সমুদ্রে জীবন -৯

একটা জাহাজের structure বা form কেমন, তার উপর নির্ভর করবে সে কি রকম দুলবে – সেই দোলাটা দ্রত লয়ে হবে না ধীর লয়ে হবে – আর সেই rolling বা pitching মানুষের কাছে সহনীয় হবে না অসহনীয় হবে তাও। আবশ্য কে কতটুকু দোলা-দুলি সহ্য করতে পারবেন, তা খানিকটা জন্মগতও বটে। এই জন্মগত ব্যাপারটাও আবার কখনো সময়ের সাথে সাথে সেরে যায় – আবার কারো ক্ষেত্রে যতই অভিজ্ঞতা হোক না কেন, কিছুতেই তা কাটতে চায় না! আমাদের একজন tough guy সিনিয়র ছিলেন – যার নিছক উপস্থিতিই জুনিয়রদের জন্য একটা ভয়ের ব্যাপার ছিলো। আমি তার সাথে কখনো sail করিনি, তবে আমার ব্যাচমেটরা যারা করেছে, তারা বলেছে যে, জাহাজে rolling/pitching শুরু হলে তার মুখটা শিশুদের মত অসহায় রূপ ধারন করতো। গড়ে মেয়েরা বেশী sea sick হয় – কেউ কেউ গোটা voyageই শুয়ে কাটায় – একদম মাথা তুলতে পারে না। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। একবার আমরা একটা জেনারেল কার্গো জাহাজে আমাদের এদিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছিলাম। জিব্রাল্টারের পর থেকে আটলান্টিকে একটানা প্রায় ৭/৮ দিন ৩০/৩৫ ডিগ্রী রোলিং হলো। তখন মেস রূমে খাবার খেতে ৫/৬ জন মাত্র আসতেন – তার ভিতর নিয়মিত একজন ছিলেন এক মহিলা – একজন অফিসারের স্ত্রী।

আমি যখন আমার জীবনের প্রথম বড় কন্টেইনার জাহাজে জয়েন করতে গিয়েছিলাম, তখন আমি যার কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছিলাম, সেই Polish ভদ্রলোককে জাহাজটা কেমন দোলাদুলি করে সে ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম । তিনি আমার day room বা বসার ঘরের এক কোণে অবস্থিত ইস্ত্রীর টেবিলের উপর রাখা ইস্ত্রী দেখিয়ে বলেছিলেন যে, তার ৪ মাসের কিছু বেশী সময়ের “কর্ম-কালে” ঐ টেবিল বা ঐ ইস্ত্রী ওরকমই থেকেছে – সরিয়ে রাখতে হয় নি। অর্থাৎ জাহাজখানি খুব stable তাই বোঝাতে চাইলেন। সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, ছোট জাহাজগুরোতে rolling/pitching বেশী অনুভূত হয় – যেমন মাছ ধরার ট্রলারের নাবিকদের জীবন সত্যিই ভীষণ শক্ত বা tough। সে দিক থেকে বড় কন্টেইনার জাহাজগুলোর জীবন বেশ সহনীয়। তবু সত্যিকার অর্থে খারাপ সমুদ্র হলে, বড় সাইজ যে খুব একটা কাজে আসে না – তা তো আমরা গত সংখ্যায় দেখেছি। আধুনিক প্যাসেঞ্জার লাইনার বা ক্রুজগুলোতে, প্যাসেঞ্জারদের স্বস্থির জন্য rolling কমানোর ব্যবস্থা হিসাবে না না রকম বাড়তি ব্যবস্থা নেয়া হয় – যেমন দু পাশে প্লেনের ডানা সদৃশ একটা ম্যকানিজম লাগানো থাকে যে গুলোকে Activated Fin Stabilizers বলে। যেগুলো নিয়ন্ত্রণ করে রোলিং কমানো হয়। সাধারণ কার্গো, বাল্ক ক্যারিয়ার বা কন্টেইনার জাহেজে ballast water-এর হেরফের করে rolling/pitching নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়। যারা এই প্রথম কোন জাহাজী গল্পের সাথে পরিচিত হচ্ছেন – তাদের অবগতির জন্য বলা আবশ্যক মনে করছি যে, rolling হচ্ছে জাহাজের ডানে ও বাঁয়ে যে দোলা-দুলি হয়ে থাকে তার জাহাজী নাম, pitching হচ্ছে সামনে-পেছনে যে দোলা-দুলি হয়ে থাকে তার নাম।

জাহাজগুলোতে সাধারণত দুইটি তলা থাকে। বাইরের আর ভিতরের তলদেশের মাঝখানের অংশটা ভাগ ভাগ করে অনেক কয়টা tank তৈরী করা হয় – এগুলোকে double bottom tanks (সংক্ষেপে db tanks) বলা হয়। এই tank গুলোতে জ্বালানী তেল, খাবার পানি, অন্যান্য ব্যবহারের মিঠা পানি ছাড়াও ballast water নেয়া হয়। প্রত্যেক প্রকারের তরলের জন্য tankগুলো নির্ধারিত থাকে – যেন এক প্রকারের সাথে আরেক প্রকারের সংমিশ্রন না ঘটে! প্রয়োজন অনুযায়ী জাহাজকে ভারী বা হালকা করতে অথবা জাহাজ একদিকে একটু হেলে থাকলে, তাকে “সোজা” করতে এই ballast water ব্যাবহার করা হয় – যা মূলত সমুদ্রের নোনা পানি। ধরুন বন্দরে একটা জাহাজের লোডিং শেষে দেখা গেলো যে, সে ডান দিকে ২ ডিগ্রী কাত হয়ে আছে। এখন বাঁ দিকের কোন একটা db (ballast) tank-এ সমুদ্র থেকে প্রয়োজন মত পানি পাম্প করে ঢুকিয়ে, জাহাজটাকে “সোজা” করা হবে। এই প্রক্রিয়াটাকে বলা হবে ballasting। জাহাজ (বিশেষত বাল্ক ক্যারিয়ার বা ট্যাঙ্কার ইত্যাদি) যখন খালি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায় – তখন বলা হয় যে জাহাজটি ballast-এ যাচ্ছে। “সমুদ্রে জীবন -৬”-তে ছবি দেয়া হয়েছে, সেখানে জাহাজটি ballast-এ কোথাও যাচ্ছে। এই ballasting-এর আরো ২ টা মুখ্য ভূমিকা রয়েছে। খুব technical details-এ না গিয়েও বলা যায় যে সেই দু’টো ভূমিকা হচ্ছে :
১) লোডিং এবং জাহাজ জুড়ে ওজনের distribution/allocation-এর উপর নির্ভর করে না না ধরনের জটিল stress তৈরী হয়। অনেক সময় এই stressগুলোর জন্যই, সমুদ্রে অনেক জাহাজই আড়া আড়িভাবে ২ টুকরা হয়ে যায়। এই দুই টুকরা হয়ে যাবার সম্ভাবনাটা, যে জাহাজ যত বেশী লম্বা হবে, তার বেলায় তত বেশী থাকবে।
২) যে কোন জাহাজের stability বজায় রাখতে ballasting-এর একটা বড় ভূমিকা থাকে। যে জাহাজের stability যত বেশী/ভালো, তার ডুবে/উল্টে যাবার সম্ভাবনা তত কম এবং vice-versa। সঠিক stability না থাকলে, একটা জাহাজ বন্দরের ভিতর দাঁড়ানো অবস্থায় বা বন্দরের ঢেউ হীন নিস্তরঙ্গ পানিতে চলা অবস্থায়ও ডুবে/উল্টে যেতে পারে।

আমরা ((আমাদের কোম্পানীর জাহাজগুলো) ফ্রান্সের Le Havre-এ যে বার্থে থাকতাম, একবার সেই বার্থে থাকা অবস্থায় শুনলাম যে, আমাদের ঠিক আগের (ঐ বার্থ থেকেই ১ দিন আগে sail করে যাওয়া ) জাহাজটি সমুদ্রে ২ টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়েছে। এ ধরনের দুর্ঘটনা সাধারণত দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া stress-এ কারণে হয়। আরেকবার আমরা যখন Malaysia-র Port Klang-এ গিয়েছিলাম, তখন দেখেছিলাম একটা ডুবে যাওয়া চীনা জাহাজের উদ্ধার প্রচেষ্টা চলছে – বার্থে দাঁড়ানো অবস্থায়ই জাহাজটা উল্টে গিয়ে ডুবে গিয়েছিল। এধরনের ঘটনা ঘটবে, যখন জাহাজের উপরের দিকটা নীচের চেয়ে ভারি হবে – ধরুন উপরের দিকে মালামাল রেখে, কোন জাহাজের নীচের দিককার মালামাল যদি প্রথমে খালাস করা হয় – অথবা, যদি জাহাজের হোল্ডের নীচের দিকটা খালি রেখে ওপরের কোন ডেকে লোড করা হয়। একটা Log Carrier-এ কাজ করার সময় পূর্ব Malaysia-র Miri-র anchorage-এ একবার আরেকটা Log Carrier-এর এধরনের বিপর্যয় স্বচক্ষে দেখছিলাম। Log Carrier-গুলো বড় বড় কাঠের গাছের কান্ড লোড করতে করতে ডেকের উপরও অনেকটা উঁচু করে লোড করে থাকে। কাঠ দু’ধরনের হয় sinker ও floater । পানির চেয়ে ভারী যেগুলো সেগুলো হচ্ছে sinker, আর হালকাগুলো floater। সাধারণত হোল্ডের ভিতরে নীচে ভারীগুলো থাকবে, আর, উপরে হালকাগুলো থাকবে – এই স্বাভাবিক নিয়ম মানার পরও, ডেকে কতটুকু উঁচু করে কার্গো নেয়া যাবে, সেটা বেশ সতর্ক ও সাবধানী হিসেবের ব্যাপার। কিন্তু অনেক সময় হিসাবে ভুল করলে অথবা “লোভের যোগান দিতে” বেশী লোড করলে বিপত্তি দেখা দিতে পারে! দেখলাম জাহাজটি হঠাৎ একদিকে মাত্রতিরিক্ত কাত হয়ে গেল। ঐ অবস্থায় সামান্য এদিক সেদিক হলে (ধরুন একটা বড় ঢেউ আসলেও) হয়তো জাহাজটা capsize করতে পারে।

আমি জীবনে ৫/৬ বার উল্লেখযোগ্য বড় ধরনের ঝড়ে পড়েছি – ২টা instance-এ মনে হয়েছিল,ঘরে নাও ফেরা হতে পারে। এর একটি ছিল আটলান্টিকে – জাহাজটা ছিল জাপানে নির্মিত মাত্র ৫/৬ মাস বয়সের একটা জেনারেল কার্গো জাহাজ। ঐ বার আমরা আমেরিকা থেকে ফিরে আসছিলাম এশিয়ার দিকে – আমার তৎকালীন কোম্পানী, ocean route বলে একটা “দিক নির্দেশনাদানকারী সংস্থাকে” পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করছিল – তারা আমাদের টেলেক্স/ফ্যাক্স ইত্যাদির মাধ্যমে বলে দেবে কোথায় নিম্নচাপ ইত্যাদি সৃষ্টি হচ্ছে – আর আমরা সেই মত দুর্যোগ এড়িয়ে তাদের দেয়া “রাস্তা” বেছে নিয়ে চলতে থাকবো। হঠাৎ একদিন আমাদেরই কেন্দ্র করে, আটলান্টিকের মাঝামাঝি জন্ম নিল একটি ঝড় – ocean route কিছু জানার বা জানানোর আগেই ঘটে গেল প্রলয় কান্ড। প্রায় দু’দিনেরও বেশী সময় ধরে, প্রচন্ড খারাপ আবহাওয়া ও উত্তাল সমুদ্রের মাঝে সময় কাটলো আমাদের । মাত্র ১৬,০০০ টন পণ্যবহনকারী ছোট্ট জাহাজটা যখন একেকটা বিশাল ঢেউয়ের চূড়ায় (crest-এ) উঠছিল, তখন তার গোটা “দেহে” এমন একটা “টেনশন” ছড়িয়ে পড়ছিল যে, মনে হচ্ছিল এই ভেঙ্গে পড়বে। জাহাজটা যখন ঢেউয়ের নিম্নভাগে (trough-এ) অবস্থান নিচ্ছিল, তখন আর দিগন্ত দেখা যাচ্ছিল না। ঐ সময় একটা অদ্ভূত feeling হচ্ছিল – সময়টা যেন এক এক সেকেন্ড করে পার হচ্ছিল – ভবিষ্যতের কোন চিন্তা ছিল না মাথায়। একটা সেকেন্ড পার হচ্ছিল আর মনে হচ্ছিল, আরো এক সেকেন্ড বাঁচা হলো। দেশের কথা, পরিবারের কথা কিছুই মনে হচ্ছিল না – কেবল সত্যিকার অর্থে space-time-এর বতর্মানে বেঁচে থাকার অনুভূতি! আমি জানিনা অন্যের এমন feeling হয় কি না, তবে আমার হয়েছিলো – ঐ বার এবং আরো একবার। আমাদের একটা হোল্ডে ১ লিটারের কার্ড-বোর্ডের ক্যানে প্যাক করা সাড়ে ৮ শত টন মোটর অয়েল ছিল – কার্টনের মত করে বাঁধা প্যালেটে – জেদ্দার উদ্দেশ্য নেয়া। সাধারণত সমুদ্র-মহাসমুদ্র পার হবার আগেই সব কার্গোর “ল্যাশিং” (শক্ত করে, নড়বে না মত করে বাঁধা) পরখ করে দেখা হয়। ঐ বার কি হয়েছিল ঠিক জানি না (আমি তখন জুনিয়রতম অফিসারদের একজন ছিলাম) – কোথাও সতর্কতায় একটা ফাঁক ছিল। পুরো সাড়ে আটশ টন কার্গো একদম চ্যাপ্টা হয়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ক্যানগুলোতে যে লুব্রিকেন্ট ছিল – তা বাড়তি ক্ষতি হিসেবে হোল্ডের ভিতর ছড়িয়ে ছিটিয়ে সেটাকে এমন নোংরা করলো যা পরিষ্কার করা রীতিমত সময় ও ব্যয় সাপেক্ষ কাজ হয়ে ওঠে। আমরা জেদ্দায় এলে, কর্তৃপক্ষ জাহাজ এ্যারেস্ট করে রাখলো বেশ কয়েকদিন – আমাদের কোম্পানী যতক্ষণ না নষ্ট কার্গোর লিখিত দায়ভার গ্রহণ করে। পরে শুনেছি আমাদের ঐ জাহাজের ক্যাপ্টেন ও চীফ অফিসারকে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে হয়েছিল কোর্টে হাজিরা দিতে – ইনসুরেন্স ক্লেইম সংক্রান্ত মামলার শুনানিতে!

আরেকবার যখন আমার ঐ ধরনের feeling হয়েছিল (অর্থাৎ, কেবল সত্যিকার অর্থে space-time-এর বতর্মানে বেঁচে থাকার অনুভূতি) তখন আমরা আমেরিকার উত্তর-পশ্চিমের ওয়াশিংটন স্টেট থেকে যাচ্ছিলাম ফিলিপিন্স। ঐ জাহাজটাও ছাট্ট ১৯,০০০ টন মালবাহী একটা ফ্রিডম- ক্লাস (জেনারেল কার্গো) জাহাজ ছিল এবং বেশ কয়েক বছরের পুরানো জাহাজ ছিল। দুরত্ব বাঁচাতে বা বলতে পারেন শর্ট-কাট নিতে আমরা আলাস্কা আর রাশিয়ার কোল ঘেঁষে – উত্তর মেরুর কাছাকাছি অঞ্চল দিয়ে আসছিলাম। এমনিতেই ঐ অঞ্চলটা সব সময়ই কেমন অন্ধকান মেঘাচ্ছন্ন থাকে – তারপর শীতকালে প্রায়ই উত্তর প‌্যাসিফিকে ঝড় ঝাপটা থাকে। ঐ বার হঠাৎ করেই আমাদের ঘিরে একটা ঝড়ের সূচনা হলো। ব্যস দিগন্ত আর দেখা যায় না – কেবল ঢেউ দেখা যায় এমন একটা অবস্থা! ঐ বারও মনে হয়েছিল বাড়ী ফেরা হবে কি না কে জানে। পুরানো, দুর্বল ও শ্লথ জাহাজে দুশ্চিন্তার কারণটা আরেকটু বেশী। আমি বিশ্বাসী, এবং আল্লাহ্ চাইলে যে কোন জায়গা থেকেই তিনি যে কাউকে বাঁচাতে পারেন। তবে কার্য-কারণ হিসাব করলে, ঐ সব জায়গায় জাহাজডুবিতে survival-এর chance একদম 0% বলা যায়! পানিতে পড়লে কোন উদ্ধার কাজের আগ ঠান্ডায়ই মৃত্যুবরণ করার কথা!

mariner77_1280114786_1-spn

[আমার জীবনের প্রথম বড় কন্টেইনার জাহাজটা দেখতে এরকম ছিল]

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *