হবার পেছনে exposureটা তিনি কতটুকু প্রচারণা পেয়েছেন – সেটা অনেক বড় একটা ফ্যাক্টর। একসময় বড় বড় স্কলাররা অত্যন্ত exposure বিমুখ ছিলেন। একটা ছবি থেকে শায়েখ নাসিরউদ্দিনের আলবানী (রহ.) বা মুহাম্মদ বিন সালিহ আল উসাইমিনের (রহ.) চেহারা প্রথম দেখেছি পাঁচ বছরও হয়নি বোধহয় – অথচ তারা উভয়ে মারা গেছেন প্রায় ২২ বছর হতে চললো; এখন ইন্টারনেটে বা অন্যত্র তাদের যে সব ছবি ইত্যাদি পাওয়া যাচ্ছে, তারা বেঁচে থাকলে সে সবও পাওয়া যেত কি না, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। আজ থেকে আনুমানিক ৭ বছর আগেও, কোন একটা লেখায় জামাল জারাবযোর পরিচিতি উল্লেখ করতে চাইলে ইন্টারনেট ঘেঁটে অনেক চেষ্টা করওে উল্লেখযোগ্য কিছু পাই নি, ছবি দূরে থাক। উঁচুদরের স্করাররা সবসময়ই রক্ষণশীল ছিলেন এবং প্রচার তথা exposure বিমুখ ছিলেন। যাহোক, বাংলাদেশের ঢাকায় বা কুষ্টিয়ায় থাকা আমাদের বিশ্বমানের এই সব স্কলারদের কথা অতি সাম্প্রতিক কাল পর্যন্তও দেশের মানুষ হয়তো জানতেনই না। এটা আমাদের ব্যর্থতা যে, আমরা তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারি নি, তাদের কাজে লাগাতে পারি নি এবং তাদেরকে সেই exposure দিতে পারিনি৪ যা পেলে তারা হয়তো যথাসম্ভব “বিকশিত” হতে পারতেন। সেজন্যই একজন একজন ইয়াসির কাজীকে নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস ফিচার লেখে, কিন্তু একজন ড. সাইফুল্লাহর নাম, বাংলাদেশের ৯০% পত্রিকাই হয়তো জানে না। তাছাড়া আমাদের মগজে ঔপনিবেশিক শক্তির গোলামীর সময় থেকে শুরু করে, ইংরেজী ভাষাভাষীদের ব্যাপারে যে শ্রদ্ধা, সমীহ ও প্রেম রয়েছে তার ফলে আমরা ধরেই নিই যে, ইংরেজী ভাষায় দেয়া ধর্মীয় লেকচারই উন্নততর হবার কথা। আমাদের ইংরেজী প্রেম এমনই যে, পৃথিবীর মানচিত্রে আমরাই সম্ভবত একমাত্র জাতি, যারা রেগে গেলে বিদেশী ভাষায় (ইংজৌ ভাষায়) গালি দেয়! আপনারা হয়তো দৈনন্দিন জীবনে দেখে থাকবেন যে. অতি সাধারণ কোন লোকও রেগে গিয়ে কাউকে “স্টুপিড” বা “ইডিয়ট” বলছেন! গোপাল ভাঁড়ের মাতৃভাষা সনাক্ত করার একটা “টেস্ট” ছিল, যাতে দেখা যায় যে, কাউকে হঠাৎ রাগান্বিত করতে পারলেই তার মুখ দিয়ে নিশ্চিতভাবেই মাতৃভাষা বেরিয়ে – আসবে গোপাল ভাঁড়ের ঐ “টেস্ট” একজন উড়িয়া ভাষাভাষির উপর সফল হলেও, বাঙ্গালীদের উপর নিশ্চিতই অকার্যকর প্রমাণিত হতো৫।
অনেক আগে একটা গল্পে পড়েছিলাম, জীবনের সাফল্য নিয়ে লেখক যা বলছিলেন তার সারমর্ম এমন: ক্রীড়াঙ্গনে যে সব দৌড় প্রতিযোগিতা হয়, সে সবের শুরুর লাইনটা একই হয়ে থাকে, সবাইকে একই দুরত্ব অতিক্রম করতে হয় তাতে কেউ ১ম, কেউ ২য় হন। কিন্তু জীবনের “দৌড়” সবাই এক লাইন থেকে শুরু করেন না। সুতরাং কোন সৌভাগ্যবানের চেয়ে ৫০ মিটার পেছনে থেকে দৌড় শুরু করে কোন হতভাগা যদি ১ম বা ২য় নাও হতে পারেন, তবু আমাদের মনে রাখতে হবে যে অন্যেরা যেখানে ১০০ মিটার অতিক্রম করেছেন, জীবনের “দৌড়”-এ ঐ কম সৌভাগ্যবান ব্যক্তিটিকে ১৫০ মিটার অতিক্রম করতে হয়েছে – সুতরাং, তিনি জীবনে কতটুকু এগিয়ে গেলেন বা “অগ্রসর” হলেন অথবা তার জীবনের অর্জন কতটুকু? সেই হিসাব কষতে গিয়ে ঐ বাড়তি ৫০ মিটার অবশ্যই ধর্তব্যে আনতে হবে!! আমাদের এই সব স্কলাররা জীবন শুরু করেছেন হয়তো নোয়াখালীর বা চৌদ্দগ্রামের কোন কওমী মাদ্রাসা থেকে, তারপর একসময় তারা, ইসলামী জ্ঞানের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানিত বিদ্যাপীঠ থেকে PhD করেছেন! আমি বলবো তাদের জীবনের সাফল্য অভাবনীয়!! অথচ, আমাদের দেশের বর্তমান এলিট এবং এলিট হবার স্বপ্নে বিভোর কিছু তরুণ-তরুণীরা এসব ‘আলেমদের কাছ থেকে জান অর্জন করতে অত্যন্ত reluctant! তারা বরং ৩/৪ হাজার টাকা খরচ করে এলিটদের সাথে গা ঘষতে ঘষতে কোন এয়ারকন্ডিশনড প্রেক্ষাগৃহে বসে আমদানীকৃত ব্র্যান্ডের ইসলাম উপভোগ করতে বেশী আগ্রহী। ক’দিন আগে একজন দ্বীনী ভাই আমাদের ই-মেইল গ্রুপে একটা ই-মেইলের মাধ্যমে জানতে চাইলেন, তার “টিন এজার” বোনদের জন্য এমন কোন দ্বীন শিক্ষার “হালাক্বা” আছে কিনা, যেখানে যেতে তারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। তার ই-মেইলটা ছিল এমন:
“…..Can anyone inform me about any halaqa of sisters around Dhanmondi-Kalabagan? I am looking for a place where i could send my younger sisters who are in their teens to learn the Deen of Allah. I am looking for halaqas where the speaker is quite young and the place has lots of youngsters.”
উত্তরে আমি বলেছিলাম:
“I was wondering at what age Prophet (SAW) started preaching? And what was his (SAW) age when people started flocking to him?? Should there be a sense of belonging when it comes to learning deen? Should we look for places where only people of our own “class” (be it a class by age, financial status or social belonging) gather?? Think over these points!”
আমরা একটু চিন্তা/গবেষণা করলেই জানতে পারতাম যে, আল্লাহর রাসূল (সা.) ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত পেয়েছিলেন এবং আরো ১০/১২ বছর পরে তাঁকে ঘিরে যে কম্যুনিটি গড়ে উঠেছিল, তাদের অধিকাংশই ছিলেন তরুণ/তরুণী। কই, তারা তো খোঁজ করেন নি কোথায় একই আর্থ-সামাজিক শ্রেণীর “তরুণ প্রাণের মেলা বসেছে, যেখানে গেলে তারা নিজেদের “অভ্যস্ত” পরিবেশে ইসলাম শিখতে পারবেন!!
বাংলাদেশ সত্যিই এক আজব দেশ। যখন প্রথম “মিনারেল ওয়াটার” বা “টিস্যু পেপারের” মত পণ্য বাজারজাত করা শুরু হয়, তখন অনেককেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন যে, নদীমাতৃক দেশ বলে পরিচিত যে দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে পানির আধিক্যে চরম দুর্ভোগ পোহায়, সেখানে পানি কিনে খাবে কে? তেমনি টিস্যুপেপারের বেলায়ও অনেকেই বলেছিলেন যে, পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র এদেশের অনেক মানুষই এখনো মাঠে-ঘাটে, নদীর পারে শৌচকর্ম সারে – এখানে টিস্যু-পেপার কিনবে কে? অন্তত টিস্যু- পেপারের শিল্প-কারখানা চালু রাখার মত ভোক্তা আসবে কোথা থেকে? কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে, তথাকথিত “মিনারেল ওয়াটার” বিক্রী করে বহু কোম্পানী তাদের আখের গুছিয়েছে এবং লাভের গন্ধ পেয়ে এদেশের “ব্যবসা-দৈত্যদের” প্রায় সবাই এখন নিজস্ব ব্র্যান্ডের “মিনারেল ওয়াটার” বাজারজাত করছে। “টিস্যু-পেপার” শিল্পের উত্থানের ব্যাপারও একইরকম অবাক করা। একইভাবে এত মাদ্রসা, মসজিদ, হেফাজত, ইজতেমা, জামাত, চরমোনাই, ফুরফুরা, রাফাদানি, আহলে হাদিস, কুতুববাগ, দেওয়ানবাগ, রাজারবাগ, আহলে সুন্নাত ইত্যাদির দেশ আমাদের এই দেশে যে আদৌ বিদেশ থেকে কোন ব্র্যান্ডের ইসলাম এসে জেঁকে বসতে পারে, তা কেউ হয়তো কল্পনাই করেন নি। এমনিতে কেউ ভাবতে পারেন যে, হিজবুত তাহরীর বা জামাতুল মুসলিমীন বা তাহিরুল কাদরীর অনুসারীরা তো তাদের আদর্শগত দিকগুলো বাইরের দেশ থেকেই নিয়েছেন৬। কিন্তু আমি যাদের কথা বলছি, এরা ঠিক কোন দল নন। আমেরিকা বা কানাডায় “মাগরিব ইনস্টিটিউটের” মত প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে বিভিন্ন কোর্স বা প্রশিক্ষণের আয়োজন করে, সেরকমই বিদেশ থেকে এসে, বিদেশের আদলে এখানে ইনস্টিটিউট, স্কুল, টিভি চ্যানেল ইত্যাদি খুলে দাওয়াতী কাজ চালানো হচ্ছে এদের মিশন ও ভিশন বলা – যায় Dawah Inc!
চট্টগ্রামে “আহলুস সুন্নাহ ওয়া আল-জামা’আ’র৭ অনুসারী একটা ছোট্ট কমউিনিটি আছে, আজ থেকে অনেকদিন আগে দ্বীনের পথে তাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল আমারই হাত ধরে – আলহামদুলিল্লাহ। তখন আমি মাসে ২/১ বার করে চট্টগ্রাম যেতাম “হালাকা”৮ করতে। পরবর্তীতে আমি আমাদের দেশের সেরা ‘আলেমদের কয়েকজনকে তাদের সাথে পরিচিত করে দিই – এবং তারাও সময় সময় ঐ কমউিনিটিতে “হালাকা” করতে যেতেন। সেখানে তারা একটা ছোট্ট দাওয়াতী সংস্থার মত গড়ে তোলেন যা দিনে দিনে বড় হয়েছে। একটা ধনী শিল্পপতির পরিবার মূলত ঐ সংস্থার কার্যক্রম চালান – এবং ঐ পরিবারের ছেলেদের সময় কম থাকাতে এবং মেয়েরা সত্যি সত্যি অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে দ্বীন শিখতে চাওয়াতে, এক পর্যায়ে দেখা গেলো মেয়েরাই বলতে গেলে সংস্থাটার কার্যক্রম চালান। তারা কুর’আন শুদ্ধভাবে শিখতে ওস্তাদ রেখেছেন, আরবী ভাষা শেখার চেষ্টা করছেন ইত্যাদি ইত্যাদি! যাহোক আনুমানিক ৫ বছর আগের কথা হবে, হঠাৎ ঐ কমিউনিটির এক “মুখপাত্রী” আমাকে ফোন করে বললেন যে, তারা ওস্তাদ আব্দুল হামিদকে৯ তাদের সংস্থায় নিয়োগ দিতে চান। আমি অনেক কষ্টে তাদের নিবৃত্ত করেছিলাম; তাদের বোঝালাম যে, তার মত এজন বিদেশীকে রাখতে হলে অনেক ঝামেলার সম্ভাবনা আছে। দারুল ইহসানের (সৌদী শিক্ষামন্ত্রী ড. ওমর নাসিফের মত) অনেক প্রভাবশালী বিদেশী পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাই তাদের জন্য অনুমতি ইত্যাদি যোগাড় করা সহজ ছিল তাদের আরো আরব (মিশরী) শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু তারা যদি চট্টগ্রামের একটা ছোট্ট সংস্থা থেকে তাকে রাখতে চান, তবে নিশ্চিতই তাদের অনেক ঝুট-ঝামেলা পোহাতে হবে এবং অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে! সে যাত্রায় তাদের নিবৃত্ত করা হলো। অথচ, বাংলাদেশের যাত্রাবাড়ীতে একটা মাদ্রাসায় যে সৌদী আরবে কুর’আন বিষয়ক পড়াশোনা করা – ১০ ক্বিরাতেই সনদ রয়েছে এমন একজন বিশেষজ্ঞ রয়েছেন (যিনি ওস্তাদ আব্দুল হামিদের চেয়ে অধিকতর যোগ্য হবারই কথা) এই সম্বন্ধে তারা যে জানতেন না, সে ব্যাপরে আমি একপ্রকার নিশ্চিত ঐ যে to stand out from the rests এবং বিদেশীদের উপর বেশী আস্থা থেকেই হয়তো তাদের মনে হয়েছে যে, সুদানী শিক্ষক রাখলে মন্দ হয় না! এর কয়েকদিন পরে সেখানকার “মুখপাত্রী” অপর এক তরুণী হঠাৎ করে আবার ফোন করে আমাকে বললেন যে, তারা বিলাল ফিলিন্সকে নিয়ে এসে চট্টগ্রামে প্রোগ্রাম করাতে চান – এ ব্যাপারে তারা আমার সহায়তা চান।। আমি বললাম: মুসলিমদের যে কোন কাজে কতটুকু benefit বা মঙ্গল রয়েছে, সেটা বিচার করা দরকার। আমাদের সম্পদ (অর্থ, সময়, শ্রম সবই) সীমিত – সেই সম্পদ অনেক ভেবে চিন্তে খরচ করা উচিত। ইংরেজী ভাষাভাষী বিলাল ফিলিপ্স নিঃসন্দেহে ইসলামী জ্ঞানে জ্ঞানী একজন ব্যক্তি১০ – কিন্তু তিনি এখানে এসে প্রোগ্রাম করলে, তার মুখ থেকে সরাসরি ইংরেজী লেকচার শুনে কয়জন মানুষ বুঝবেন? রেকর্ড করা ইংরেজী লেকচার না হয় একটা জায়গায় না বুঝলে, আবার পেছনে গিয়ে rewind করে শোনা যায়, কিন্তু সরাসরি শুনলে তো আর সেটার সুযোগ নেই। সুতরাং, যে পরিমাণ সময়, শ্রম ও অর্থ যাবে, সে তুলনয় অত্যন্ত নগন্য benefit আশা করা যায়। হ্যাঁ, আমরা কেবল বলতে পারবো যে, আমরা একজন আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ব্যক্তির লেকচার সরাসরি শুনেছি – ঐ পর্যন্তই। আমার কথাগুলোতে ঐ তরুণী পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারলেন না মনে হলে, আমি মাফ চাইলাম এবং তাকে পরামর্শ দিলাম যে, তার “ব্যবসা-দৈত্য” বাবাকে সভাপতি করে একটা কমিটি গঠন করতে পারেন চট্টগ্রামের গণ্য-মান্যদের নিয়ে – তারপর তারা প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করলেই হলো তবে আমি ঐ প্রক্রিয়ার মাঝে “নেই”। তাদের এও বলেছিলাম যে, মদীনা থেকে PhD করা আমাদের এখানকার ‘আলেমরা একদিকে যেমন বিলাল ফিলিন্সের চেয়ে অধিকতর শিক্ষগত যোগ্যতা সম্পন্ন (তারা হযতো বিলাল ফিলিপ্সের মত অতটা flourish করেন নি (সেটা আমি আগেই ব্যাখ্যা করেছি), তেমনি তারা অনেক বেশী benefecial হতেন – কেননা তারা (এলিটদের না হলেও) আমাদের (আম জনতাদের) জীবনের সুখ, দুঃখ, হাসি কান্না, অভাব, আবেগ ও আমাদের নাড়ীর স্পন্দনের সাথে বিলাল ফিলিপ্স, ইয়াসির কাজীর চেয়ে অনেক বেশী পরিচিত! তাছাড়া আমাদের এই গরীব দেশের মুসলিমদের, তথা গোটা মুসলিম উম্মাহর সীমিত সম্পদের (যথা: অর্থ, সময় ও শ্রমের) অনেক সাশ্রয় হতো!
যাহোক, বিদেশী স্কলারদের নিয়ে এসে, বিদেশের মত করে ইংরেজীতে লেকচার শুনে নিজেদের বিশেষায়িত করার এলিট খোয়ায়েশ, তখন পূরণ না হলেও এখন পূরণ হচ্ছে বা হবার পথে। আগে যেমন বলেছি, অপেক্ষাকৃত শুদ্ধতর ইসলামের দাওয়াত দেয়া বিদেশে জন্ম নেয়া অন্তত তিনটি ব্র্যান্ডের ইসলাম এখানে বাজারজাত করার চেষ্টা চলছে এবং সেই মিনারেল ওয়াটার বা টিস্যু পেপারের মতই, এই হতভাগ্য দেশে সেসবের বেশ সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত রয়েছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। আমি, অত্যন্ত ছা-পোষা কেরাণী শ্রেণীর মানুষের ছেলেদেরও দেখেছি, ৩৫০০ টাকা দিয়ে, এলিটদের সাথে গা ঘষে, এক দিনের একটা প্রোগ্রাম দেখে শুনে এসে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে। ইংরেজীতে ছাপানো ঐ আয়োজনের course material গর্ব ভরে প্রদর্শন করতে। অথচ এদের অনেকেই শুদ্ধভাবে একছত্র ইংরেজি বলতে পারবে বলে আমার মনে হয় না এবং এদের অনেককেই প্রতি সপ্তাহে মদীনা থেকে PhD করা আমাদের এখানকার ‘আলেমরা যে “হালাকা” করেন (যাতে কোন প্রবেশ মূল্য নেই এবং যা সকলের জন্য উন্মুক্ত), তাতে কখনো উঁকি মারতেও দেখিনি!
এদের একটা ব্র্যান্ডের আগমন প্রক্রিয়া কিছুটা আমার চোখের সামনেই ঘটেছে। অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক আমাদের এক দ্বীনী বোন, যিনি এককালে আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন, এখন তার স্বামীর চাকুরীর সুবাদে মালোয়েশিয়ায় থাকেন -তিনি এক শায়েখ সম্বন্ধে বেশ ক’বছর আগে আমাকে বলেছিলেন এবং তার লেকচারের একটা ডিভিডি আমাকে উপহার দিয়ে বলেছিলেন যে, আমরা চাইলে ঐ শায়েখ এ দেশে এসে অনুষ্ঠান করবেন। আমি এর আগে আপনাদের যেমন বলেছি – বিদেশী ভাষায় লেকচার দেয়া বিদেশী শায়েখদের ব্যাপারে আমার দৃষ্টিভঙ্গী তার কাছে তুলে ধরলে তিনি আর কিছু বলেন নি। শায়েখের মূল বাড়ী আমাদের দেশে হলেও তিনি আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব- বিদেশে বড় হয়েছেন। এক সময় অস্ট্রেলিয়ায় তার আস্তানা ছিল বলে, অনেকেই তাকে অস্ট্রেলিয়ান বলে জানেন। বাংলাদেশের বাইরে তিনি একজন বিতর্কিত ব্যক্তি এবং তার পক্ষে বিপক্ষে নানারকম কথা রয়েছে। আজ থেকে বছর দুইয়েক বা তারো কিছু বেশী সময় আগে ঐ দ্বীনী বোনটি দেশে আসার আগেই, আমার সাথে একটা মিটিং-এ বসবেন এমন একটা আভাস দিলেন – দেশে এসে মিটিং-এর দিনক্ষণ ঠিক করলেন – আমার খুব নিকট আত্মীয়ের বাসায় মিটিং হবে ঠিক হলো। ঐ মহিলা আমাকে অনুরোধ করেছিলেন সাথে করে দুইজন আলেমকে নিয়ে আসতে। আমি তার কথামত দেশের শীর্ষ দুইজন ‘আলেমকে নিয়ে সেখানে পৌঁছালাম। তিনি তার সাথে করে আরো কয়েকজন ইসলামপ্রেমী ও ইসলামসেবী নিয়ে আসলেন – যাদের কাউকে কাউকে আমি আগে থেকেই চিনি; যারা সমাজের উচ্চতম শ্রেণীভূক্ত এবং যাদের প্রায় কেউই স্বাভাবিক বাংলায় কথা বলতেও জানেন না। কথাবার্তায় বোঝা গেল তারা “বাংলাদেশ উৎসের” ঐ ভিনদেশী শায়েখকে দিয়ে এখানে প্রোগ্রাম করাতে চান কোন রাখঢাক ছাড়াই বললেন যে, তাদের টার্গেট গ্রুপ হচ্ছেন: এখানকার the rich, the elite, the educated and the young। আমি বুঝলাম, আমি এতক্ষণ গুলশান, বনানী বা বারিধারার যে “নও মুসলিম” প্রজন্মের গল্প আপনাদের শুনালাম, তারা ও তাদের চাল-চলনে মুগ্ধ হয়ে তাদের মত হতে চাওয়া কিছু “কি হনু রে” বোধ সম্পন্ন মানুষকেই তারা মূলত দলে টানতে চান। আমি প্রথমেই benefit-এর (বা মাসলাহাতের) দৃষ্টিকোণ থেকে আপত্তি জানালাম, ঠিক যেমন উপরে, বিলাল ফিলিন্সকে এ দেশে নিয়ে এসে বক্তৃতা দেওয়ানোর ব্যাপারে আমার দ্বিমত পোষণের কথা আপনাদের ব্যাখ্যা করেছি, তেমনই! এর সাথে আপত্তির আরেকটা বাড়তি কারণ ছিল – একটা বিশেষ শ্রেণীকে টার্গেট করে, (আগে যেমন বলেছি, মূলত চুরি, আত্মসাৎ বা দুর্নীতির মাধ্যমে যারা অঢেল পয়সার মালিক হয়ে থাকেন, সেই সব) পয়সা ওয়ালাদের টার্গেট করে, তথাকথিত এলিটদের টার্গেট করে একটা cultish দাওয়াতের প্রচেষ্টাকে আমার কাছে রীতিমত দুরভিসন্ধিমূলক মনে হয়েছে।
আমরা জানি নবুওতের প্রাথমিক পর্যায়ে, একটা বিশেষ শ্রেণীকে দাওয়াত দিতে গিয়ে, সাধারণ একজন মানুষকে সামান্য পাশ কাটিয়ে যেতে চাওয়াতে, স্বয়ং রাসূল (সা.)-কে আল্লাহ কুর’আনের সূরা আবাসাতে (৭৯ নম্বর সুরাতে) তিরস্কার করেছেন। তারপরে আমরা খেয়াল করলে দেখবো যে, রাসূল (সা.)-এঁর দাওয়াতে সাড়া দিয়ে অর্থবিত্তহীনরাই বরং তার কাজে, তার মিশনে বেশী বেশী সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। আর উসমান (রা.) বা মুস’আব (রা.)-এর মত যে ২/১ জন ঐশ্বর্যশালী এলিট পরিবারের মানুষ এসে, (মদীনাপূর্বক) রাসূল (সা.)- এঁর মিশনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন, তারাও তাদের অতীত পেছনে ফেলে এসেছিলেন। মক্কার তৎকালীন এলিটরাই বরং (তাদের মতে) চাল-চুলাবিহীন মুহাম্মদ (সা.)-কে আল্লাহ কর্তৃক নবুওত প্রদানের ব্যাপারটাকে অসঙ্গত মনে করছিলেন। তাদের ভাবটা ছিল এমন যে, নবুওত তাদের মত এলিটদের মাঝে কাউকে প্রদান করলেই তা মানানসই হতো। আমরা আরও দেখবো যে, ইসলাম বরং অর্থ-বিত্তভিত্তিক আভিজাত্যের “মেজাজ” কে ভেঙ্গে দিতে চেয়েছে। আমরা তাই দেখি, অনেকের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও রাসূল (সা.) তাঁর প্রাক্তন ক্রীতদাসের হাতে যুদ্ধের সেনাপতির পতাকা অর্পণ করেন। পরবর্তীতে, আবারো অনেকের আপত্তি উপেক্ষা করে ঐ প্রাক্তন ক্রীতদাসের টিনএজার ছেলে, উসামা বিন যায়েদের অধীনে উমর (রা.) বা আলী (রা.)-এর মত সাহাবীদের যুদ্ধে যেতে আদেশ করেছিলেন! এসব শিক্ষাকে কেবল তাক-বন্ধ বইয়ের পাতায় বন্দী রেখে, আমরা যদি এভাবে অর্থ-বিত্তের শ্রেণীভিত্তিক একটা ইসলামী cult তৈরী করি, তবে তা কোন ব্যাপক ফলাফল বয়ে আনবে না বরং ইসলামের অপেক্ষাকৃত শুদ্ধ পথে অনুশীলনরত যে স্বল্পসংখ্যক মুসলিম, স্রোতের বিপরীতে চলার প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছেন, তারা corrupt হবেন, দুনিয়ার চাকচিক্যের প্রতি তাদের আসক্তি বাড়বে, তাদের ভিতর শ্রেণীবিভেদ প্রকট হয়ে উঠবে – “জামা’আ”-র বদলে “ফারাকা” সৃষ্টি হবে – এসব বিষয় তাদের আমি বোঝাতে চেষ্টা করলাম। আমি আবারো, আমাদের “দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া” বিশ্বমানের স্কলারদের ব্যবহার করে, আমাদের দেশের মানুষের নাড়ীর স্পন্দন অনুযায়ী, আমাদের তথা মুসলিম উম্মাহর সীমিত সম্পদের (যার মাঝে তারা যে বিশাল ব্যয়ভার বহন করে বিদেশী স্টাইলের প্রোগ্রাম করতে চাচ্ছেন তাও অন্তর্ভুক্ত) সর্বোচ্চ এবং সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহার করে, এদেশের গণমানুষের কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেবার একটা সংঘবদ্ধ
চেষ্টা যে করতে পারি – তাও তাদের বোঝাতে চেষ্টা করলাম! কিন্তু সম্পূর্ণ বা আংশিক বিদেশে পাড়ি জমানো মানুষগুলো – দেশকে একধরনের “শৌচাগার”সম জ্ঞান করা সত্ত্বেও, না পারতে শোষণের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এদেশে রয়ে যাওয়া এবং নিউ ইয়র্ক, সিডনী বা কুয়ালালামপুরে ছেলে/মেয়ে পড়ানো এলিটগোত্রীয় লোকেরা, আমার মত অতি সাধারণ একজন মানুষের কথাকে তেমন একটা আমল দিলেন বলে মনে হলো না। আমার সাথে মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে PhD করা যে দু’জন ‘আলেম সেখানে ছিলেন, তাদের একজন তৎক্ষণাৎ আমার সাথে একমত হয়ে, এসব elitist ইসলামের কাছ থেকে কোন সুফল লাভের সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিলেন। অপরজন অত্যন্ত ভদ্র বিধায়, সরাসরি কিছু বললেন না। বললেন, তারা প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করলে তিনি দর্শক হিসাবে যেতে চেষ্টা করবেন। এলিটরা তাদের প্রচেষ্টার পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে বললেন যে, এলিটদের কি দ্বীন শেখার অধিকার নেই? আমি বললাম: আছে, থাকবে না কেন? আপনারা যে স্কলারকে নিয়ে এসে এখানে অনুষ্ঠান করতে চাচ্ছেন তার প্রোগ্রাম তো টরেন্টো, সিডনী বা কুয়ালালামপুরে আপনারা দেখেছেনই! এখানেও যদি কোন পাঁচতারা স্কলারকে এনে আপনারা, আপনাদের নিজ ভুবনে থেকে তার কাছ থেকে দ্বীন শিখতে চাইতেন, তবে আমার কোন আপত্তি থাকতো না। আমার আপত্তি এইজন্য যে, আপনারা ঐ ধরনের লোকদের ডেকে নিয়ে এসে, মোবাইল ফোন, টিস্যু পেপার বা মিনারেল ওয়াটারের মত অভিনব পণ্যের সম্ভাবনাময় বাজার খোলার মত করেই, একটা নতুন ব্র্যান্ডের ইসলাম এখানে বাজারজাত করতে চাচ্ছেন – যা কেবল বর্তমান এলিটদের ভিতর সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং যেন-তেনভাবে এলিট হতে চাওয়া মধ্যবিত্তের বস্তুবাদী সন্তানদের ভিতর ছড়াবে এবং এখানে একটা “বিলাসী মুসলিম শ্রেণী” তৈরী হবে, যারা সাধারণ মুসলিমদের জন্য সম্ভাব্য সব কিছুই করতে হয়তো প্রস্তুত থাকবে, কেবল তাদেরই একজন হওয়া ছাড়া! এই প্রসঙ্গে আমার সব সময় Reader’s Digest- এ পড়া একটা কোটেশন মনে পড়ে: “A labor leader is one who would do anything for the laborer, except becoming one of them”
তারা আরেকটা যুক্তি দেখালেন যে, আগামী দিনগুলোতে এদেশের বা সমাজের যারা নেতৃত্ব দেবেন, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া সেইসব “এলিট সন্তানদের” টার্গেট করতে চান তারা। এখানেও আমি দ্বিমত পোষণ করলাম। আমাদের দেশে যারা মেধাবী ছিলেন/রয়েছেন, তাদের প্রায় সবাই১১ মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকেই এসছেন এবং ভীষণ প্রতিযোগিতার সমুদ্র পার হয়ে তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিজেদের স্থান করে নেন! কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, ইংলিশ মিডিয়িাম স্কুলে, কলেজে বা ব্যক্তি-মালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণত পড়েন প্রতিযোগিতায় বাদ পড়া বিত্তবানদের অতি সাধারণ “ঘিলু”-র সন্তানেরা – মেধার ঘাটতিটা তারা পয়সা দিয়ে পূরণ করে নেন। বলা যায়, উপরে ওঠার সিঁড়ি তারা তাদের ঐশ্বর্য্য বলে “কিনে” নেন! এত ঐশ্বর্য্য কোথা থেকে আসে? সদ্য খুন হওয়া পুলিশ কর্মকর্তার মেয়ে ঐশীর ঐশ্বর্য্য যেখান থেকে আসতো, এসব ঐশ্বর্য্যও সাধারণত সেখান থেকেই আসে। যাহেক, ভুল-শুদ্ধের বিতর্কে না গিয়েও আমরা আমাদের দেশের দিকে তাকিয়েই বলতে পারি যে, এদেশের ইতিহাসে যারা সবচেয়ে বেশী প্রভাব ফেলেছেন: শেখ মুজিব, জিয়াউর রহমান, ডক্টর ইউনুস প্রমুখ – এরা সবাই মধ্যবিত্ত বা সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতেন/করেন; তাঁরা “এলিট” ছিলেন না তবে নিয়তির করুণ পরিহাসের পরিণতিতে, তাদের বংশধরেরা হয়তো পরবর্তীতে এলিট বনে গেছেন। আমাদের দেশে “এলিট সন্তানদের” মাঝ থেকে নেতৃত্ব আসবে, এই অনুমান তখনই গুরুত্ব পাবে, যখন আপনি ধরেই নেবেন যে, লুটপাট, স্বজনপ্রীতি, চুরি, ঘুষ ও রাজনৈতিক তস্করবৃত্তির চলমান ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে – আর তাই চলমান এই ব্যবস্থায় আপনার “ইয়াক্বিন” বা “আস্থা” থেকেই আপনি “যে ঘোড়া জিতবে তার পক্ষেই বাজি ধরবেন” – অর্থাৎ, আপনার বিশ্বাস যেখানে আপনি সেখানেই invest করবেন- দাওয়াত দেবেন – সময়, সম্পদ, শ্রম সেখানেই ব্যয় করবেন। নাউযুবিল্লাহ একজন মুসলিমের এমন কি দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করা উচিত নয় যে, তাদের নেতা হবেন শেয়ার বাজার প্রতারণার মাধ্যমে গণমানুষকে সর্বস্বান্ত করা কোন এলিট পরিবারের দুলাল – অথবা দেশের এক নম্বর ভূমিদস্যু এলিট পরবিারের উত্তরাধিকারী তরুণটি। ইসলামের ইতিহাস পড়লে আমরা জানি যে, এলিটদের “আনা খাইরুম মিন হু”- এই বোধ থেকে ক্ষমতা ও ঐশ্বর্যের লোভে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়েই ইসলামের স্বর্ণযুগের অবসান ঘটে – খেলাফতের পরিবর্তে কার্যত রাজতন্ত্র বা পরিবারতন্ত্রের সূচনা ঘটে এভাবেই। রাসূল (সা.)-এর নবুয়ত লাভের সময়টাতে মক্কার statelet-এর কর্তৃত্বে ছিলেন “বানু উমাইয়া’র এলিটরা। তখন দুর্বল হয়ে যাওয়া প্রায় নিষ্প্রভ “বানু হাশিম” আব্যর প্রভাবশালী হয়ে উঠবে, এটা তারা মানতে পারেন নি। আবু সুফিয়ান (রা.)-এঁর, মুসলিম হবার আগের জীবনে, প্রাথমিকভাবে নবুয়ত বিরোধিতার এটা ছিল একটা প্রধান কারণ। সারা আরবভূমি যখন আত্মসমর্পণ করলো, তখন মক্কার এলিটদেরও রাসূল (সা.)-কে না মেনে উপায় ছিলো না। মক্কা বিজয়ের সময় আবু সুফিয়ান (রা.) নিজে ইসলাম গ্রহণ
করেন এবং পরবর্তীতে তাঁর গোটা পরবিারই ইসলামের খেদমতে আত্মনিয়োগ করেন সত্যি, তবে “বানু উমাইয়া” তাদের কর্তৃত্ব হারানোটা মেনে নিতে পারে নি। এরই পথ ধরে তারা উসমান (রা.)-এর খেলাফতের সময় থেকে অর্থ, বিত্ত ও ক্ষমতা হাসিলের জন্য আবার উঠে পড়ে লাগেন। শেষ পর্যন্ত “বানু উমাইয়া’র এলিটত্ব আর বিলাসিতা-প্রেমের পথ ধরেই কৃচ্ছতা krichchota অবলম্বনকারী ইসলামের স্বর্ণযুগের অবসান ঘটে এবং বিলাসী রাজতন্ত্র তথা পরিবারতন্ত্রের সূচনা হয়১২।
আমি দেশের কোন কর্ণধার বা ক্ষমতাধর ব্যাক্তি নই যে, তাদের নীতি-নির্ধারণ করে দেব। তবু, তারা যেহেতু তাদের কর্মকান্ডে আমার/আমাদের একধরনের সহযোগিতা চাইছেন, সেজন্য একাডেমিক আলোচনার অংশ হিসেবে কথাগুলো উঠে আসছিল। বোঝা গেল যে, তারা তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবেনই। আর করবেনই না কেন? তাদের সাথে রয়েছেন দেশের হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক সব এলিটেরা। আমি বললাম যদি অবসর ও অবকাশ থাকে, তবে তাদের আয়োজনে (প্রথম প্রোগ্রামে) থাকার চেষ্টা করবো। এরপর অনেক জল গড়িয়েছে – অনেক কথা কচলানো হয়েছে। কিছুটা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও, তাদের প্রথম প্রোগ্রামে (বা কোন প্রোগ্রামেই) আর যাওয়া হয় নি। ঐ গোষ্ঠীর আয়োজন শুধু ওখানেই থেমে থাকে নি। তাদের এখন এদেশে ইনস্টিটিউট, স্কুল, অফিস সবই রয়েছে – (তাদের ভাষ্য অনুযায়ীই English Speaking Muslimsদের প্রয়োজন মেটাতে গঠিত) ঐ সংস্থার Chairman তথা CEO, বাংলাদেশ উৎসের ঐ বিদেশী স্কলার, প্রাথমিক সাফল্যের পরে ফেসবুকে তার পাতায় অত্যন্ত গর্ব করে বলেছেন যে, বাংলাদেশের এলিটদের তিনি তার আস্থায় আনতে পেরেছেন। আর তার প্রমাণ আমি নিজেই পেয়েছি! “খাস” মানুষদের সাথে আয়োজিত মিটিং-এ, এদেশের শিল্পপতিদের কাছে তিনি এখানে একটা টেলিভিশন চ্যানেল খোলার ব্যাপারে অর্থ চেয়েছেন। মিনারেল ওয়াটার বা টিস্যু পেপারের মতই অভাবনীয় ও অকল্পনীয় তাদের সাফল্য। এদশের শীর্ষ ধনীদের আনুকূল্যে, তাদের সন্তানদের দলে টেনে একের পর এক অনুষ্ঠান হয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হল রুমে, নামকরা বাবুর্চির “লাঞ্চ” সমেত – সাথে ব্রাদার্স ও সিস্টার্সদের ইসলামী “চিট-চ্যাট” ফ্রি। এসব আয়োজনের সূত্র ধরে অন্তত দুইটা ইসলামী প্রেমের অঘটনের ঘটনা আমিই জানি। ওসব আয়োজনে উপস্থিত না থেকেও, আমার সীমিত সামর্থে বা যোগ্যতায়, সমস্যা জর্জরিত তরুণ-তরুণীদের মুরুব্বীদের সূত্রে এটুকু জেনেছি – তারা সমস্যা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমাকে এটুকু জানিয়েছেন! বাদ- বাকী আল্লাহই জানেন! আগে যেমন বলেছি, শুধু এলিটরাই এখানে যান নি – এলিট হতে চাওয়া আমার আশেপাশের আমারই মত “ফকিরনীর পুত”রাও এসব প্রোগ্রামে গিয়েছেন, ৩৫০০/৪৫০০ টাকা খরচ করে একদিনের প্রোগ্রামে দ্বীন শিখতে। তাদেরই আয়োজনে, এবার প্রথমবারের মত পশ্চিমা কাফিরদের অনুকরণে Ramadaan Festival বা “রমাদান উৎসব” পালিত হলো রমাদানের ঠিক আগে আগে। আমরা সবাই বলি/জানি যে, রাসূল (সা.)-এঁর সহীহ হাদীস অনুযায়ী, ইসলামের বার্ষিক উৎসব মাত্র ২টি: ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। আর জুমুয়াহর দিন বা শুক্রবারকে তিনি সাপ্তাহিক উৎসব বলে উল্লেখ করেছেন। তাহলে, এই “রমাদান উৎসব” এলো কোথা থেকে? [“ফেস্টিভাল সিসন, কার্নিভাল” এসব থেকে নিশ্চয়ই!] শুধু তাই নয়, সে উপলক্ষে “জিহ্বায় জল আসা খাবার”, হিজাব/নেকাব আর “ইসলামী টি-সার্ট” বিক্রীর ব্যবস্থা রেখে “মীনা বাজার”-এর আয়োজন করা হয়েছিল একই সাথে! আমরা এই শহরে যারা বড় হয়েছি, পাকিস্তান আমল থেকে এ পর্যন্ত “মীনা বাজার” বলতে একটা বিশেষ ধরনের মেলা বুঝেছি। কেনাকাটার ছলে, সাধারণত স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী মূল্যে পণ্য কিনতে গিয়ে, মূলত “ফাউ” হিসেবে পরনারী ও পরপুরষের মাঝে “হাস্যরসরঙ” ছিল/হচ্ছে এসবের প্রধান আকর্ষণ। প্রায়ই দেখা যেত কোন মহিলা সমিতি বা কোন বাহিনীর স্ত্রীদের ক্লাব কর্তৃক এসব “মীনাবাজারের” আয়োজন করা হতো (বা এখনো তাই হয়), যাতে স্টলগুলো চালাতেন “মুক্তমনা” মেয়েরা। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে এসব “মিলনমেলা”র আয়োজন একবোরেই পরিত্যাজ্য১৩! সহীহ হাদীসের ভাষায়: সম্ভাব্য সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্থান হচ্ছে বাজার। আর সেখানে এই ধরনের বিশেষ ইঙ্গিতবহ বিশেষ বাজারের আয়োজন যে আরো সতর্কতার দাবী রাখে, তা বলাই বাহুল্য! তাছাড়া রমাদান থেকে কি আমরা কি ভোগ-বিলাসতিার শিক্ষা পাই? না কি রমাদান আমাদের কৃচ্ছতার, কষ্ট-সহিষ্ণুতার ও ত্যাগের শিক্ষা দেয়?? ঢাকার বিলাসবহুল এলাকার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলে রমাদানের ঠিক আগের একটি সন্ধ্যায় যখন ঐ “মীনাবাজারে” “mouth watering food”-এর যোগাড়যন্ত্র চলছিল, তখনই বোধকরি মৌচাক, গ্রীনরোড, প্রগতিসরণী ইত্যাদি অনেক জনবহুল এলাকায় অগণিত গৃহহীন পরিবারেরা অপেক্ষায় ছিলেন, কখন দোকানপাটগুলো বন্ধ হবে আর সে সবের বারান্দায় তারা ঐ রাতের জন্য তাদের “সংসার পাতবেন”। নিয়তির কি করুণ পরিহাস যে, এই ব্যাপারগুলো ফরহাদ মাজহারের মত কম্যুনিস্টরা বুঝলেও, আমরা মুসলিমরা বুঝি না – এলিটরা তো নয়ই, আমাদের মত “ফকিরনীর পুত”রা অথবা এমনকি আমাদের আলেমরাও বোঝেন না! আমি শুনলাম: একজন যুক্তি দেখিয়েছেন যে, “লাক্স-চ্যানেল-আই” খ্যাত কোন মডেল কন্যা নাকি সদ্য ইসলামের পথে এসছেন – তো এই ধরনের মানুষদের জন্যও তো একটা প্ল্যাটফর্ম দরকার! সুবহানাল্লাহ!! কি চমৎকার যুক্তি!!! প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, Ramadaan Festival-এর ঐ আয়োজনে তারা মীনাবাজারের পাশাপাশি টিকিটের বিনিময়ে ‘আলেমদের বক্তব্য শোনার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আয়োজনও করেছিলেন এবং তাতে আমাদের দেশের দু’জন প্রখ্যাত সরলপ্রাণ ‘আলেমও গিয়েছিলেন। সরলপ্রাণ এজন্য বলছি যে, তারা আমাদের মত ক্রিটিক্যাল বা বক্রদৃষ্টিতে সবকিছু দেখেন না – সন্দেহজনক উৎসের ও পরিণতির সবকিছুকে সন্দেহের চোখে দেখার “dirty job”টা তারা আমাদের মত হতভাগাদের জন্য তুলে রাখেন। দুর্জনেরা অনেকেই আলেমদের দিকে আঙ্গুল তুলে অভিযোগ করেন: “ডাকলেই তাঁদের সব জায়গায় যেতে হবে?” – এমন প্রশ্ন তোলেন। আমি যা বুঝি, তারা যে কোন অবস্থায়ই কথা বলার সুযোগটাকে একটা ইতিবাচক ব্যাপার বলে দেখেন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়তো তাদের এই মনোভাবটা ইতিবাচকও বটে! কিন্তু কখনো দেখা যায়, তাদের উপস্থিতিটাই কোন স্বার্থান্বেষী মহলের জন্য বা কোন ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গীর কর্মকান্ডের জন্য বৈধতার দলিল হয়ে যায়। ঐ দু’জন ‘আলেমকেই ডেস্টিনির তথা বৈশাখী টিভির আয়োজকরা নিয়ে গিয়ে প্রোগ্রাম করিয়েছিলেন এবং পরে এমনভাবে “ডেস্টিনি” কার্যক্রমের গুণগান গাইতে, তাদের ঐ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের ছবিকে ব্যবহার করা হতো যে, সাধারণ দর্শক মনে করবেন যে, তারা হয়তো ডেস্টিনির কর্মকান্ড তথা মাল্টিলেভেল মার্কেটিংকেই “অনুমোদন করেন। ব্যাপারটা টের পেয়ে আমি তাদের প্রতিবাদ করতেও দেখেছি!
যাহোক, যে কথা বলছিলাম, রাসূল (সা.)-এঁর মত, সাধারণ মানুষদের একজন হতে না পারলে এসব “এয়ার কন্ডিশন্ড ইসলাম দিয়ে সমাজে কোন পরিবর্তন আসবে না! ইসলামের নামে কিছু দৌড়-ঝাঁপ করে বা “ইসলাম-ইসলাম” খেলায় নিজেদের ব্যস্ত রেখে তৃপ্তির ঢেকুর তুললেও, তাতে ইসলামের সত্যিকার কোন অগ্রগতি হবার সম্ভাবনা নেই! প্রসঙ্গত দু’টো ব্যাপার মনে পড়লো। প্রথমটি হচ্ছে মাত্র যে ব্র্যান্ডের ইসলামের গল্প আপনাদের শোনালাম, তাদের প্রসঙ্গে। এদেরই একটা “প্রোজেক্ট” হচ্ছে সারা বিশ্বের মুসলিমদের কাছ থেকে শতকোটি ডলার সংগ্রহ করে ইন্দোনেশিয়ার “মরিয়ম” নামের একটি মেয়েকে বাঁচাবেন বলে টেলিভিশন সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা। তাদের প্রকল্প বাস্তবায়নে তারা “মরিয়ম বাঁচাও” বলে একটা আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন এবং অন্য দেশের মত এদেশেও সেটাকে সচল করার চেষ্টা করছেন। “মরিয়ম বাঁচাও” সারমর্মের একটা স্বল্পদৈর্ঘ্য ভিডিও বানিয়েছেন তারা। “মরিয়ম” আসলে একটা কাল্পনিক চরিত্র, ইন্দোনেশিয়ার দরিদ্র পরিবারের মেয়ে! পরিবারের অভাব অনটন আর অশান্তি থেকে পালিয়ে বাঁচতে মেয়েটি খৃষ্টানদের পাতা- দয়া, দান-দক্ষিণা, স্নেহ ও সহমর্মিতার ফাঁদে পা দেয় এবং শেষ পর্যন্ত খৃষ্টান হবার সিদ্ধান্ত নেয়। জনবহুল ইন্দোনেশিয়ায়, নিম্নবিত্ত এরকম বহু তরুণ-তরুণী খৃষ্টান হয়ে যায় – যাদের বাঁচাতে, খৃষ্টানদের proselityzing প্রচারণা রুখতে, টেলিভিশন চ্যানেল খোলা দরকার বলে তারা মনে করেন। তাই তারা “Fund Raising” করছেন। আপাত দৃষ্টিতে বলার কিছু নাই। তবে আমাদের দেশের এলিটরা এবং এলিট হতে চাওয়া “কি হনু রে” শ্রেণীর কিছু মধ্যবিত্তের সন্তানরা যেভাবে ব্যাপারটা নিয়ে লম্ফ-ঝম্ফ করে থাকেন এবং দূরবীণ চোখে সুদূর ইন্দোনেশিয়ার জনৈকা মরিয়মকে খুঁজে দেখার চেষ্টা করেন, একটু ভাবলেই বোঝা যাবে যে, তা একেবারেই “জীবন-বিচ্ছিন্ন” একটা সস্তা আবেগের ফসল। আমাদের দেশে ফুটপাতে ঘুমানো লক্ষ-কোটি “মরয়িম”কে এরা কখনো “চক্ষু মেলিয়া” দেখেনে নি! আমাদের দেশের বোয়ালমারী, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, ঝিনাইদহ, কালিগঞ্জ ইত্যাদি প্রত্যন্ত অঞ্চলে কত লক্ষ-কোটি হতদরিদ্র ক্ষুধার্ত মুসলিম এবং তাদের “মরিয়মেরা” যে প্রতিদিন, [মূলত দু’মুঠো অন্নের অভাবেই] “ঈসায়ী [মুসলিম??!!] জামাত”-এর মত নেকড়েদের শিকারে পরিণত হচ্ছেন – তা দেখার অবকাশ তাদের হয়নি১৪। বনানী-বসুন্ধরার “certificate oulet” সমূহের “air conditioned” ক্লাসরুমে বসে ক্যরিয়ার গঠন করতে করতে (অথবা করাতে করাতে) আর প্যালেস্টাইন, সোমালিয়াসহ বিশ্ব-মুসলিমদের দুর্গতি নিয়ে ভাবতে ভাবতে, তাদের সেদিকে তাকিয়ে দেখার অবকাশই হয় নি। তারা তাই ইন্দোনেশিয়ার “মরিয়মের” দুঃখ-কষ্টে বিষন্ন ও অস্থির। তাদের দুঃখ-কষ্ট সহমর্মিতা এসবও যেন কেবলই বিদেশী মুসলিমদের জন্য লেখাপড়া বা ভাষার মতই এক্ষেত্রেও তাদের অন্তরে এদেশের প্রতি কোন sense of belonging তৈরী হয়নি – লেখাপড়া করতে গিয়ে তারা যেমন এ/ও লেভেল বেছে নেন, ভাষা বেছে নিতে গিয়ে যেমন তারা ইংরেজী বেছে নেন, তেমনি তাদের compassion যেন কেবলই ভিনদেশী মুসলিমদের জন্য, বা আরো সহজে বলা যেত “মিডিয়ার খবর” মুসলিমদের জন্য। আমাকে কতবার কতজন ই-মেইলে জিজ্ঞেস করেছেন প্যালেস্টাইন, সোমালিয়া বা সিরিয়ায় কি করে দুস্থ মুসলিমদের জন্য টাকা পাঠানো যায়? অথচ, এদের কেউ কখনো এমন প্রশ্ন করেন নি যে, কি কারণে নীলফামারীর জলঢাকার সাড়ে তিনশত
পরিবারের একটা গোটা “ক্ষুধার্ত” গ্রাম মিশনারীদের ফাঁদে পা দিয়ে খৃষ্টান হয়ে গেল – আর, যাদের আমরা অনেকেই বিদ’আতী মনে করে সমালোচনা করে থাকি, সেই তবলীগ জামাতের লোকেরা, তারা, কি করে আবার তাদের সবাইকে ইসলামে ফিরিয়ে নিয়ে আসলো। এই অবিচার, অস্বাভাবিকতা বা এই anomaly-র কারণ খুঁজতে গিয়ে বুঝেছি, যে আমাদের দেশের এলিটরা এবং এলিট হতে চাওয়া “কি হনু রে” শ্রেণীর মধ্যবিত্তের সন্তানেরা তো আসলে বাস্তব জগতের বাসিন্দা নন – তারা আক্ষরিক অর্থেই virtual জগতের বাসিন্দা। নিজ পড়ার টেবিলে বসে মাউসের একটা ক্লিকে এসব “ডট.কম” মুসলিমেরা “রঙিন” পর্দা থেকে ইন্দোনেশিয়ার “মরিয়ম বাঁচাও আন্দেলনের কথা জানেন ভিডিও ক্লিপ থেকে, অথচ, ঢাকার রাস্তার ফুটপাতে পলিথিনের ছাউনির নীচে একটা গোটা জীবন কাটিয়ে দেয়া হুরমতি বা ফেলানীদের পরিবারের কথা ভাববার অবকাশ তাদের হয় না – এসব মানবেতর জীবনের বাস্তব “বিবর্ণ” বা “সাদাকালো” চিত্র তাদের চিত্তকে আকর্ষণ করতে পারে না। Virtual sex, virtual world, virtual relation, virtual marriage, virtual jihad, virtual fighting (video game) ইত্যাদিতে ডুবে থাকতে থাকতে তাদের জীবনটাই এক virtual realityতে পরিণত হয়! তাই দেখেছি পেশা জীবনের শুরু থেকে যারা হারাম উপার্জনের সাথে সম্পৃক্ত, তারা ১০/১৫ বছরেও “লাইফস্টাইল নামক ঈশ্বরের” উপাসনা ত্যাগ করতে না পারলেও, সারা পৃথিবীর নির্যাতিত মুসলিমদের উদ্ধারের স্বপ্নবিলাসে বিভোর হতে পারেন।
***
এবার বিদেশী ব্র্যান্ডের ইসলামের তৃতীয় ধারাটার কথা একটু আলোচনা করবো ইনশা’আল্লাহ। এই ধারাটি আমাদের দেশে বেশ ক’বছর ধরে পরিচিত। তারা একটা অন-লাইন বিশ্ববিদ্যালয় চালান বলে, অনেকেই এদেশে তাদের সরজমিনে উপস্থিতির আগেই তাদের চেনেন। আগে যেমন বলেছি: নতুন প্রজন্মের এলিট বা এলিট হতে চাওয়া শিক্ষিত “দলিত”রাও কেউ যখন হঠাৎ করেই ইসলামে “আসেন”, তখন খুব অস্থিরচিত্ততায় ভোগেন। এলিট ঘরানার এক কাল্পনিক তরুণীর জীবন যাত্রায় ইসলামে আসার পর হঠাৎ যে পরিবর্তন আসে, আমরা আগে তার কথা বলেছি আপনাদের। এলিটদের জীবনে ঐ “শক” টা বেশী মাত্রায় পরিলক্ষিত হয় সত্য, কিন্তু, সারাদিন ইন্টারনেটে বা ফেসবুকে পড়ে থাকা, দেশের বা দেশীয় কোন কিছুকেই পছন্দ না করা, ছেলে/মেয়ে বন্ধুদের সাথে সাক্ষাতে বা টেলিফোনে আড্ডা দেয়া– এগুলো আজ আর এলিটদের কোন একচ্ছত্র ব্যাপার নয় আমার মত “ফকিরনির পুত” শ্রেণীর পরিবারের ছেলেমেয়েদেরে মাঝেও এগুলোর বিস্তর প্রভাব ও বিস্তার দেখা যায়। ইসলামে “আসার” পর পর তাই অন্য সবকিছুর মতই “ইসলামী জ্ঞানের” জন্যও, সাধারণ “দিশাহারা তারুণ্যকে”ও সাইবার স্পেসে হামলে পড়তে দেখা যায়। এই প্রবণতা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর একটা ব্যাপার; প্রথমত এই কারণে যে, এসব “নেট সার্ফিং” সাধারণত দিক-নির্দেশনাবিহীন এবং প্রবৃত্তি নির্ভর হয়ে থাকে। ইসলাম জানতে চেয়ে তাই আমরা দেখেছি/দেখি মানুষকে শিয়া, কাদিয়ানী, “চরমপন্থী জিহাদী” অথবা এমনকি নাস্তিকও হয়ে যেতে।
স্কলারদের কাছ থেকে আমাদের হালাকাভিত্তিক অ-প্রাতিষ্ঠানিক দ্বীন শিক্ষার চেষ্টা চলছে সেই ২০০৭ সালের জুলাই মাস থেকে, যা আমরা সবার জন্য উন্মুক্ত রেখেছি। আয়োজনের “শোঁ -শোঁ” দেখে কেউ যেন ভয় না পান, সেজন্য আয়োজনকে যথাসম্ভব সাদামাটা রাখার চেষ্টা করেছি যেখানে সবাইকে মেঝেতে (কার্পেটের মত করে বানানো ছড়িয়ে দেয়া) জায়নামাজের “রোল”-এর উপর বসতে হতো/হয়। আমাদের দাওয়াতী সংস্থাটা প্রথম ৫ বছর ছিল একটা মসজিদের কাছে অনেক সময়ই অনেক মুসল্লি, (আসরের) নামায শেষে ঘরে যাবার পথে লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায়ও আমাদের শনিবারের বিকালের সাপ্তাহিক হালাকায় এসে বসে যেতেন। এই মেঝেতে বসাটাকে আপাত দৃষ্টিতে খুব ছোট্ট একটা ব্যাপার মনে হলেও, এটা একটা “worldview” বা “জীবন-দর্শন”১৫ উপস্থাপন করে১৬। আরো যে কারণে আমরা ইচ্ছা করেই ব্যবস্থাটা এমন রেখেছিলাম সেটা হচ্ছে এই যে, অনৈসলামিক টাইট কাপড় পরা কেউ এসে বসলে তার অস্বস্তি লাগবে এবং আর তাতে তিনি যেন ঢিলা-ঢালা পরিচ্ছদ পরিধানের সম্ভাবনাটা বিবেচনা করে দেখেন। টাইট কাপড় বা জিন্স পরার ব্যাপারটাকে আমরা আজ ডালভাত বানিয়ে ফেলেছি সত্য – কিন্তু, ইসলামী জীবনযাত্রার ধরনের জন্য ব্যাপারটা যে অত্যন্ত বৈরী, তা বলাই বাহুল্য। যাহোক, আমাদের অ-প্রাতিষ্ঠানিক দ্বীন শিক্ষার শুরু হয়েছিল শায়েখ শহীদুল্লাহ খান মাদানীর১৭ সাথে বসে ইবন আবি ইজ্জ Izz আল-হানাফীর করা “আল-আক্বীদাহ আত-তাহাভিয়া”র একটা “শরাহ” (বা ব্যাখ্যা) দিয়ে। সেই থেকে এই পর্যন্ত প্রায় ৩০০টি সপ্তাহিক দারস বা হালাকায় শামিল হওয়ার তৌফিক দিয়েছেন আল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ! “আল-আক্বীদাহ আত-তাহাভিয়া” ছাড়াও “আল উজরু বিল জাহলী”, “খুরুজ ‘আলাল হুক্কাম”, “উমদাহাতুল আহকাম”, “কিতাবুত তৌহিদ”, “তফসীর আদওয়া আল বাইয়ান”-এর মত, ইসলামী জগতের বেশ কিছু অভাবনীয় বিষয়/কাজ/বই থেকে আমরা শায়েখ শহীদুল্লাহ খান, শায়েখ আকরামুজ্জামান বিন আব্দুস সালাম, ড. মানজুরে ইলাহী, ড. মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ, ড. আবু বকর জাকারিয়ার মত স্থানীয় স্কলারদের কাছ থেকে সরাসরি জ্ঞান লাভের সুযোগ পেয়েছি আবারো আলহামদুলিল্লাহ”!১৮
ইসনাদ বা “তথ্যসূত্র” হচ্ছে ইসলামী জ্ঞান তথা দলিলের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। ইসলামী জ্ঞানের মূল উৎস হচ্ছে কুর’আন ও সুন্নাহ (বা আরো সহজে বলতে পারেন “অহী” ও “অহীভিত্তিক টেক্সট” বা “নস্”) ইসলামের যে কোন বক্তব্যের (প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ) উৎস হতে হবে ঐ দু’টোর উভয় বা অন্তত একটি এই অপরিবর্তনীয় সত্যকে সামনে রেখে, “তথ্যসূত্র” বা “ইসনাদ পদ্ধতি” আমাদের দ্বীন শিক্ষা তথা ইসলামী জ্ঞান শিক্ষাকে পৃথিবীর সকল শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে আলাদা ও ব্যতিক্রমী একটা বৈশিষ্ট প্রদানকরত শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়েছে। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। মনে করুন আপনি “রেজনিক ও হ্যালিডে’র ফিজিক্স বইয়ে দেখলেন যে, একদা নিউটনের মাথায় একটা আপেল পড়লে, তিনি আপেলের পতন নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন, আর তার ফলশ্রুতিতেই মহাকর্ষ বলের সূত্রগুলো আবিষ্কার হলো ঠিক আছে, কিন্তু “রেজনিক ও হ্যালিডে” কার কাছ থেকে জানলেন ব্যাপারটা? ঐ বই ঘেঁটে বড় জোর আপনি এটুকু জানতে পারেন যে “রেজনিক ও হ্যালিডে” কোন কোন বইকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে তাদের বইটা লিখেছেন ব্যস ঐ পর্যন্তই। সবাই জানে নিউটনের জীবনে ওরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল তাই সবাই লিখে চলেছেন। কেউ কি জানতে পারবেন কয়জন বর্ণনাকারীর মুখ ঘুরে তথ্যটা “রেজনিক ও হ্যালিডে” পর্যন্ত এসেছে? অথবা ঐ সব বর্ণনাকারীরা আসলে সত্যবাদী ছিলেন কি না?? আপনারা হয়তো জেনে থাকবেন যে, “Piltdown Man” নামে খ্যাত বিবর্তনের “অকাট্য প্রমাণ” যে সম্পূর্ণ বানোয়াট এবং ল্যবরেটরীতে “প্রস্তুত” করা একটা প্রমাণ, তা বহু বছর পরে আবিস্কৃত হয়েছে। কারণ সময়ের নির্দিষ্ট প্রস্থচ্ছেদে, শিল্পবিপ্লবের পটভূমিতে খৃষ্টধর্ম বিমুখ ইউরোপীয় “মুক্তমনারা” ঠিক যা “খাবার” স্বপ্ন দেখতো, তেমনই একটা “কল্প-গল্প” তাদের গিলিয়ে দেয়া হয়েছে। মানুষ যা শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিল, নাস্তিক বিবর্তনবাদীদের পক্ষ থেকে ঠিক তাই তাদের শোনানো হয়েছে ব্যস! আর কেউ তা পরীক্ষা করে দেখার সামান্যতম প্রয়োজনও বোধ করে নি।১৯
এবার আসুন যে কোন ইসলামী নথিপত্রের কথায়। একটি হাদীস হাতে নিয়ে আপনি সেটার “ইসনাদ” বা “chain of narration” পরীক্ষা করে তার ১৩তম বর্ণনাকারী কে ছিলেন, তা নিমেষেই জানতে পাবেন। এজন্যই আমরা দেখি স্কলাররা যখন একটা দুর্বল হাদীস ব্যাখ্যা করেন, তখন হয়তো বলছেন যে, ঐ হাদীসের সনদে ৬ষ্ঠ বর্ণনাকারী একজন মিথ্যাবাদী, তাই এই হাদীসটি গ্রহণ করা যাবে না: তা শুনতে যতই ভালো বা পছন্দনীয়ই মনে হোক না কেন! আর এজন্যই আমরা দেখি যে, নিজের ছাগলকে একটা খালি পাত্র দেখিয়ে কাছে নিয়ে আসার “প্রতারণা” করেছেন বলে, একজন বর্ণনাকারীর কাছ থেকে হাদীস নেন নি সংগ্রহকারীরা! আপনি হাদীস নিয়ে একটু পড়াশোনা করলেই দেখবেন যে, ইসলামের প্রথম যুগে যার কাছ থেকে একটা হাদীস প্রথম শোনা যেত, তার চরিত্র ও জীবন-বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করতেন সংগ্রহকারী ও সংকলকরা আর তার সাথে “ইসনাদ” বা ” “chain of narration” ছিল অপরিহার্য। ইসলামী তথ্যসূত্রের বা ইসনাদের এই পদ্ধতিকে তাই পৃথিবীর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য Historical Methodology বা “ইতিহাস জানার পদ্ধতি” বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়২০। ইসলামী জ্ঞানও একইভাবে একজন শিক্ষক থেকে তাঁর শিষ্য, সেই শিষ্য থেকে তাঁর শিষ্য এভাবে রাসূলের (সা.) যুগ থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের কাছে এসেছে। আমার ছেলে, উস্তাদ আব্দুল হামিদের কাছ থেকে তাজভীদের২১ সনদ (সার্টিফিকেট) এবং ইযাষত (অন্যকে শেখানোর/পড়ানোর অনুমতি) পায়। সেই সনদ বা সার্টিফিকেট দেখলে আপনি দেখবেন যে, তাতে আমার ছেলের শিক্ষক উস্তাদ আব্দুল হামিদ থেকে শুরু করে পেছন দিকে যেতে গিয়ে প্রথমে উস্তাদ আব্দুল হামিদের শিক্ষকের নাম রয়েছে, তারপর সেই শিক্ষকের শিক্ষকের নাম রয়েছে এবং এভাবে পেছনে যেতে যেতে আপনি প্রথম শিক্ষক রাসূল (সা.) পর্যন্ত পৌঁছে যাবেন২২। তাই ইসলামী সমাজে ও সভ্যতায়, কোন শিক্ষকের কাছ থেকে সরাসরি দ্বীন শিক্ষাকে একরকম অপরিহার্য মনে করা হয়২৩ এবং সেই সাথে যারা আলেম হতে চান, তাদের গুণী শিক্ষকদের সাহচর্যে জীবন যাপন করাটাকেও জরুরী মনে করা হয় যেন ঐ শিক্ষকের কাছ থেকে আদব-কায়দা ও আচার- আচরণ শিখে শিক্ষার্থীর একটা উন্নত চরিত্র গঠিত হয়। আমরা ইতিহাসে দেখি এই ধরনের তারবিয়াতের (বা প্রশিক্ষণের) জন্যই ইমাম বুখারীর মা তাঁকে সুদূর উজবেকিস্তান থেকে আরব দেশে নিয়ে গিয়েছিলেন। ইসলামের এই ট্র্যাডিশনাল শিক্ষা ছিল “শিক্ষক নির্ভর” এবং অনেক ক্ষেত্রেই অ-প্রাতিষ্ঠানিক! আজো আমরা মদীনার মসজিদে বড় বড় আলেমদের কাছ থেকে ঐ ধরনের শিক্ষার আয়োজন দেখি – যেখানে পূর্ব নির্ধারিত কোন একটা নির্দিষ্ট সময়ে, কোন বিশ্বসেরা ‘আলেমের কাছ থেকে আল্লাহর দ্বীনের জ্ঞান-পিপাসুরা- যাদের অনেকেই হয়তো ভিনদেশ থেকে ঐ ভাবে জ্ঞান লাভ করতেই সৌদী আরব গিয়েছেন তারা জ্ঞান লাভ করছেন।
যা হোক, যে জন্য এত কথার অবতারণা নতুন প্রজন্মের এলিট বা এলিট হতে চাওয়া শিক্ষিত “দলিত”দের সরাসরি ‘আলেমদের হালাক্বা থেকে অ-প্রাতিষ্ঠানিক দ্বীন শিক্ষা করতে বড়ই অনীহা তার চেয়ে বরং অন-লাইন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “বেতার” শিক্ষাগ্রহণ তাদের কাছে অধিকতর পছন্দনীয় ও গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে আর তাতে একটা “সার্টিফিকেট” প্রাপ্তির বোনাস তো রয়েছেই! সাধারণত “Certificate Outlet” সমূহের গ্রাহক এসব এলিট বা হবু এলিটদের “সার্টিফিকেট” প্রীতি তো থাকতেই পারে কিন্তু তা ছাড়া আর কোন ফ্যাক্টর আছে কি না তা ভাবার চেষ্টা করেছি। কারণ এরাই হয়তো ইসলামে “আসার” আগে কোন সাহিত্য সংসদের বা “সিনে ক্লাবের” সদস্য ছিলেন সেখানে তো আর “সার্টিফিকেট” প্রাপ্তি ছিল না (তবে একধরনের অহংকার বুকে ধরে হয়তো চলা ফেরা করা যেত হয়তো বলা যেত “আমি জোসেফাইট অমুক ফোরামের মেম্বার” বা “ফৌজিয়ান বলে আমি গর্বিত!” ইত্যাদি)। আমি এর কারণ নিয়ে ভেবেছি এবং দেখেছি/বুঝেছি যে, এর পেছনেও to stand out from the rests বা “বিশেষ” কেউ হবার প্রবণতা কাজ করে এরা সাধারণের একজন হতে চান না! আগে উদ্ধৃত আমার একজীবন ভালো লাগা উদ্ধৃতি: “A labor leader is one who would do anything for the laborer, except becoming one of them”-এর মত করেই, ডিজুস প্রজন্মের এসব মুসলিমরা, “সাধারণ মুসলিমদের জন্য সম্ভাব্য সব কিছুই করতে হয়তো প্রস্তুত, কেবল তাদেরই একজন হওয়া ছাড়া”। আমার এই বোধের সপক্ষে একটা প্রমাণ হাজির করছি। ক’দিন আগে বিদেশী ব্র্যান্ডের ইসলামের এই তৃতীয় ধারাটার পক্ষ থেকে (প্রবেশ মূল্যের বিনিময়ে উপস্থিত থাকা যাবে) এমন একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানে আলোচনার বিষয় ছিল: “সামাজিক মিডিয়া সমূহে মুসলিমদের অংশগ্রহণ এবং এই অংশগ্রহণের ব্যাপারে মুসলিমদের অবস্থানটা কেমন হওয়া উচিত”। ঐ অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে তারা যা লিখেছিলেন, তার একাংশ ছিল:
Can you find a person without a Facebook or Twitter account!!! Who doesn’t frequent YouTube? Who doesn’t have a personal blog? এই লেখাটুকু দেখে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। তারা যদি বলতেন: “Can you find a smart guy without a Facebook……” আমার হয়তো খুব একটা আপত্তি থাকতো না, কিন্তু তারা বলেছেন: a person তার নিহিতার্থ হচ্ছে একটা Facebook একাউন্ট না থাকলে, কাউকে আমরা আর একজন “ব্যক্তি” মনে করতে পারি না সে বুঝিবা একধরনের “জড়-বস্তুতে পরিণত হয়! কিন্তু তাই কি?!
ক’দিন আগে, গত ৫ই মে, হেফাজতে ইসলামের ডাকে ধর্মীয়/মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত কয়েক লক্ষ লোক ঢাকায় জড় হয়েছিলেন, যাদের অনেকেই, এই যুগেও তাদের পাথেয় হিসাবে গুড়-মুড়ি-চিড়া সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে, তাদের ০.০১% এরও Facebook বা Twitter account ছিল না! তাহলে তারা কি “জড়বস্তু” বা “গবাদিপশুসুলভ” কিছু ছিলেন? তারা কি তাহলে “ব্যক্তি” ছিলেন না?? এই প্রসঙ্গে আরেকটি “স্বর্ণালী বাণী” মনে পড়লো: [The opposite of love is not hate, it’s indifference. [The opposite of beauty is not ugliness, it’s indifference. The opposite of faith is not heresy, it’s indifference. And the opposite of life is not death, but indifference between life and death…]। এই উদ্ধৃতিটি আমি প্রথম অন্য কারো লেখায় উদ্ধৃতি হিসেবেই পড়েছিলাম সেখানে এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়েছিল যে, কেউ যখন কাউকে ঘৃণা করে তখনও সে তার “ঘৃণিত চরিত্র” কে অন্তত একজন ব্যক্তি (বা কখনো তার নিজের প্রতিপক্ষ) হিসেবে গণ্য করে এবং তা ততটা অসম্মানজনক নয়, যতটা না অসম্মানজনক কারো প্রতি নির্বিকার বা নির্লিপ্ত থাকাটা! আপনি যখন কারো প্রতি নির্বিকার বা নির্লিপ্ত থাকেন, তখন কার্যত তাকে আপনি একটা “জড় বস্তু” বা “গবাদি পশুর” পর্যায়ে নামিয়ে দেন যেন সে এমন “কিছু” যার “অস্তিত্ব” বা “অনস্তিত্ব” উভয়ই আপনার কাছে সমান। ইংরেজী সাহিত্যে, কোন ব্যক্তিকে যখন চরম অপমান করতে চাওয়া হয়, তখন তাকে “thing” বলে সম্বোধন করা হয়! হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে ঢাকায় জড়ো হওয়া “loosely affiliated/attached”, মূলত কওমী মাদ্রাসায় শিক্ষিত ঐ জনসমষ্টি “ভুল” না “শুদ্ধ” ছিলেন, আমি সেই বিতর্কে যাবো না। কিন্তু ঢাকার “নাগরিকরা তাদের প্রতি যে নিদারুণ রকমের নির্লিপ্ততা বা indifference দেখিয়েছেন, তা বিস্ময়কর! লক্ষ লক্ষ গুলি বর্ষণ করা হলো, কুরবানীর ঈদের শেষে সিটি কর্পোরেশন যেভাবে গবাদি পশুর রক্ত বা বর্জ্য পরিষ্কার করে, সেভাবে দমকল বাহিনীর “high pressure water jet” দিয়ে ধুয়ে ফেলা হলো ঢাকার “central business district” মতিঝিল, যেখান থেকে নালা–নর্দমা দিয়ে বয়ে গেল হতভাগ্য “নিম্নবর্ণ” মুসলিমদের রক্তমিশ্রিত জল কিন্তু নাগরিক ঢাকা যখন নির্বিকার নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে দেখলেন, সুশীলরা একটা প্রতিবাদও করলেন না, তখন আমার মনে হয়েছিল: The opposite of love is not hate, it’s indifference..। ঠিক তেমনি “ইসলাম-ইসলাম খেলায়” মত্ত এলিটরা বা এলিট হতে চাওয়া “কি হনু রে” বোধ সম্পন্ন ডিজুস প্রজন্মের মধ্যবিত্তের সন্তানরা যখন বলেন: Can you find a person without a Facebook or Twitter account!!! Who doesn’t frequent YouTube? Who doesn’t have a personal blog? আমার তখন মনে হয় যে, তারা বোধহয় দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসরত গ্রমীণ বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠী তথা ‘হেফাজতে ইসলাম’ শ্রেণীর আম-জনতাকে মানুষ হিসেবেই গণ্য করেন না, বরং, The opposite of love is not hate, it’s indifference.-এর আলোকে, তারা হয়তো সাধারণ মানুষকে “জড়বস্তু” বা “গবাদিপশু”র মত জ্ঞান করে থাকবেন। অথচ, ফরহাদ মাযহারের মত কম্যুনিস্টও বোঝেন যে, কেবল নব-উদ্ভাবিত বাঙালী ধর্মের অনুসারী ইমরান গং-রাই নন, বরং ঢাকা কেন্দ্রিক গোটা সুবিধাভোগী (মধ্যবিত্ত) নাগরিক জনসংখ্যাও তাদেরকে “অন্য শ্রেণী”র মানুষ বলে জ্ঞান করেন “শ্রেণীশত্রু” মনে না করলেও, শ্রেণীবিভাজন রেখার অপর পারের “খ্যাত” ও “অনুল্লেখযোগ্য” এক জনগোষ্ঠী মনে করেন যাদের রক্ত “জলকামান” দিয়ে ধুয়ে ফেললেই শেষ। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, একত্রে বসবাসরত আমার পরিবারের গোটা প্রাপ্তবয়স্ক সদস্য সংখ্যার কারোরই “Facebook or Twitter account” নেই আর সেজন্য আমাদের কারোরই নিজেদের sub-human বা humanoid ও মনে হয় নি! আমি ঐ আয়োজনে যেতে পারি নি, গেলে একটা প্রশ্ন করতাম: উপস্থিতির ভিতর এমন কে কে আছেন যারা ইন্টারনেট ব্রাউজিং করেছেন, অথচ ইন্টারনেট ব্যবহার করতে গিয়ে জীবনে একটাও “ন্যাংটা ছবি” দেখেন নাই? যদি দেখা যায় যে, প্রায় সবাইই ঐ প্রক্রিয়ায় কখনো না কখনো একটা হলেও “ন্যাংটা ছবি” দেখেছেন, তাহলে পৃথিবীর কোন মুফতি আছেন যিনি, এমন কি ইসলামী তথ্য খোঁজার অযুহাতে, ইন্টারনেট ব্রাউজ করাকে অনুমোদিত বলবেন? আর তাই যদি হয়, তবে, একজন মুসলিমের দৃষ্টিকোণ থেকে, আপনাদের সেমিনারের এই বিশাল আয়োজন অর্থহীন নয় কি?
***
আমার কৈফিয়তের ও সেসবের পটভূমির ফিরিস্তী প্রায় শেষ, তবে একটা বিষয় বাকী রয়ে গেছে, যা নিয়ে বলেছিলাম যে, পরে আলোচনা করবো। আসলে এই আলোচনা বা প্রচেষ্টার এটাই সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়: বিষয়টা হচ্ছে সাধারণভাবে সকল মুসলিমদের, আর বিশেষভাবে বাংলাদেশী মুসলিমদের ইংরেজী ভাষা ও ইংরেজী-মিডিয়াম প্রীতি। আসলে কৈফিয়ত দিতে গিয়ে এই লেখাটা লিখতে বসার মূলেই রয়েছে এই বিষয়টা। ২০১২ সালের শেষের এক শীতের সকালে আমি এবং আমার স্ত্রী এদেশের শীর্ষ “এলিট” এক দম্পতির আমন্ত্রণে তাদের বাসায় গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। মহিলা অনেকদিন যাবত দ্বীন ইসলামের কাজে পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছেন এমন কথা শোনা যায়, আর ভদ্রলোকও যে হালে ইসলামের পথে চলতে চেষ্টা করতে গিয়ে নিজের জীবনের অনেক কিছুই বদলানোর চেষ্টা করছেন, এমন কথাও শোনা যাচ্ছে বেশ কিছুদিন। মহিলা প্রথম ২০১১ সালের রমাদান মাসের শুরুতে একদিন হঠাৎই, তার উমরাহ যাত্রার প্রাক্কালে আমাকে ফোন করেছিলেন। নিজের স্বামীর নামের আগে “মিসেস” জুড়ে দিয়ে পরিচয় দিয়েছিলেন। দ্বীন ইসলামের কাজকর্ম করার আমাদের যে অপ্রতুল চেষ্টা, তার খোঁজখবর নিচ্ছিলেন এবং এক পর্যায়ে গরীব রোজাদারদের খাওয়ানোর জন্য কিছু পয়সা দিলে, আমরা তা ব্যবহার করতে পারবো কি না তা জিজ্ঞেস করছিলেন। তারপর আমাদের মাঝে কোন যোগসূত্র আর বজায় থাকে নি- আমি তার ফোনালাপকে স্রেফ “এলিট” দের একটা খেয়াল বলেই গণ্য করি এবং এক পর্যায়ে ঘটনটা প্রায় ভুলেই বসতে গিয়েছিলাম। এমতাবস্থায় ২০১২ সালের শেষে তিনি এবং তার স্বামী আমার সাথে ফোনে যোগাযোগ করে একপর্যায়ে তাদের বাসায় যাবার আমন্ত্রণ জানান এবং একটা দিন-ক্ষণও ঠিক হয়।
আমার স্ত্রী এবং আমি যথাসময়ে তাদের বাসায় পৌঁছালে, তারা আমাদের অত্যন্ত উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। খুব আগ্রহ সহকারে তারা আমাদের কর্মকান্ডের খোঁজখবর নিতে থাকেন এবং আমাদের দেশে ইসলামের অতীত, ভবিষ্যত ও বর্তমান নিয়ে মতবিনিময় করেন। আমরা “এলিট” সাহচর্যে অভ্যস্ত না, তাই তাদের জন্য কি উপহার নিয়ে যেতে পারি ভেবে না পেয়ে, আমাদেরই কয়েকটি বই নিয়ে গিয়েছিলাম। মহিলা তার নিজস্ব পাঠাগারের জন্য বইগুলো আগ্রহভরে তুলে রাখতে রাখতে বললেন যে, তিনি বা তার স্বামী কেউই বাংলা লিখতে বা পড়তে জানেন না ধর্মীয় কোন লেকচার বাংলায় শুনলেও তার আত্মস্থ করতে কষ্টই হয়। বেশ অবাক হলাম। মহিলা কষ্ট করে বাংলা বলেন এবং তার বাংলায় উর্দু ও ইংরেজীর টান মিশ্রিত থাকে এসব থেকে, বিদেশে বড় হওয়া ঐ মহিলা বাংলা লিখতে/পড়তে নাও জানতে পারেন এমন সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে তার স্বামী, যার বাড়ী ঢাকার উপকণ্ঠে বলে দেশের সকলে জানেন, তিনিও বাংলা লিখতে পড়তে জানেন না জেনে বেশ অবাক হলাম! যাহোক গল্পে গল্পে তারা বিদেশে বিভিন্ন সময়ে, ইসলামের উপর কথা বলেন, এমন “৫ তারকা” বিদেশী স্কলারদের প্রোগ্রামে সরাসরি উপস্থিত থাকার অভিজ্ঞতার কথা বললেন। এটা তাদের জন্য ডাল-ভাত হবার কথা। দেশে আমরা যতবার না বাসে চড়েছি, তার চেয়ে বেশী সংখ্যকবার হয়তো তারা আন্তর্জাতিক রুটে বিমানে চড়েছেন। তাদের যে সামর্থ্য, তার বদৌলতে অস্কার পুরষ্কার বিতরন অনুষ্ঠানেও তারা যেতে পারতেন। তা না গিয়ে যে আল্লাহর কথা বলা হচ্ছে, এমন “শো” তে গিয়ে তারা তাদের চিত্তকে প্রফুল্ল করেছেন, সেটা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবীদার আলহামদুলিল্লাহ! এসব আলাপের সূত্র ধরেই একসময় মহিলা এদেশে বিদেশী উৎসের “দাওয়াহ” প্রচেষ্টার ধারাগুলোর প্রসঙ্গ টেনে আনলেন। তারপর ঐ ধারাগুলোর একটির ব্যাপারে আমার “সক্রিয় বিরোধিতা”র কথা শুনে তিনি অবাক ও ব্যথিত হয়েছেন বলে তার অনুভূতির কথা আমাকে জানালেন। আমি তখনো জানতাম না যে, আলোচ্য ঐ ধারার একটা স্কুলকে, তাদেরই মত, এদেশের আরেক “মুখ্য এলিট” তার “সাম্রাজ্য” থেকে বহিষ্কার করেছেন। আমি জানিনা, ঐ বহিষ্কার প্রক্রিয়ায় কোনভাবে আমার কোন সম্পৃক্ততা আছে এমন কোন “হলুদ সংবাদ” মহিলার কানে পৌঁছেছিল কি না। এই লেখার অন্যত্র আপনাদের যেমন বলেছি, তেমনি তাকেও বললাম: কেন আমি বিদেশী ধারার দাওয়াতী প্রচেষ্টাগুলোকে আমাদের দেশের জন্য যথার্থ মনে করি না এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমি কেন ওগুলোর সাথে একমত না। একমত না হওয়া একটা ব্যাপার, আর “সক্রিয় বিরোধিতা” করে কারো কোন প্রচেষ্টাকে ভন্ডুল করার চেষ্টা করা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা বিষয়। ঐ ধারার “দেশী এজেন্টরা” আমার কাছে এসেছিলেন এবং তাদের “৫ তারা” স্কলারের সাথে “বসার জন্য সময় চেয়েছিলেন। আমি তাদের সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছি কারণ:
১) তাদের পদ্ধতির সাথে আমি সহমত নই।
২) আমি তাদের বা তারা আমার জন্য অতিরিক্ত কল্যাণকর (beneficial) হবার সম্ভাবনা খুবই কম।
৩) যতটুকুতে কাউকে শুদ্ধ মনে করি, ততটুকুতে কারো সাথে “যুক্ত” হতে আমার কোন আপত্তি না থাকলেও, “কারো হয়ে” কাজ করার পর্যায়ে এখন আর আমি নেই২৪। বিশেষত তা যদি বাইরের কোন বিশেষ ব্র্যান্ডের “ইসলামী দাওয়াহ হয়ে থাকে। আমি/আমরা যে কোন মুসলিমকে ইসলামের একটি প্রতিষ্ঠিত মূলনীতি: “আল ওয়ালা ওয়া আল বারার” ভিত্তিতে সমর্থন বা সমালোচনা করে থাকি।
যাহোক তিনি আমার যুক্তি বুঝলেন মনে হলো। তারপর আবারো বললেন যে, তার মত যারা ইংরেজী ছাড়া কিছু বোঝেন না বাংলা লিখতে, পড়তে বা ঠিকমত বলতেও পারে না তাদের জন্য হলেও তো ইংরেজীতে দ্বীন শিক্ষার কিছু আয়োজন থাকা উচিত। আমি তাকে বললাম যে, অবশ্যই! এধরনের অতি ক্ষুদ্র যে জনসমষ্টি থেকে থাকতে পারে, তাদের জন্য বিশেষভাবে অনুষ্ঠান আয়োজন করা যেতেই পারে কিন্তু আমরা সেদিকে সবাইকে যেমন ডাকতে পারি না তেমনি আর্থ-সামাজিক শ্রেণীভিত্তিক “বিদেশী ভাষায়, বিদেশী ব্র্যান্ডের দাওয়াতী কাজ করে”, একটা “উচ্চবিত্ত মুসলিম” শ্রেণী তৈরী করে, ইসলামের সত্যিকার কোন অগ্রযাত্রার সূচনাও আশা করতে পারি না। কারণ আমরা বাস্তবেই দেখছি ঐ ধরনের উচ্চবিত্ত বা “এলিট মুসলিম” শ্রেণীর যে অবস্থা হবে তা হবে: An elite Muslim is one, who would do anything for the [common] Muslims, except becoming one of them l
এই পর্যায়ে আমাদের বুঝতে হবে যে, আমরা জীবনে একটা ভুল করে থাকতে পারি আমাদের বাবা-মায়েরাও হয়তো আমাদের ভুল মূল্যবোধ ও ভুল নৈতিকতার ভিত্তিতে বড় করে থাকতে পারেন। আমাদের বাবা-মার ভুল জীবন যাপনের জন্য চুরি বা পুকুরচুরির মাধ্যমে, গণমানুষের সম্পদ লুট বা হরির লুটের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে, সুদ-ঘুষ বা রাজনৈতিক তচরবৃত্তি কিংবা দালালি থেকে লব্ধ “সৌভাগ্যবলে” “এলিট” বনে গিয়ে তারা হয়তো একটা ভুল জীবনদর্শন গ্রহণ করে থাকতে পারেন এবং প্রকারান্তরে একটা ভুল জীবন যাপন করেও থাকতে পারেন আর সেজন্য আমাদের জীবনটাও হয়তো ভুল লাইনেই চলেছে। আমাদের বাবা-মায়েদের কেউ হয়তো ছেলেমেয়েকে দার্জিলিং বা লন্ডনে পড়তে পাঠিয়ে এমন বোধ দিতে চেষ্টা করেছেন যে, তাদের আসলে এই গ্রহে জন্মাবারই কথা ছিল না- তাদের সিদ্ধান্তের ভুলের জন্য আমরা হয়তো নিজের মাতৃভাষাটাও ঠিকমত না শিখে নিজ বাসভূমে প্রবাসীর মত জীবন-যাপন করার মত দুর্বিষহ অবস্থায় পড়ে থাকতে পারি। কিন্তু এখন তো আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজনন্মকে সেই ভুল পথে পরিচালিত না করে শুধরে দিতে পারি? কিন্তু আমরাও যদি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সেই পথেই পরিচালিত করি বা ডাকি, তবে বুঝতে হবে যে, ব্যাপারগুলো আমাদের কাছে ভুল নয়, বরং অভিলাষ আমরা বরং, ঐ ব্যবস্থা ও ব্যাবস্থাপনায়ই সন্তুষ্ট এবং জেনে বুঝেই সেসবকে অনুমোদিত মনে করে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছি; বুঝতে হবে, আমাদের বাবাদের বা পূর্বপুরুষদের fortune-এর পেছনের crime-গুলোকে আমরা বৈধ মনে করে সেগুলো উপভোগ করছি এবং যে কোন মূল্যে২৫ সেগুলোর ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রাখতে চাইছি! মুখে তৌহীদের কথা বলতে বলতে আমারা যদি lifestyle নামক demi-god-এর পায়ে জীবন উৎসর্গ করি এবং যেকোন মূল্যে আমাদের পূর্বপুরুষের দুর্নীতি ও দালালিলব্ধ ঐশ্বর্য্যনির্ভর জীবনযাত্রা (lifestyle) ও তার মানকে অটুট রাখার সংকল্প করি, তবে আমাদের চরিত্রকে “মুনাফিকের” চরিত্রই বলতে হবে বৈকি! আমাদের মুখে জিহাদের কথা বা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা নিছক মুনাফিক্বীই বলতে হবে! শুধু এলিটই নয়, অত্যন্ত সাধারণ পটভূমি থেকে উঠে আসা “কি হনু রে” শ্রেণীর জনৈক ব্যাংকারকে আমি চিনি, যিনি একযুগ ধরে (বিদেশী) সুদী ব্যাংকের চাকুরী ছাড়ার পরিকল্পনা করতে করতে আজো চাকুরী ছাড়াতে পারেন নাই, কারণ লাখ-টাকার-নীচে-বাজার-খরচ-না-চলা তার যে lifestyle ছিল – তা থেকে তিনি তো আজও বেরিয়ে আসতে পারেনই নাই, বরং বিদেশী সুদী ব্যাংকে চাকুরীর সুবাদে এলিটদের সাথে গা ঘষতে ঘষতে, নিজের জীবন যাত্রার মান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করতে করতে তিনি নিজেই এখন এলিট হবার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন। অথচ, চলনে-বলনে-কথনে- চিন্তায় তিনি ১৯২৪ সালের পূর্ববর্তী খিলাফাহর জন্য মাতম করে বেড়ান এবং তা পুনঃপ্রতিষ্ঠার বায়বীয় স্বপ্নে বিভোর থাকেন- নাউযুবিল্লাহ!
এদেশের মানুষ হয়েও কেউ একজন বাংলা বলতে, লিখতে বা পড়তে জানেন না তাই একজন স্থানীয় স্কলারের হালাক্বায় বসে তিনি “মজা” পান না; স্বামীর বাবার লুটের পয়সায় সারাজীবন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশেই শ্বাস নিয়েছেন, তাই আজ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নয়, এমন ঘরে বসলে তার দম বন্ধ হয়ে আসে আর কিছু না হলেও সেজন্যই তিনি মদীনার PhD কোন স্কলারের হালাক্বায় (কখনো ইচ্ছা থাকলেও) যেতে পারেন না এই ব্যাপরগুলো কোন মুসলিমের জন্য “আদর্শ” হতে পারে? আমি তো অমন কেউ হলে বা অমন কারো সন্তান হলে ব্যাপারগুলো একধরনের “প্রতিবন্ধিতা” বলে জ্ঞান করতাম এবং বলে বেড়ানো তো দূরে থাক, এসব কথা আলোচিত হলে লজ্জায় কুঁকড়ে যেতাম। এই ধরনের কাউকে আমরা বরং করুণা করবো এবং তাদের জন্য দোয়া করবো যে, আল্লাহ যেন তাদের ক্ষমা করেন এবং আমাদের যেন তাদের মত কিছু/কেউ হওয়া থেকে রক্ষা করেন। রাসূল (সা.) এর শিখিয়ে দেয়া দোয়া অনুযায়ী, আমরা আল্লাহর কাছে পর্যাপ্ত চাইবো, কিন্তু উপচে পড়া প্রাচুর্য থেকে অব্যাহতি চাইবো আর সেই প্রাচুর্য্য যদি হারাম উৎসের হয়, তবে তো সেটাকে জাহান্নামের আগুন জ্ঞান করে তা স্পর্শ করা থেকে বেঁচে থাকতে চাইবো ইনশা’আল্লাহ!
যাক কৈফিয়তের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ইংরেজী-ভাষাপ্রীতি ও ইংরেজী-মিডিয়াম-শিক্ষা-প্রীতি আমি কেন এসবের বিরোধিতা করি সেই কৈফিয়ত দেয়ার কথা আমার। আসুন নীচের পয়েন্টগুলো একটু ভেবে দেখি:
প্রথমত, আমাদের সম্পদ: আমাদের অর্থ, সময়, শ্রম ও মেধার যথার্থ ও সঠিক ব্যবহারের কথা আগেই বলেছি এগুলো সবই আল্লাহর নিয়ামত এবং একজন মুসলিমের অর্থ, সময়, শ্রম ও মেধা সে প্রধানত আল্লাহ রাস্তায় ব্যয় করবে অথবা অন্তত আল্লাহ বা তাঁর রাসূল (সা.) পছন্দ করেন, এমন ব্যাপারে ব্যয় করার আপ্রাণ চেষ্টা করবে এটাই তার কাছে কাঙ্খিত, কেননা এগুলোর প্রকৃত মালিক আল্লাহ এবং কুর’আনের ৫১:৫৬ আয়াত অনুযায়ী তাকেও সৃষ্টি করা হয়েছে কেবল আল্লাহর ইবাদত (বা আদেশ পালন) করার জন্য। অর্থ, সময়, সম্পদ ও মেধার অপব্যয় অথবা উপযুক্ত কল্যাণবিহীন অতিব্যয় (কুর’আনের ভাষায় তাবযীর ও ইসরাফ) দু’টোই একজন মুসলিমের জন্য পরত্যিাজ্য।
দ্বিতীয়ত, একজন মুসলিমের জন্য, তার মাতৃভাষার পরেই কোন ভাষাটা শিখা আবশ্যক? আরবী২৬ নিশ্চয়ই। কেন? চলুন দেখি একটু বোঝার চেষ্টা করি আমরা।
মুহাম্মাদ আল শরীফের একটা খুতবা আছে: “Faith has a language” (বা “বিশ্বাসের দ্বীনের একটা ভাষা আছে”)। নামটা এরকম হলেও ঐ খুতবাতে যে সব কথা আছে, তার সাথে আরেকটু যোগ করলেই আমরা বলতে পারতাম যে, ঐ প্রস্তাবনার শিরোনাম হবে “Faith has a language and any language has a faith too(embedded in it)” (বা “বিশ্বাসের দ্বীনের একটা ভাষা আছে এবং যে কোন ভাষারও একটা বিশ্বাস/দ্বীন আছে”) আমি মনে করি এই কথাটা অত্যন্ত বড় একটা সত্য, যা গোলামী ও হীনমন্যতায় ঠাসা আমাদের মস্তিষ্কে সহজে অনুভূত হয় না। ঐ খুতবার কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ ইনশা’আল্লাহ আমরা আলোচনা করবো:
………..Rasul Allah (sal Allaahu alayhi wa sallam) said, “Ballighu (notify, transmit, tell others) about me, if only with one Ayah.” How do we do that if we ourselves do not understand the Ayaat that were revealed? How can we presume to know a text when we don’t even understand the very language in which it was revealed? In order to fulfill the mission Allah and His Messenger (sal Allaahu alayhi wa sallam) have sent us on, it is imperative that we become literate in the language of Islam.
রাসূল (সা.) বলেছেন: “পৌঁছে দাও… এমন কি তা যদি একটি আয়াতও হয়”। আমরা কি করে তাঁর বাণী পৌঁছে দেব, যদি আমরা নিজেরাই নাযিলকৃত আয়াতসমূহ না বুঝি? আমরা কিভাবে মনে করতে পারি যে, আমরা কুর’আনের বক্তব্য বুঝি, যখন আমরা সেই ভাষাটাই জানি না, যে ভাষায় কুর’আন নাযিল হয়েছিল? যে “মিশন” সহকারে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) আমাদের পাঠিয়েছেনে, তা সম্পন্ন করতে হলে, এটা আবশ্যক যে আমরা ইসলামের ভাষাটা জানবো।
The Qur’an is Allah’s way of communicating with us, of directly guiding us on his path. But has that communication actually occurred?…….. Have we really allowed Allah to communicate with us, if we have not received the meaning of His words?
কুর’আন হচ্ছে, আমাদেরকে সরাসরি তাঁর পথ দেখানোর জন্য, আমাদের সাথে আল্লাহার যোগাযোগ স্থাপনের একটা মাধ্যম। কিন্তু আসলে কি সেই যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে? ….. তাঁর কথার অর্থ যদি আমরা না বুঝে থাকি, তাহলে আমরা কি আল্লহকে আমাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে দিলাম?
When someone says, ‘the Arabic language is foreign to me’, that translates into ‘the understanding of the Qur’an is foreign to me’. When the Arabic language is foreign to someone, that translates into ‘the Sunnah of AlMustafa (sal Allaahu alayhi wa sallam) is foreign to me.’
যখন কেউ বলেন যে, “আরবী ভাষা আমার জন্য ভিনদেশী (এক ভাষা)।” তখন আসলে তিনি বলছেন যে, “কুর’আন বোঝাটা আমার কাছে ভিনদেশী বা (অপরিচিত) একটা বিষয়।” আরবী ভাষা যখন কারো কাছে ভিনদেশী বা অপরিচিত বোধ হয়, তার অর্থ তিনি বলছেন: রাসূল (সা.)-এর সুন্নাহ আমার কাছে অপরিচিত।
Whoever loves Allah must, by virtue of that true love, love Rasul Allah (sal Allaahu alayhi wa sallam). And whoever loves Allah and His Messenger must, by virtue of that true love, love the Arabic language chosen by Allah.
যে আল্লাহকে ভালোবাসে, তাকে সেই ভালোবাসার দাবীতেই/গুণেই অবশ্যই রাসূল (সা.)-কে ভালোবাসতে হবে। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে (সত্যিই) ভালোবাসে, তাঁকে তার সেই সত্য ভালোবাসার দাবীতেই/গুণেই অবশ্যই আল্লাহর নির্বচিত আরবী ভাষাকে ভালোবাসতে হবে।
What does learning Arabie do for us?
One: It molds our character. As Ibn Taymiyyah – rahimahullah – said, “Using a language has a profound effect on one’s thinking, behavior and religious commitment. It also affects one’s resemblance to the early generations of this Ummah, the Companions and the Taabi’een. Trying to emulate them refines one’s thinking, religious commitment and behavior.”
আরবী ভাষা-শিক্ষা আমাদের জীবনে কি কল্যাণে আসে?
প্রথমত: তা আমাদের চরিত্র গঠন করে। ইবন তাইমিয়্যাহ (রহ.) যেমন বলেন: “একজন মানুষের চিন্তা, আচার-আচরণ এবং ধর্মীয় সংকল্পের উপরে, সে কোন ভাষা ব্যবহার করছে তার গভীর প্রভাব রয়েছে। এই উম্মাহর প্রথম প্রজন্মগুলো সাহাবী (রা.) ও তাবেঈগণ (রহ.) কেউ কতটা তাদের মত হলো, সেটাও নির্ভর করে সে কোন ভাষা ব্যবহার করছে তার উপর। তাদেরকে অনুকরণ ও অনুসরণ করার চেষ্টা, যে কারো চিন্তা, ধর্মীয় সংকল্প ও আচার-আচরণকে পরিশুদ্ধ করে।”
Two: It is our bridge to the culture of Islam. Undoubtedly, with the teaching of language comes the teaching of ways to think and behave, through understanding of the culture that speaks that language.
দ্বিতীয়ত, এটা (অর্থাৎ, আরবী ভাষা) হচ্ছে (সোনালী যুগের) ইসলামী সংস্কৃতির সাথে আমাদের সেতুবন্ধন। নিঃসন্দেহে এই ভাষা শিক্ষার সাথে সাথে, যে সমাজ ঐ ভাষায় কথা বলতো/বলে, সেই সমাজের সংস্কৃতি বোঝার মাধ্যমে, আমরা কি ভাবে (কোন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে) ভাবনা-চিন্তা করবো বা আচরণ করবো সেটাও শিখি।
As a summer job one year, I taught English in a Muslim country and ashamedly had to skip the numerous pages that spoke of alcohol, dating, and lewdness. This is the culture of the English language. Imagine the blessed culture and knowledge awaiting those who would learn Arabic.
মুহাম্মাদ আল শরীফ এই পর্যায়ে কোন এক গ্রীস্মের ছুটিতে একটি মুসলিম দেশে তার ইংরেজী পড়ানোর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলছেন: … পড়াতে গিয়ে লজ্জায় আমাকে অনেক কয়টা পৃষ্ঠা এড়িয়ে যেতে হয়েছে যেগুলোতে মদ, ডেটিং এবং অশ্লীলতার প্রসঙ্গ রয়েছে। এটা হচ্ছে ইংরেজী ভাষার সংস্কৃতি২৭।
Some of the students stayed behind, accepting jobs of teaching English just so they could stay in Madinah. A graduating brother beautifully rejected this when he said, “Why would I teach Muslim Arab children English, when I have the chance to go to Europe and teach Muslim European children Arabic?”
এর পর তিনি তার সময়কার কিছু (বিদেশী) ছাত্ররা যে একটু বেশীদিন মদীনায় থাকতে পারার জন্য, ইংরেজী শিক্ষকতার কাজ নিত সেটা বর্ণনা করার এক পর্যায়ে একজন ছাত্রের কথা উল্লেখ করেন, যিনি শিক্ষকতার প্রস্তাব প্রত্যখ্যান করে বলেন: “আমি আরব মুসলিম বাচ্চাদের কেন ইংরেজী শেখাবো, যখন আমার ইউরোপে যাবার এবং সেখানে গিয়ে ইউরোপীয় মুসলিম বাচ্চাদের আরবী শেখানোর সুযোগ রয়েছে?”
এখানে লক্ষ্য করুন যে, ছাত্রটি একসাথে সময়, সম্পদ ও শ্রম তিনটিরই উত্তম ব্যবহারের পথ বেছে নিয়েছে। আমরা ব্যাপারটা এভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি: প্রথমত, মুসলিম সমাজে অবস্থানরত ইসলামী মূল্যবোধসমেত বেড়ে উঠছে, এমন ছেলেমেয়েদের কুফরী বিশ্বাস ও কাফির সংস্কৃতি বা worldview-এর ধারক/বাহক ভাষা শেখানোর ক্ষতিটা সে এড়িয়ে গেল। দ্বিতীয়ত, ইউরোপে কুফরী মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত নাস্তিক-কাফির সমাজের ভয়ঙ্কর পরিবেশে বেড়ে উঠছে, এমন বাচ্চাদেরকে সে কুর’আনের ভাষা শিখিয়ে “আগুন” থেকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা করে সে এক মহান দায়িত্ব পালন করলো!
আপনার দ্বীন হচ্ছে ইসলাম আর সেই দ্বীনের ভাষা হচ্ছে আরবী! আপনি আল্লাহর সৃষ্টি। আপনাকে সৃষ্টি করা হয়েছে কেবলই আল্লাহর ইবাদত করার জন্য। স্বয়ং আল্লাহ বলেছেন:
إِنَّا أَنزَلْنَاهُ قُرْآنَا عَرَبِيًّا لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ
নিশ্চয় আমি একে আরবী কুর’আনরূপে নাযিল করেছি যাতে তোমরা বুঝতে পার। (কুর’আন, ১২:২)
وكَذَلِكَ أَنْزَلْنَاهُ حُكْمًا عَرَبِيًّا وَلَئِنِ اتَّبَعْتَ أَهْوَاءَهُمْ بَعْدَمَا جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ مَا لَكَ مِنَ اللَّهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا وَاقِ
আর এভাবেই আমি কুর’আনকে বিধানস্বরূপ আরবীতে নাযিল করেছি। তোমার নিকট জ্ঞান পৌঁছার পরও যদি তুমি তাদের খেয়াল খুশির অনুসরণ কর, তবে আল্লাহ ছাড়া তোমার কোন অভিভাবক ও রক্ষাকারী নেই। (কুর’আন, ১৩:৩৭)
এছাড়াও কুর’আনের ১৬:১০৩, ২০:১১৩, ২৬:১৯৫, ৩৯:২৮, ৪১:৩, ৪১:৪৪, ৪২:৭, ৪৩:৩ ও ৪৬:১২ আয়তসমূহে আল্লাহ, আরবী ভাষার মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন বিভিন্ন বিশেষণ সমেত। কেন? আমাদের অনুধাবন করা উচিত যে, রাসূল হিসাবে মুহাম্মদ (সা.)-কে বেছে নেয়া যেমন আল্লাহর মহাজাগতিক পরিকল্পনার একটা অংশ, তেমনি শেষ হিদায়াহ-গ্রন্থ কুর’আনের ভাষা আরবী হওয়াটাও কাকতালীয় কোন বিষয় নয়, বরং তাও আল্লাহর মহাজাগতিক পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত। আর তাই, মুসলিম হিসেবে, আল্লাহয় ও আখেরাতে বিশ্বাসী হিসেবে, আমরা যদি জন্মসূত্রে পাওয়া মাতৃভাষার বাইরে একটি ভাষাও শিখি, তবে তা নিশ্চিতভাবেই হওয়া উচিত আরবী। আক্বীদাহ, নসীহা, কালেমা, তৌহীদ, হাদীস, যিকির, কুর‘আন, আখিরাহ, রিসালাহ, সালাত, কুফর, শিরক, বিদ‘আত, ঘুলু, তাগুত, শিরক– আমাদের দ্বীনের এই ধরনের অগণিত অভিব্যক্তির অর্থ কেবল আরবী জানলেই পরিপূর্ণভাবে অনুধাবন করা সম্ভব!
এজন্যই এখন দেখবেন সৌদী আরব থেকে প্রকাশিত কুর’আনের অনুবাদগুলোকে, কুর’আনের অনুবাদ বলা হয় না বরং “কুর’আনের অর্থের অনুবাদ” বা Translation of the Meaning of the Qur’an (TMQ)২৮ বলা হয় কারণ একটাই: কেবল আরবী কুর’আনই কুর’আন, আর তাই এর কোন অনুবাদ হয় না! আমরা যা অনুবাদ করি, তা হচ্ছে আমরা এর অর্থ যে যেটুকু বুঝলাম, তার অনুবাদ। অর্থাৎ কেউ সত্যি কুর’আন “পড়তে” চাইলে, “বুঝতে” চাইলে, তাকে আরবী জানতে হবে আর এই কথাটাই মুহাম্মদ আল শরীফ উপরে (তার খুতবাহ থেকে উদ্ধৃত অংশে) আমাদের বোঝাতে চেয়েছেন।
এবার আসুন আমরা any language has a faith (embedded in it) কথাটা বোঝার চেষ্টা করি। প্রথমেই উপরে উদ্ধৃত ইবন তাইমিয়্যাহর (রহ.) একটা কথা খেয়াল করে দেখি আমরা; তিনি বলেছেন: “একজন মানুষের চিন্তা, আচার-আচরণ এবং ধর্মীয় সংকল্পের উপরে সে কোন ভাষা ব্যবহার করছে তার গভীর প্রভাব রয়েছে…..।” এই কথার রেশ ধরেই, আসুন আমরা প্রথমে আমাদের মাতৃভাষা নিয়ে কথা বলি। আমাদের মাতৃভাষা “বাংলা” কোন ধর্মকে বা ধর্মবিশ্বাসকে ধারণ করে? এই প্রশ্ন অত্যন্ত স্বল্প-শিক্ষিত কাউকে জিজ্ঞেস করলেও, তিনি বলবেন যে, অতি-অবশ্যই “হিন্দু-ধর্মবিশ্বাস”কে ধারণ করে। এইতো গত শতাব্দীর প্রথমভাগেও বাংলা সাহিত্যের দিকপাল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় “বাঙ্গালী ও মোছলমানদের” মাঝে খেলার বর্ণনা দিয়েছেন তার গল্পে। শুধু তিনিই নন, বাংলা ভাষার আরো অনেক (হিন্দু) কথা সাহিত্যিকই “স্লেচ্ছা” দের বাঙ্গালী জ্ঞান করেন নি। তাদের কাছে “বাঙ্গালী” ও “হিন্দু” দু’টি সমার্থক ও প্রতিস্থাপনীয় শব্দ ছিল। তবু আমরা “বাঙ্গালী” তারা আমাদের বলতে না চাইলেও আমরা বাংলাভাষী মুসলিমরা যে বাঙ্গালী, সেটা দিবলোকের মত সত্য ও স্পষ্ট: আমরা বাংলাদেশী বাঙ্গালী! আমাদের ভালো না লাগলেও, আমরা বাঙ্গালী! আল্লাহ আমাদের এই ভূমিতে পাঠিয়েছেন এটা আমাদের কদর বা fate আলহামদুলিল্লাহ! আমাদের এটা মেনে নিতে হবে। আমরা কোন space-time-এ জন্মগ্রহণ করবো, সে ব্যাপারে আমাদের কোন choice বা এখতিয়ার ছিল না বা নেই। সুতরাং, আমরা তা মেনে নেব তবে, আমাদের মুসলিম পরিচয়, জীবন- যাপন ও ধ্যান-ধারণা রক্ষা করতে, আমাদের ভাষার আপত্তিকর ও বিপত্তিকর দিকগুলো আমরা সাবধানে এড়িয়ে যাবো। আমাদের ভাষার মাঝে প্রোথিত কুফর, শিরক ও হিন্দুত্বের elementগুলোকে আমরা সচেতনভাবে ও সুনির্দিষ্টভাবে এড়িয়ে যাবো ইনশা’আল্লাহ! উদাহরণ স্বরূপ, আমরা: বিশ্বব্রহ্মান্ড, অবতার, দেবতুল্য, আপামর, লক্ষী, দিব্যি, উৎসর্গ, কলিযুগ, অগ্নিকন্যা, অর্ঘ্য, বেদী ইত্যাদি শব্দগুলো ব্যবহারের আগে একটু ভেবে দেখবো যে, আমরা কি বলছি? তার কারণ এই ধরনের শব্দগুলোর পরতে পরতে হিন্দু “আক্বীদাহ” বা ধর্ম-বিশ্বাস প্রোথিত রয়েছে যা আমাদের জন্য “কুফরী”। একটা শব্দ মুখে উচ্চারণ করলেই আমরা ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাবো কিনা সেটা নিয়ে হয়তো তর্ক করা যেতে পারে; কিন্তু, শব্দগুলো যে বিশ্বাস ধারণ করে, তা নিঃসন্দেহে “কুফর”।”শিরক” আর “কুফর” শিরক” হচ্ছে ইসলামের/ঈমানের anti-thesis। এছাড়া কিছু অভিব্যক্তি যেমন “তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?” অথবা “শ্যাম রাখি না কুল রাখি?” এসবও কুফরী আক্বীদাহ ধারণ করে। বাংলা ভাষায় প্রচলিত দেবর, ভাবী, শালা, শালী এসব শব্দের অর্থ ও ইঙ্গিত ইসলামী ধর্ম-বিশ্বাসের মূল্যবোধের নিরিখে অশ্লীল ও আপত্তিকর। এছাড়া “তাত্ত্বিক পর্যায়ে২৯” হিন্দু ধর্মের প্রথা অনুযায়ী কাকিমা (চাচী) ও মামীমা (মামী) এসব সম্পর্ককে “মায়ের মত” জ্ঞান করা হয়। এই “জ্ঞান করা’র বিষয়টা ধর্মীয় faultline পার হয়ে এমনকি তৌহীদবাদী মুসলিমদের ভিতরও সংক্রমিত হয়েছে; আর তাই মুসলিমদের জন্য “গায়ের-মাহরাম৩০” বা যাদের সাথে পর্দার সম্পর্ক সেই চাচী ও মামীরা আজ এমন আপন জন হয়ে উঠেছেন যে, তাদের বাড়ীতে বেড়াতে গেলে বাইরের ঘরে বসা যুবককে তারা, “আরে তুমি বাইরে বসে কেন? তুমি তো আপনজন, ছেলের মত” বলে অন্দরমহলে ডেকে নেন। আমি জানি, এই মুহূর্তে এই লেখা পড়তে পড়তে অনেকেই হয়তো ভাবছেন যে, “আমাদের মন ভালো, আমদের মন এত সংকীর্ণ নয়”। আল্লাহ আমাদের মন প্রশস্ত করতে বলেন নি, বরং তাঁর আদেশ পালন করতে বলেছেন, নিয়ম মানতে বলেছেন। এখানে বলা আবশ্যক যে, পক্ষান্তরে আরবী ভাষায় চাচী এবং মামীর জন্য বরাদ্দ কোন শব্দ নেই (একই কথা অশ্লীল ইঙ্গিতবহ শব্দ “দেবর” ও “ভাবী”র বেলায়ও প্রযোজ্য)।
বরং, চাচীকে আরবরা “চাচার স্ত্রী” বলেন, আর মামীকে বলেন “মামার স্ত্রী” (এবং দেবরকে স্বামীর ভাই ও ভাবীকে ভাইয়ের স্ত্রী) বলে থাকে তারা)। এভাবে বললে এবং ভাবতে শিখলে, ইসলামের কাঙ্খিত “গায়ের-মাহরাম” নারী পুরুষের মাঝের দূরত্বটা বজায় থাকে এবং (চোখের, কানের ও মনের) আংশিক ব্যভিচার অথবা পূর্ণ (শারীরিক মিলনের) ব্যভিচারের সম্ভাবনা অনেক কমে আসে। তাহলেই দেখুন: any language has a faith (embedded in it) কথাটা কত সত্যি একটা কথা!
এখন আসুন ইংরেজী ভাষার প্রসঙ্গে। আমরা প্রথমে একটি মাত্র শব্দ নিয়ে আপনাদের ভাবতে বলবো: God। “আল্লাহ” বলতে আমরা যা বুঝি, একজন ইংরেজ God দিয়ে মোটামুটিভাবে তাই বোঝাবেন বা বুঝবেন। এই God থেকে যে শব্দাবলী বেরিয়ে আসে সেগুলো হচ্ছে: Gods, Goddess, Goddesses, god, gods, goddess, goddesses। God- এই একটি শব্দের শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে আছে এমন আক্বীদাহ, বিশ্বাস ও ধর্মবিশ্বাস যা একাধারে কুফরি ও শিরক ইসলামী আক্বীদাহর সারসংক্ষেপ যে “তৌহীদ”, তার সম্পূর্ণ বিপরীত ধারণা বা anti-thesis। এখানে দেখা যাচ্ছে, তাদের ঈশ্বরের বহুবচন আছে, স্ত্রী লিঙ্গ আছে, পাতি-ঈশ্বর আছে, পাতি-ঈশ্বরেরও আবার বহুবচন আছে, স্ত্রীলিঙ্গও আছে… ইত্যাদি, ইত্যাদি। পক্ষান্তরে কুর’আনিক আরবী ভাষায়, মহাবিশ্বের অধিকর্তার “নাম” কি? “আল্লাহ”। যার কোন বহুবচন নেই, স্ত্রীলিঙ্গ নেই, ছোট বা পাতি রূপও নেই! আবারো: any language has a faith (embedded in it)! সুতারং, যেকোন ভাষার সাথে, তার কথা সাহিত্যের সাথে, parts and parcels হিসাবে স্বাভাবিকভাবেই সেই ভাষাভাষীদের আক্বীদাহ, ধর্ম-বিশ্বাস, সংস্কৃতি, অভ্যাস, লোকগাথা, রূপকথা, মূল্যবোধ, নৈতিকতার মান ইত্যাদি এক কথায় তাদের গোটা worldview তথা জীবনের নিয়ামকগুলো চলে আসে। নীচের উদ্ধৃতি হচ্ছে আমাদের দেশের ইংরেজী মিডিয়াম স্কুলগুলোতে শিশু শ্রেণীতে পড়ানো Radiant Way বইয়ের প্রথম ধাপের একটা ছড়ার একাংশ। এইটুকুর ভিতরই নাচ, গান, পার্টির যে চিত্র ফুটে উঠেছে৩১ তা এমন একটা “জীবন ব্যবস্থার” প্রতিনিধিত্ব করে, যা ইসলামী জীবন ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত এবং যা প্রতিটি বিশ্বাসী মুসলিমের জন্য পরিত্যাজ্য:
COME AND DANCE
Come and dance
Come and dance
Come, Pat, dance to Ann.
Come, Ann, dance to Pat.
Sing. Mother, sing.
**************************
কি বুঝলেন? একটা পার্টি: যেখানে একটা ছেলেকে ডাকা হচ্ছে একটা মেয়ের জন্য/সাথে নাচতে; আবার একটা মেয়েকে ডাকা হচ্ছে একটা ছেলের জন্য/সাথে নাচতে, আর জনৈকা মাকে ডাকা হচ্ছে গান গাওয়ার জন্য।
“কাফিরায়ন” বা কাফির হবার প্রক্রিয়ার “মগজ ধোলাইটা” এভাবেই শুরু হয়, খুব innocent ভাবে: উন্নততর পড়াশোনার নামে, মানুষ হবার নামে, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার নামে। তার মানে এই নয় যে, ইংরেজী মিডিয়ামে বা বিজাতীয় শিল্প-সাহিত্য অধ্যয়নের মাঝে থেকে সবাই সফলভাবে “কাফির” হতে পারেন! সবাই হয়তো দৌড়ের finishing line পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেন না, সেক্ষেত্রে অনেকেইে “কার্যত কাফির” অথবা “অর্ধ-কাফির” হয়ে জীবনটা কাটিয়ে দেন। আর অতি অল্পসংখ্যককে আল্লাহ বুঝিবা তাঁর অসীম রহমতে, ফিরে এসে ইসলামে পরিপূর্ণরূপে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবার তৌফিক দেন তারা সত্যিই ব্যতিক্রম, আর তারা সত্যিই সৌভাগ্যবান! এই কথাগুলো হয় আমরা বুঝিনা অথবা অসুবিধা হবে বিধায়, বুঝেও না বোঝার ভান করি আমরা জেগেও ঘুমের ভান করি। অথচ দেখুন, কাফির (ইহুদী) বাবা-মার ঘরে, কাফির হয়ে তৎকালীন অস্ট্রীয়-জার্মান জাতীয়তা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেও, এই “catch” গুলো কি সুন্দর বুঝেছিলেন ধর্মান্তরিত মুসলিম মুহাম্মাদ আসাদ তার Islam at the Crossroads বইয়ে তিনি বলেন:
“Except in rare cases, where a particularly brilliant mind may triumph over the educational matter, Western education of Muslim youth is bound to undermine their will to believe in the message of the Prophet, their will to regard themselves as representatives of the religiously-motivated civilization of Islam.” [page#63, Islam at the Crossroads – Muhammad Asad]
“কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র: যেখানে, একটা অত্যন্ত মেধাবী মস্তিষ্ক হয়তো লব্ধ শিক্ষার প্রভাবের উপর বিজয়ী হতে পারে সেসব ছাড়া, সাধারণভাবে, মুসলিম তারুণ্যের পশ্চিমা শিক্ষা অতি অবশ্যই রাসূল (সা.)-এর প্রচারিত বাণীতে বিশ্বাস আনার ব্যাপারে তাদের স্পৃহা এবং নিজেদেরকে ইসলামের ধর্মীয় অনুভূতি দ্বারা অনুপ্রাণিত সভ্যতার প্রতিনিধি হিসাবে উপস্থাপন করার ব্যাপারে তাদের স্পৃহার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে বাধ্য।”
“….the religious atmosphere in many Muslim houses is of such a low and intellectually degraded type that it may produce in the growing youth the first incentive to turn his back on religion. This may be so, but in the case of education of young Muslims on Western lines the effect not only may be but most probably will be an anti-religious attitude in later life.” (p65)
“…অনেক মুসলিম পরিবারে বিদ্যমান ধর্ম-কর্মের ধ্যান-ধারণা এত নিম্ন মানের এবং বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে এতই নিকৃষ্ট যে, [সেই পরিবেশে] বেড়ে ওঠা একজন অল্প-বয়সী মুসলিমের ধর্ম-বিমুখ হবার প্রথম প্রেরণাটা হয়তো সে নিজ গৃহ থেকেই লাভ করবে। এটা না হয় হতে পারে (অথবা, বলা যায় এটা একটা সম্ভাবনা), কিন্তু স্বল্প-বয়স্ক মুসলিমদের পশ্চিমা লাইনে শিক্ষার ফলাফল সম্বন্ধে বলা যায়: পরবর্তী জীবনে তাদের যে একটা ধর্মবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে তা কেবল একটা সম্ভাবনা নয়, বরং তা নিশ্চিত!”
“But the one thing Muslims must not wish to see with Western eves, to think in Western patterns of thought: they must not wish if they desire to remain Muslims, to exchange the spiritual civilization of Islam for the materialistic experimentation of the West, whether Capitalist or Marxist.” (p67)
“কিন্তু, যে একটা বিষয় মুসলিমদের কিছুতেই চাওয়া উচিত নয়, তা হচ্ছে পশ্চিমা চোখ দিয়ে (জীবনকে) দেখা, পশ্চিমা ধাঁচের চিন্তা করা: যদি তারা মুসলিম থাকতে চান, তবে তারা কিছুতেই বিশ্বাসভিত্তিক ইসলামী সভ্যতার সাথে পশ্চিমা বস্তুবাদী পরীক্ষামূলক সভ্যতার বিনিময় করতে পারেন না তা সে ধনতান্ত্রিকই হোক আর সাম্যবাদী হোক!”
“And as for European literature, it should certainly not be overlooked – but it should be certainly relegated to its proper philological and historical position. The way in which it is taught at present in many Muslim countries is frankly biased. The boundless exaggeration of Western values and concepts naturally induces young and unripe minds to imbibe wholeheartedly the spirit of Western civilization before its negative aspects can be sufficiently appreciated. And so the ground is prepared not only for a Platonic adoration of Western values, but also for a practical imitation of the social forms based on those values: something which can never go hand in hand with the spirit of Islam.”(p70)
“আর ইউরোপীয় সাহিত্যের ব্যাপারে বলতে হয় যে, তা যেন কোনভাবেই আমাদের মনোযোগ/দৃষ্টি এড়িয়ে না যায় বরং, সেটাকে (অর্থাৎ, ইউরোপীয় সাহিত্যকে) অবশ্যই তার সঠিক ভাষাগত ও ঐতিহাসিক অবস্থানে নামিয়ে দিতে হবে। বহু মুসলিম দেশে হালে যেভাবে পশ্চিমা সাহিত্য পড়ানো হয়, এক কথায় বলতে গেলে তা পক্ষপাতদুষ্ট। ঐসব সাহিত্য সামগ্রীতে পশ্চিমা মূল্যবোধ ও ধ্যান-ধারণার প্রশংসার সীমাহীন বাড়াবাড়ি তরুণ ও কাঁচা মনকে স্বাভাবিকভাবেই প্রভাবিত করে এবং সেগুলোর ক্ষতিকর দিকগুলো বুঝে ওঠার আগেই, সর্বান্তঃকরণে সেসব আত্বস্থ করতে প্ররোচিত করে। আর এভাবেই কেবল যে পশ্চিমা মূল্যবোধের কাল্পনিক আরাধনারই একটা ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় তাই নয়, বরং ঐসব মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা তাদের সমাজব্যবস্থার বাস্তব অনুকরণের জন্যও একটা ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়: যা কিনা ইসলামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে কখনোই হাতে হাত রেখে চলতে পারে না!।”
“If the tuition of European literature, in the form in which it is prevalent today in many Muslim institutions, contributes to the estrangement of young Muslims from Islam, the same, in a far larger measure, is true of Western interpretation of world history. In it the old attitude: Roman versus Barbarian: very distinctly comes into its own. Their presentation of history aims without admitting this aim – at proving that the Western races and their civilization are superior to anything that has been or could be produced in this world; and so it gives a sort of moral justification to the Western quest for domination over the rest of the world.
************************************
The only effect such historical training can have upon minds of young non-European people is a feeling of inferiority insofar (to such extent or degree) as their own culture, their own historic past and their own future possibilities are concerned. They are systematically trained to disdain their own potential future – unless it be a future surrender to Western ideals.” (p71-72)
“বহু মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আজ যে ভাবে ইউরোপীয় সাহিত্য পড়ানো হয়, তা যদি তরুণ মুসলিম প্রজন্মকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে নেয়ার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে থাকে, তবে বিশ্ব-ইতিহাসকে পশ্চিমারা যেভাবে ব্যাখ্যা ও উপস্থাপন করে থাকেন, তা আরও অনেক ঘোরতরভাবে, ঐ একই দুষ্কর্মটি সমাধা করে থাকে। এর ভিতর সেই পুরাতন মনোবৃত্তিঃ “রোমাকগণ বনাম বর্বর জনগোষ্ঠী”– তা অত্যন্ত প্রকটভাবে ফুটে ওঠে। স্বীকার না করলেও, তারা যেভাবে ইতিহাস উপস্থাপন করেন তার একটা সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকে, তা হচ্ছে: তাদের জাতিসমূহকে এবং এবং তাদের সভ্যতাকে এযাবতকালের সৃষ্ট অথবা ভবিষ্যতেও এই পৃথিবীতে সৃষ্টি হতে পারে, এমন সম্ভাব্য যে কোন কিছুর চেয়ে শ্রেয় প্রমাণ করা; আর তাতে করে তা বাকী পৃথিবীর উপর পশ্চিমা আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টাকে এক ধরনের নৈতিক যৌক্তিকতা দান করে৩২।
******************************
সল্প-বয়সী অ-ইউরোপীয় মস্তিষ্কসমূহের উপর এই ধরনের বিদ্যা-শিক্ষার একমাত্র যে প্রভাবটা পড়তে পারে, তা হচ্ছে: তাদের মাঝে নিজ সংস্কৃতি, অতীত ঐতিহ্য ও ভবিষ্যত সম্ভাবনা সম্বন্ধে একটা হীনমন্যতার বোধ সৃষ্টি হবে। তাদেরকে সুপরিকল্পিতভাবে তাদের নিজ ভবিষ্যতকে ঘৃণা করতে শেখানো হয় অবশ্য যদি না তা পশ্চিমা আদর্শের কাছে আত্মসমর্পণের একটা ভবিষ্যত না হয়।”
“Again and again it must be repeated that there is only one thing which a Muslim can profitably learn from the west, mainly, the exact sciences in their pure and applied forms. But this necessity for a quest of science from Western sources should not induce a Muslim to regard Western civilization as superior to his own or else he does not understand what Islam stands for.
******************************
But we cannot and must not imitate Western civilization if we wish to preserve and to revive the values of Islam.” (p73)
“আবারও এটা অবশ্যই পুনরুল্লেখ করতে হবে যে, এমন কেবল একটা জিনিসই রয়েছে যা একজন মুসলিম লাভজনকভাবে পশ্চিমা সভ্যতা থেকে গ্রহণ করতে পারে: তা হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক বিজ্ঞানসমূহ৩৩। কিন্তু পশ্চিমা উৎস থেকে বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা যেন একজন মুসলিমকে এমনভাবে প্রভাবিত না করে, যাতে তিনি পশ্চিমা সভ্যতাকে নিজের (ইসলামী) সভ্যতার চেয়ে শ্রেয় মনে করতে শুরু করেন আর তা যদি হয় তবে বুঝতে হবে যে ইসলাম বলতে কি বোঝায়, তাই তিনি জানেন না!
************
কিন্তু আমরা যদি আদৌ ইসলামী মূল্যবোধগুলো সংরক্ষণ ও পুনরুজ্জীবিত করতে চাই তবে আমরা কিছুতেই পশ্চিমা সভ্যতার অনুকরণ করতে পারি না।”
“The Muslim world was stagnant; and many Muslims came to the very superficial conclusion that the Islamic system of society and economics is not compatible with the requirements of progress, and should, therefore, be modified on Western lines. Those “enlightened” people did not troubled to inquire how far Islam, as teaching, was responsible for the decadence of the Muslims: they did not stop to investigate the real ideology of Islam, they merely pointed out, and rightly so, that the teachings of their contemporary theologians were in most instances an obstacle to progress and material achievement.” (p75)
“(এটা ঠিক যে) মুসলিম জাহান (বহুদিন) একটা স্থবির অবস্থায় ছিল; তাই অনেক মুসলিমই খুবই স্কুল চিন্তাভাবনার ভিত্তিতে চট করে এই উপসংহারে পৌঁছে যান যে, ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রগতির জন্য জরুরী বিষয়গুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, আর সেজন্য পশ্চিমা আদলে সেসবের সংস্কার সাধন করতে হবে। ঐসব “আলোকিত” ব্যক্তিরা, মুসলিমদের অবক্ষয়য়ের জন্য একটা আদর্শ হিসেবে ইসলাম আসলেই কতটা দায়ী, সে ব্যাপারে খোঁজখবর নেবার কষ্টটুকু করেন নি:
তারা ইসলামের “সত্যিকার আদর্শ” সম্বন্ধে তদন্ত করার জন্য একটু অবকাশও নেন নিঃ তারা কেবল তাদের সমকালীন “মোল্লাদের” শেখানো (ইসলামের) শিক্ষাগুলোর দিকে আঙ্গুল তুলে এটা দেখাতে চেয়েছেন যে, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলো প্রগতি ও পার্থিব উন্নতির পথে প্রতিবন্ধক বা অন্তরায় এবং তাদের এই উপলব্ধি সম্ভবত সঠিকও (যে “সমকালীন মোল্লাদের শেখানো (ইসলামের) শিক্ষাগুলো বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই প্রগতি ও পার্থিব উন্নতির পথে প্রতিবন্ধক বা অন্তরায়]৩৪।
“It is futile to argue, as many of the Muslim “intelligentsia” do, that it is of no spiritual consequence whatsoever whether we live in this way or that, whether we put on Western dress or that of our forebears, whether we are conservative in our customs or not
……the innate character of Western civilization definitely precludes, as I have tried to show, a religious orientation in man. And only very superficial people can believe that it is possible to imitate a civilization in its external appearance without being at the same time affected by its spirit.”(p76~77)
“মুসলিম “বুদ্ধিজীবী দের একটা অংশ যেমন যুক্তি দেখিয়ে থাকেন, তেমন, এই যুক্তি দেখানো আত্ম-ধ্বংসী যে, আমাদের জীবনযাত্রার ধরন এরকম হলো না ওরকম হলো তা আমাদের ধর্মীয়মূল্যবোধকে কোনভাবেই প্রভাবিত করে না: আমরা পশ্চিমা বেশভূষা ধারণ করলাম না আমাদের (মুসলিম জগতের) পূর্বপুরুষদের বেশভূষ্য ধারণ করলাম-অথবা- আমরা আমাদের আচর-আচরণে রক্ষণশীল হলাম কি না হলাম, তাতে আমাদের ধর্মীয় অবস্থার কোন পরিবর্তন হবে না এমন ভাবাটা নিঃসন্দেহে আত্ম-ধ্বংসী।
***************
….আমি [মুহাম্মাদ আসাদ] যেমন দেখাতে চেয়েছি, পশ্চিমা সভ্যতার সহজাত চরিত্র নিশ্চিতভাবেই মানুষের ধর্মীয় জীবনযাপনকে অগ্রাহ্য করে। আর, কেবল খুব স্কুল জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তিরাই মনে করতে পারেন যে, কোন একটা সভ্যতার চালিকাশক্তি দ্বারা প্রভাবিত না হয়েই, শুধু দৃশ্যমান বাইরের দিকটা অনুকরণ করা সম্ভব৩৫।
“It is impossible to live according to the Sunnah of our Prophet and to follow the Western mode of life at one and the same time.
****************
The Sunnah is so obviously opposed to the fundamental ideas underlying Western civilization that those who are fascinated by the latter see no way out of the tangle but to describe the Sunnah as an irrelevant, and therefore not compulsory, aspect of Islam-because it is “based on unreliable Traditions”. After that, it becomes easier to twist the teachings of the Qur’an in such a way that they might appear to suit the spirit of Western civilization.” (p92-93)
“একই সঙ্গে আমাদের নবীর (সা.) সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন যাপন করা, আর পশ্চিমা ঢং-এর জীবনযাত্রার ধরন অনুসরণ করা অসম্ভব।৩৬
*******************
নবীর (সা.) সুন্নাহ পশ্চিমা সভ্যতার (বিশেষত ফরাসী ও শিল্প বিপ্লবোত্তর পশ্চিমা সভ্যতার) অন্তর্নিহিত ধারণাসমূহের নিরিখে স্পষ্টতই এত বিপরীত মেরুতে অবস্থিত যে, যারা (অর্থাৎ, যে সব মুসলিমরা) পশ্চিমা সভ্যতার ব্যাপার স্যাপারে মুগ্ধ বোধ করেন, তারা এই বৈপরীত্য থেকে বেরিয়ে আসার আর কোন উপায় না পেয়ে, সুন্নাহকে ইসলামের জন্য অপ্রয়োজনীয় তথা অবশ্য-পালনীয় নয় এমন বিষয় বলে বর্ণনা করে থাকেন: (তাদের ভাষায়) কেননা “সুন্নাহর ভিত্তি হচ্ছে অনির্ভরযোগ্য ঐতিহ্য/সূত্র”। আর একবার যখন তারা ঐ ভাবে বলতে/ভাৰতে শুরু করেন, তখন কুর’আনের শিক্ষাগুলোর এমন বিকৃত ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব হয়, যা থেকে মনে হতেই পারে যে, সেগুলো পশ্চিমা সভ্যতার চালিকা শক্তি ও মননশীলতার সাথে সংগতিপূর্ণ।”
এরপর তিনি এমন একটা কথা বলেন যা হাজার বছর ধরে ইসলামের বহু বড় স্কলার ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় বলে গেছেন:
“Instead of meekly submitting Islam to alien intellectual norms, we must learn- once again to regard Islam as the norm by which the world is to be judged.” (p102)
“দুর্বল-চিত্ততাবশত ইসলামকে অপরিচিত ভিনদেশী/ভিনধর্মী বুদ্ধিবৃত্তিক মানদন্ডে বিচার না করে, আমাদের অবশ্যই, আবারো, সমগ্র পৃথিবীকে ইসলামের মানদন্ডে বিচার করতে শিখতে হবে”
আমার কৈফিয়ত দেয়া শেষ। তবে এই লেখা লিখতে লিখতে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা দিয়ে লেখাটা শেষ করতে চাই ইনশা’আল্লাহ। এখন থেকে নিয়ে এই লেখাটার বাকী অংশটাকে পাঠক চাইলে “কৈফিয়তের কৈফিয়ত” বলতে পারেন। আমি আমার দাওয়াতী সংস্থায় বিভিন্ন সময়ে Islam at the Crossroads বইটি কয়েকবার ভাই-বোনদের পড়ে শুনিয়েছি ব্যাখ্যাসহ আলোচনা করেছি। এই লেখাটা লিখতে আমার অনেকদিন লেগেছে কেন যেন সময়ের বরকত হয়নি। স্কলাররা বলেন: কেউ গুনাহে লিপ্ত থাকলে, তার সময়ে বরকত থাকে না। আমি আল্লাহর কাছে জানা অজানা সকল গুনাহর জন্য মাফ চাইছি, তওবা করছি, আর ভবিষ্যতের সময়ের বরকত চাইছি। যাহোক, এবার এই লেখাটা লিখতে লিখতে যখন Islam at the Crossroads বইটি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা হচ্ছিল, তখন একদিন, সাভার থেকে আসা এক দ্বীনী বোন ইংরেজী মিডিয়াম সম্বন্ধে আমার আপত্তি শুনে বললেন: “ইংরেজী জানেন বলেই তো সুন্দর সুন্দর বই পড়ে আমাদের দ্বীন ইসলামের কথা শোনাচ্ছেন”। প্রাসঙ্গিক জ্ঞাতব্য হচ্ছেঃ ঐ বোনটি কিছুদিন আগে তার ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করার ব্যাপারে পরামর্শ করতে তার স্বামীসহ আমার কাছে এসেছিলেন। আমি তাকে শিক্ষা সম্বন্ধে আমার মতামত জানালে, তিনি চিন্তায় পড়ে যান এবং আমাদের “গরীব” বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ছেলেকে দেয়ার কথা ভাবতে শুরু করেন। কিন্তু তার স্বামী বললেন যে, তারা যুক্তরাষ্ট্রে যাবার “অভিবাসনের লাইনে” আছেন তাই তিনি চান তার ছেলেকে ইংরেজী মিডিয়াম স্কুলে দিতে। আমি তখন তাকে ইসলামের নামে চালানো নিকটবর্তী ইসলামী স্কুলে কর্মরত পরিচিত এক ভাইয়ের সেল নাম্বার দিয়ে দিলাম। তারা তাদের ছেলেকে সেখানে ভর্তি করেন। কিন্তু নানা (ধর্মীয়) কারণে ঐ বোনটি এবং তার স্বামী, এরপরও ঘুরে ঘুরে আমাদের কাছে এসেছেন। এমনই একটা আগমনে তিনি Islam at the Crossroads থেকে আমার আলোচনা শোনেন। তিনি তো আর আমাকে সরাসরি বলেন নি। তবে ঐ দারসে মেয়েদের অংশে থাকা অন্য কেউ, তার বক্তব্য আমার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। আরেকটা উপলক্ষে আরেকদিন আমি আমার অবস্থান পরিষ্কার করলাম:
মনে করা যাক একজন মানুষ ভালো করে হাঁটতে শেখার আগেই আর একটা পা ভেঙ্গে যায় যা আর কখনো ভালো হবার সম্ভাবনা খুবই কম। তিনি ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটেন এবং ব্যাপারটাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। ক্রাচে ভর দিয়েই তিনি স্কুল-কলেজে গিয়েছেন পড়া লেখা শিখেছেন। আজ উপার্জনের জন্য তিনি একই উপায়ে ঘরের বাইরে যান, বাজার করতে বাজারে যান ইত্যাদি… এক কথায় জীবনের সকল কাজই তিনি ক্রাচে ভর দিয়েই সমাধা করে থাকেন। তার একটা ছেলে জন্ম নিলো স্বাভাবিক ও সর্বাঙ্গ সুন্দর। ছেলেটি যখন বড় হচ্ছে, তিনি কি তাকে বলবেন যে, আমি জীবনের সকল কাজ ক্রাচে ভর করে সমাধা করেছি আমার ঐ ক্রাচ না থাকলে আমি জীবনে চলতেই পারতাম না সুতরাং, এসো তোমার একটা পা ভেঙ্গে দিই, তোমাকেও তারপর বাইরের সকল কাজ ক্রাচে ভর দিয়েই সারতে হবে? নিশ্চয় না!!
আমিও অনেক খোঁজ করে, কষ্ট করে, সহীহ-শুদ্ধ ইংরেজী বই পড়ে নিজে ইসলামের জ্ঞান অর্জন করার চেষ্টা করেছি, অন্যকেও বোঝাতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু যার জীবন কেবল শুরু হচ্ছে, তাকে কি আমি খোঁড়া করে রাখবো? তার কাঁধে কি ক্রাচের মত করে ইংরেজী ভাষার মত বিজাতীয় ভাষার একটা বাড়তি বোঝা চাপিয়ে দেব? তাকেও কি বলবো তৃতীয় একটা বিদেশী ভাষা ঘুরে তুমি আরবী কুর’আনের অর্থ জানো?? নাকি তাকে বলবো: জীবনের সম্ভাব্য প্রথম দিন থেকেই তুমি দু’পায়ে হাঁটতে শেখো, আরবী ভাষা শেখো এবং সরাসরি উৎস থেকে আল্লাহর দ্বীন শেখো? পাঠক, আমি আমার খোঁড়া পা ভালো করে তোলার চেষ্টা ছাড়িনি। এই বয়সে আমি এবং আমার স্ত্রী কুর’আনিক আরবী শেখার চেষ্টা করছি আজ প্রায় চার বছর ধরে আমরা চেষ্টা করে চলেছি। সপ্তাহে মাত্র একটি ক্লাস, তাও আবার হরতাল-মিছিল ছুটি-ছাটাতে বাদ যায়। তবু আলহামদুলিল্লাহ! আমরা খুব সম্ভবত পাঠ্যসূচির শেষ অষ্টমাংশে রয়েছি। আল্লাহ চাইলে তা শেষও হবে ইনশা’আল্লাহ!
আমাদের অনাগত ভবিষ্যতের সন্তানেরা, নাগরিকেরা, জীবন-জীবিকার প্রয়োজন মেটাতে তৃতীয় ভাষা হিসাবে ইংরেজী শিখতে পারে- যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু, যতটুকু না হলেই নয় ততটুকু। তবে মাতৃভাষার পর পরই তাদের উচিত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কুর’আনিক আরবী শেখার জন্য সময়, সম্পদ, মেধা ও শ্রম বিনিয়োগ করা। কারণ তাদের সৃষ্টিই করা হয়েছে আল্লাহর ইবাদত করার জন্য আর ইবাদতের বিষয়গুলো সঠিকভাবে জানার নিশ্চিত মাধ্যম আরবী ভাষা।
আমার কৈফিয়ত দেয়া শেষ। এখন আপনাদের বলছি: আপনাদের নিয়ন্ত্রণে বা তত্ত্বাবধানে যদি কোন শিশু থেকে থাকে, তবে জীবনের পরিবেশ ও প্রতিবেশের অগণিত কক্ষপথের কোনটিতে তাকে “স্থাপন” করবেন, সেটা যে অত্যন্ত গভীরভাবে ভাববার বিষয় তা এতক্ষণে নিশ্চয়ই আপনাদের কাছে পরিষ্কার হয়েছে! সুতরাং তাদের মস্তিষ্কের “অপরিবর্তনীয় বিকৃতি” ঘটে যাবার আগেই, তাদের জন্য সঠিক পথটি বেছে নেবার চেষ্টা করবেন ইনশা’আল্লাহ!। এই প্রসঙ্গে আরো একটা কথা আপনাদের জানাতে চাই। আপনারা হয়তো জেনে থাকবেন যে, ইসলামে সাধারণভাবে, “কাকে ভালোবাসবেন” আর “কাকে ভালোবাসবেন না” এটা অল্লাহ ঠিক করে দিয়েছেন। জাতি, গোষ্ঠী বা বর্ণের ভিত্তিতে আল্লাহ আমাদের ভালোবাসা নির্ধারণ করে দেন নি, বরং, বিশ্বাস বা আদর্শের ভিত্তিতে তা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আমাদের জন্য ঈমানের শর্ত হচ্ছে: আমরা এমন কাউকে ভালোবাসবো না, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) বিরোধিতা করে।
কুর’আনের ৫৮:২২ আয়াত থেকে এই মূলনীতি এবং তা ওয়াজিব ও ঈমানের শর্ত হবার বিষয়টা প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে আল্লাহ
বলেন:
لا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوا آبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ أُولَئِكَ كَتَبَ فِي قُلُوبِهِمُ الْإِيمَانَ وأيدَهُمْ بِرُوحِ مِنْهُ وَيُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا . ا رضي الله علهمْ وَرَضُوا عَنْهُ أُولَئِكَ حزب الله ) له أنا إن حزب اللهِ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
“যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান আনে এমন কোন সম্প্রদায়কে তুমি পাবে না এমন লোকদেরকে ভালোবাসতে, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করে যদি সেই বিরুদ্ধাচারীরা এমনকি তাদের পিতা, পুত্র, ভাই অথবা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী হয় তবুও। এদের অন্তরে আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং তাঁর পক্ষ থেকে রূহ দ্বারা তাদের শক্তিশালী করেছেন। তিনি তাদের প্রবেশ করাবেন এমন জান্নাতসমূহে যার নিচে দিয়ে ঝর্ণাধারাসমূহ প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। এরা হল আল্লাহর দল। জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহর দলই সফলকাম।” (সূরা মুজাদালা, ৫৮:২২)।
এই বিষয়ের উপর লিখিত একটা বইতে বর্তমান বিশ্বের জীবিত স্কলারদের ভিতর অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন, ড. সালিহ আল ফাওযান, আপনার মাঝে কাফিরদের প্রতি তথা তাদের জীবন ব্যবস্থার প্রতি যে ভালোবাসা লুকিয়ে আছে (অথচ, মুসলিম হিসেবে যা থাকবার কথা নয়), তার ১০টি আলামত বর্ণনা করতে গিয়ে প্রথমেই বলেন:
- Imitating them in dress and lingo…৩৭
বিধর্মীদের পোষাক পরিচ্ছদে ও ভাষায় অনুকরণ করা ইংরেজী মিডিয়াম প্রীতির পেছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই অনুকরণের ইচ্ছা ও প্রবণতা যে কাজ করে থাকে, তা বলাই বাহুল্য!
ইংরেজী মিডিয়ামে পড়ার পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে আরেকটা কথা বলা হয় প্রায়ই: “বাংলা মিডিয়ামের বইগুলোতেও অনেক বিজাতীয় বা বিধর্মীয় সংস্কৃতির ব্যাপার থাকে, ইংরেজী মিডিয়ামে পড়লে আমাদের সন্তানেরা সেসব এড়িয়ে যেতে পারে।“ একটু ভাবলেই এই যুক্তির অসারতা টের পাওয়া যাবে। আমাদের দেশের পাঠ্য বইগুলোতে ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে যে সব “অপসংস্কৃতির” বিষয়াদি থাকে, সেগুলো এমনিতেই, আমরা না চাইলেও বা পছন্দ না করলেও আমাদের পরিবেশ প্রতিবেশে কমবেশী বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ, নববর্ষকে ঘিরে আমাদের নাগরিক সমাজে যা হয়, মুসলিম হিসেবে আমরা সচেতনভাবে নিজেদেরকে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ে সেসব থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারি। কিন্তু আমরা তথাপি এমন একটা পরিবেশের ভিতর বাস করতে বাধ্য, যেখানে নববর্ষকে ঘিরে আয়োজন হয়তো এক “নিষ্ঠুর বাস্তবতা”। এই অনাকাঙ্খিত বাস্তবতার প্রতিফলনই হয়তো আমাদের পাঠ্য পুস্তকে ঘটে থাকে। আগেই যেমন বলেছি, এটা আমাদের “কাদর”। আমরা তো আর আর নিজ ইচ্ছায় এই পরিবেশে জন্মগ্রহণ করি নি। তবে এখানে থেকেও, নিজেদের এসবের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা যে আমাদের করে যেতে হবে তাতে সন্দেহ নেই; এটাই আমাদের জীবন আর এটাই আমাদের পরীক্ষা- স্কলাররা যেমন বলে থাকেন: Life is all about test! আমরা যে যেই দেশে জন্মগ্রহণ করেছি, কখনো যদি সেখানে ইসলাম মেনে জীবন যাপন করা অসম্ভব হয়, তবে আমরা হয়তো, ভালোভাবে ইসলাম অনুযায়ী জীবন যাপন করা যায় এমন কোন মুসলিম দেশে শরীয়তের বিধান অনুযায়ী হিজরত করার চেষ্টা করবো, যেখানকার অবস্থাটা আমাদের নিজের দেশের চেয়ে ভালো। কিন্তু নিজের দেশের পাঠ্যপুস্তকে অনৈসলামিক পাঠ্যবস্তু রয়েছে, এই অজুহাতে আমাদের আরেকটা বিদেশী ভাষা যা কিনা একাধারে পশ্চিমা বিধর্মীদের ভাষা এবং যা বস্তুবাদী নাস্তিক তথা খৃষ্টানদের worldview ধারণ করে সেটার শরণাপন্ন হতে হবে, এটা সত্যিই হাস্যকর একটা প্রচেষ্টা। আমরা “পহেলা বৈশাখের” অপসংস্কৃতিকে এড়িয়ে যেতে গিয়ে যদি নিজেদের জীবনে halloween, thanksgiving বা তুলার গোঁফ ওয়ালা Santa-র হাত থেকে উপহার গ্রহণ করার কুফরী সংস্কৃতি আমদানী করি, তবে তা কুফরের সাথে ঈমানের চলমান যুদ্ধে অহেতুক একটা বাড়তি ফ্রন্ট খোলার শামিল হবে আমরা আমাদের সন্তানদের একটার জায়গায় দুইটা মহামারীর জন্য উন্মুক্ত করে দেব। সেজন্যই আমি আগেই বলেছি, আবারো বলছি: অর্থ, সম্পদ, অবকাশ থাকলে আমরা মাতৃভাষার পরই চেষ্টা করবো কুর’আনের ভাষা, জান্নাতের ভাষা “আরবী” শিখতে। তবে যতটুকু ইংরেজী না শিখলেই নয় তা এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা যে বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়ার সময়তেই শিখে থাকে, তার দলিল তো আগেই উল্লেখ করেছি।
রচনাকাল: ২০১৩ ইংরেজী।
- Allah ﷻ er somporkito sokol pronoun e chondrobindu thakte hobe
- Rasulullah ﷺ er somporkito sokol pronouns e chondobindu thaka aboshshok
- I numbered the Foot notes in English, pls translate into bangla
. Require Correction
. Correct word (I don’t have Bangla writing facility so wrote in English, pls translate those into bangla)
. Marked in the Pdf version