সমুদ্রে জীবন – ৫

সমুদ্রে জীবনের আরেকটি বিষয়ে আলোকপাত করা হয় নি – সেটা হচ্ছে সমুদ্রে থাকা অবস্থায নাবিকদের, বা সোজা বাংলায় জাহাজীদের জীবনে কোন দুঘর্টনা ঘটলে বা শারীরিক অসুস্থতা দেখা দিলে কি পরিস্থিতির উদ্ভব হয় বা কি ভাবে সেগুলো মোকাবেলা করা হয়? প্রথমে on board [বা জাহাজে অবস্থানকারী] চিকিৎসকের কথা আলোচনা করা যাক! সাধারণত প্যাসেঞ্জার লাইনার বা Europe/America-য় Inter-Island/International Ferries ছাড়া, মালবাহী জাহাজগুলোতে ডিগ্রীধারী পেশাদার ডাক্তার থাকেন না! তবে জাহাজের যে কোন সার্টিফিকেটধারী অফিসারকেই একটা “ফার্স্ট এইড” প্রশিক্ষণ কোর্স করতে হয় – এবং পরীক্ষা দিয়ে এই বিষয়ে সার্টিফিকেট হাসিল করতে হয়, যা কি না mandatory। জাহাজে একজন designated মেডিক্যাল অফিসার থাকেন – যিনি হচ্ছেন জাহাজের 2nd mate বা 2nd Officer। জাহাজের Medical Locker বা ডিসপেন্সারী ও (সাধারণত) ১ বেডের হাসপাতালটি তার তত্ত্বাবধানে থাকে। জাহাজে থাকা অবস্থায় নাবিকরা তুলনামূলকভাবে কম রোগাক্রান্ত হয় – আর হলেও তা সাধারণ সর্দি-জ্বর জাতীয় ব্যাপারই হয়। তবে পোর্টে গেলে হয়তো কখনো পেটের অসুখ বা অন্য কোন সংক্রামক রোগ দেখা দিতে পারে। সমুদ্রে কারো অসুস্থতা দেখা দিলে তা প্রথমেই 2nd Officer-এর কাছে রিপোর্ট করতে হয়। অসুস্থতা সাধারণ হলে, 2nd Officer-এর ঔষধ দেয়াতেই তা শেষ হয়ে যায়। তা নাহলে তা ২টি ব্যাপারের একটিতে গড়ায়:
১) পরবর্তী বন্দরে ডাক্তার দেখানোর জন্য তার নাম sick list-এ নথিভূক্ত করা হয়।
আর তা না হলে
২) বিষয়টা যদি ইমর্জেন্সি হয়, তবে ক্যাপ্টেন Radio Medical Advice চেয়ে স্থলভাগের মেডিক্যাল সার্ভিস দেয়া স্টেশনসমূহের একটির কাছে উপদেশ চাইতে পারেন। কখনো বিশেষ জরুরী অবস্থায় প্রাণ রক্ষাকারী পদক্ষেপ হিসেবে, জাহাজের গতিপথ পরিবর্তন করে নিকটতম বন্দরে যেতে হতে পারে – অথবা রোগীকে airliftও করতে হতে পারে!

আমি যখন জুনিয়র rank-এর একজন অফিসার ছিলাম, তখন আমেরিকাগামী আমাদের জাহাজকে একবার গতিপথ পরিবর্তন করে জিব্রাল্টার বন্দরে যেতে হয়েছিল একটি দেড়/দুই বছরের শিশুকে ডাক্তার দেখানোর জন্য। এছাড়া একটা airlift-এর অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার জীবনে। আমাদের কোম্পানীতে জুনিয়রদের on board “সেফ্টি ট্রেনিং” দেবার জন্য একজন ভ্রাম্যমান safety superintendent থাকতেন – যিনি জাহাজ থেকে জাহাজে ঘুরে বেড়াতেন এবং প্রশিক্ষণের প্রয়োজনে জাহাজের সাথে কখনো ১৫/২০ দিন বা এমন কি ১ মাসও sail করতেন। এরা সাধারণত ক্যাপ্টেন বা প্রধান প্রকৌশলী rank-এর হতেন। এমনই একজন ইউরেশিয়ান (বাবা জার্মান, মা মালোয়েশিয়ান চাইনিজ) ক্যাপ্টেন একবার আমাদের সাথে safety superintendent হিসেবে sail করছিলেন। ঐ লাইনার জাহাজটির রুট ছিল: Laem Cha Bang (Thailand) – SingaporeSan Pedro (Long Beach – USA) – Oakland (USA) – Kaohsiung (Taiwan) – Hong KongSingapore Laem Cha Bang – ৪২ দিনের একটা loop। ভদ্রলোক আমাদের সাথে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া থেকে USA (San Pedro, Long Beach) পর্যন্ত গেলেন। খুবই হাসিখুশী ও প্রাণবন্ত একজন মানুষ। San Pedro-তে প্রায় ৩ দিন থাকার পর আমরা Oakland-এর পথে যাত্রা শুরু করলাম। San Pedro – Oakland ভয়েজের যাত্রা সময় মাত্র ১৬ ঘন্টা। এই ছোট্ট passage-এর মাঝেই ভদ্রলোকের হৃদরোগের উপসর্গ দেখা দিল – সদা প্রাণবন্ত মানুষটি মৃত্যুভয়ে নীল হয়ে গেলেন। Oakland পৌঁছাতে মাত্র কয়েক ঘন্টা বাকী থাকলেও, তাকে আর জাহাজে রাখা নিরাপদ মনে হলো না। US Coast Guard-কে ডাকা হলো – তাদের হেলিকপ্টারে করে তাকে San Francisco-তে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। আমরা জাহাজে নিয়মিত কিছু safety/emergency drill করে থাকি – যার অন্যতম একটি হচ্ছে Helicopter Evacuation। মাত্র ৫/৬ দিন আগেই ঐ জাহাজে ঐ ভদ্রলোকের তত্ত্বাবধানে আমরা Helicopter Evacuation-এর drill করেছিলাম – ব্যাপারটা কি ironical তাই না?? Oakland থেকে আমরা যখন এশিয়ার দিকে প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দেবার যাত্রা শুরু করলাম, তখনও তিনি হাসপাতালে। তিনি ভাগ্যবান যে, তার জীবনের ঐ ক্রান্তিলগ্নে আমরা coasting করছিলাম – আমেরিকার উপকূলে ছিলাম। গভীর সমুদ্রে থাকলে কি হতো কে জানে?

আমার জীবনে জাহাজ ডুবির কোন first hand অভিজ্ঞতা নেই – তবে যাদের আছে, তাদের কয়েকজনের সাথে আমি sail করেছি। এমন একজন ছিলেন আমার অধীনস্ত অবস্থানে কাজ করা এক ভারতীয় বাঙালী অফিসার (যার বাবার বাড়ী এক কালে বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জে ছিল)। তার জাহাজ Bay of Biscay -তে ডুবে গিয়েছিল। উত্তাল তরঙ্গ ও খারাপ আবহাওয়ার জন্য কুখ্যাত এই উপ-সাগর থেকে স্প্যানিশ কোস্টগার্ডের হেলিকপ্টার তাকে যখন উদ্ধার করেছিল, তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল – poor visibility-র জন্য তারা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, ওটাই হবে তাদের শেষ “উদ্ধার-রাউন্ড”। কোলকাতায় তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী ও পরিবারকে জাহাজডুবিতে তার মৃত্যুর খবর জানানোর অনেক পরে তারা জেনেছিলেন যে, উদ্ধার করা গুটি কয়েকের মাঝে তাদের মানুষটিও একজন!

2

পানামা ক্যানেল দিয়ে যাবার সময় (আনুমানিক ৪৫০০০ টনের) এই হ্যান্ডি সাইজের “বাল্ক ক্যারিয়ার”টির ধাক্কা লাগে অপর একটি জাহাজের সাথে এবং এর সামনের হোল্ডটি ফুটো হয়ে গিয়ে তাতে পানি ঢুকে যায়। সামনের হোল্ডে কার্গো হিসাবে স্টিল কয়েল ছিল। কর্তৃপক্ষ আপ্রাণ চেষ্টা করছেন জাহাজটি যেন ডুবে না যায়। একদিকে পানি পাম্প আউট করে এবং অপর দিকে ক্ষতিগ্রস্ত হোল্ড থেকে কার্গো খালাস করে সেই প্রচেষ্টাই চলছে। জাহাজটা ডুবে গেলে ক্যানেলের ভিতর দিয়ে জাহাজ চলাচলে এমন বিঘ্ন ঘটবে, যা পানামার জন্য বিশাল এক অর্থনৈতিক disaster হয়ে দাঁড়াতে পারে।
পাশ দিয়ে যেতে যেতে কি মনে করে সেদিন আমি ছবিটা তুলেছিলাম – কে জানতো যে ছবি আসলে আপনাদের জন্য তোলা হচ্ছে??

3

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *