রাসূলের (সা.) ভূমিকাসমূহ – ৪
[এই পোস্টটা, যারা seriously ইসলাম সম্বন্ধে জানতে চান, তাদের জন্য। আমরা যখন প্রায় “নাস্তিক” একটা মস্তিষ্ক নিয়ে বড় হচ্ছিলাম, তখন চাইলেও ইসলাম সম্বন্ধে জানার তেমন সুযোগ ছিল না – বলা যায়: আজকের মত সহজলভ্য source বা resource কোনটাই তখন ছিল না। আজ তাই যারা “searching souls” – তাদের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য পৌঁছে দিতে বড় ইচ্ছা করে।]
[এই সিরিজের আগের লেখাটা রয়েছে এখানে:
আমরা ইনশাল্লাহ্ রাসূল (সা.)-এঁর ৪টি প্রধান ভূমিকা সামনে রেখে আলোচনা করবো :
১)কুর’আনের ব্যাখ্যাকারী
২)স্বনির্ভর আইনপ্রণেতা
৩)নিখুঁত উদাহরণ
এবং
৪)যার আনুগত্য করতে হবে এমন ব্যক্তি।
(২)
এক স্বনির্ভর আইনের উৎস হিসেবে আল্লাহর রাসূলের (সা.) ভূমিকা
আল্লাহর রাসূলের (সা.) ভূমিকাগুলোর একটি ছিল ‘আইনের উৎস’ হিসেবে কাজ করা এবং তিনি যেসব অধ্যাদেশ জারী করে গেছেন, সেগুলোকে অবশ্যই ইসলামী আইন ও শরীয়ার অংশ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। অন্য কথায় বলতে গেলে আল্লাহর কাছ থেকে আসা কিছু আদেশ এবং নির্দেশ কেবলমাত্র নবীর (সা.) মুখ থেকে জানা যায় – যেগুলো স্বনির্ভর, অর্থাৎ, কুর’আনের মাধ্যমে যা নাযিল হয়েছে তার বাইরে।
নবী (সা.) নিজেই এটা পরিষ্কার করে দিয়ে গেছেন যে, নতুন আইন ও নিয়ম প্রণয়ন করা ছিল তাঁর দায়িত্বসমূহের একটি এবং মুসলিমদের উচিত তাঁকে সেই অধিকার ও দায়িত্ব সম্পন্ন একজন হিসেবে দেখা। ইতিপূর্বে উল্লিখিত একটি হাদীসের বর্ণনায় এসেছে যে, আল্লাহর রাসূল(সা.) গৃহপালতি গাধার মাংস নিষিদ্ধ করেন এবং তারপর জোর দিয়ে বলেন:
“শীগ্রই এমন একটা সময় আসবে, যখন একজন মানুষকে তার বিছানায় হেলান দেওয়া অবস্থায় পাওয়া যাবে এবং তাকে আমার একটা হাদীস সম্পর্কে বলা হবে এবং [তখন] সে বলবে, ‘তোমাদের ও আমাদের মাঝে আল্লাহর কিতাব রয়েছে। আমরা সেখানে যা অনুমোদিত পাই তা অনুমোদন করি। আর সেখানে যা নিষিদ্ধ দেখতে পাই, তা নিষিদ্ধ করি।’ কিন্তু আসলে আল্লাহর রাসূল (সা.) যা নিষিদ্ধ করেছেন, তা আল্লাহ যা নিষিদ্ধ করেছেন তার মতই। ” (বাইহাক্বী, আহমাদ, তিরমিযী ও ইবন মাজাহ – আলবানীর মতে সহীহ)।
পূর্ববর্তী পৃষ্ঠাগুলোতে এমন উদাহরণ রয়েছে, যেগুলোতে দেখা যায় যে, নবী (সা.) এমন একটি আইন বা অনুশাসনের ঘোষণা দিয়েছেন যা কুর’আনে পাওয়া যায় না। আল্লাহ, যিনি সর্বোচ্চ এবং সবকিছু জানেন, তিনি ইসলামের সকল আইন কানুনকে কুর’আনের অন্তর্ভূক্ত করেন নি। ইসলামী আইন কানুনের কিছু কিছু আল্লাহ কেবল তাঁর রাসূলের (সা.) বক্তব্য ও কাজের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আল্লাহ কুর’আনে বলেন:
“সেই সমস্ত লোক, যারা এই রাসূলের আনুগত্য করে, যিনি নিরর নবী, যাঁর সম্পর্কে তারা নিজেদের কাছে রক্ষিত ইনজীল ও তাওরাতে দেখতে পায়, তিনি তাদেরকে সৎকর্মের নির্দেশ দেন, অসৎকর্ম থেকে বারণ করেন; তাদের জন্য যাবতীয় পবিত্র বস্তু হালাল বলে ঘোষণা করেন ও হারাম বস্তুসমূহ নিষিদ্ধ করেন এবং তাদের উপর থেকে সেই বোঝা নামিয়ে দেন এবং বন্দীত্ব অপসারণ করেন যা তাদের উপর বিদ্যমান ছিল। সুতরাং যেসব লোক তাঁর উপর ঈমান এনেছে, তাঁর সাহচর্য অবলম্বণ করেছে, তাঁকে সাহায্য করেছে এবং সেই নূরের অনুসরণ করেছে যা তাঁর সাথে অবতীর্ণ হয়েছে, শুধুমাত্র তারাই সফলতা অর্জন করতে পেরেছে।” (সূরা আ’রাফ, ৭:১৫৭)।
এই আয়াত হচ্ছে আল্লাহর রাসূলের (সা.) একটা বর্ণনা। এখানে আল্লাহ রাসূলকে (সা.) এমন একজন বলে বর্ণনা করেন যিনি ‘তাদের জন্য যাবতীয় পবিত্র বস্তু হালাল বলে ঘোষণা করেন ও হারাম বস্তুসমূহ নিষিদ্ধ করেন এবং তাদের উপর থেকে সেই বোঝা নামিয়ে দেন এবং বন্দীত্ব অপসারণ করেন যা তাদের উপর বিদ্যমান ছিল।…..।’ এটা এজন্য যে, আল্লাহর রাসূলকে (সা.) আল্লাহ নিজেই তাঁর অনুপ্রেরণার আওতায় আদেশ, নিষেধ ও আইন প্রণয়নের দায়িত্ব দান করেছেন। এভাবেই আল্লাহর রাসুল (সা.) যা আদেশ করেছেন, তা আল্লাহ যা আদেশ করেছেন তার সমপর্যায়ের বলে গণ্য হয়(কুর’আন ৪:৮০ যেমন বলে)। ওসমানী আরো একটা ব্যাপারের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করেন যে, আয়াতের শেষে আল্লাহ নবীর (সা.) সাথে পাঠানো নূরের অনুসরণ করার কথা বলেন। আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে তাঁর কিতাবের কথা বলেছেন, যার ভিতর সব দিকনির্দেশনা অন্তর্ভূক্ত – কিতাব এবং হিকমাহ দুটোই – যা নবী (সা.) আল্লাহর কাছ থেকে লাভ করেছিলেন।
আল-বাইহাক্বী লিপিবদ্ধ করেছেন যে, ইমরান বিন হোসেন নবীর (সা.) মধ্যস্থতার কথা উল্লেখ করলেন। এক ব্যক্তি তাঁকে বললো, [ “হে আবু নাজিদ, তুমি এমন হাদীস বর্ণনা করো যেগুলোর (বিষয়বস্তু সংক্রান্ত) আলোচনা কুর’আনে পাওয়া যায় না।” ইমরান রেগে গেলেন এবং ঐ ব্যক্তিকে বললেন, “তুমি কি কুর’আন পড়েছো?” ঐ ব্যক্তি উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ’। ইমরান তাকে বললেন, “তুমি কি সেখানে পেয়েছো যে রাতের সালাত চার রাকাত এবং মাগরিবের সালাত তিন রাকাত এবং ফজরের সালাত দুই রাকাত এবং যোহরের সালাত চার রাকাত এবং আসরের সালাত চার রাকাত?” ইমরান তাকে আরো বললেন, “তুমি কার কাছ থেকে নিয়মকানুন পাও? তুমি কি সেগুলো আল্লাহর রাসূলের (সা.) কাছ থেকে পাও না?”
কোন মুসলিমের এমন দাবী করা উচিত নয় যে, ফজরের সালাত দুই রাকাত হওয়াটা ইসলামী আইনের অন্তর্ভূক্ত নয়, কেননা সেটা স্পষ্টত কুর’আনে উল্লেখ করা হয় নি। সুতরাং এ কথাটা মানতে যে কেউ বাধ্য যে, এই নিয়মটা কুর’আন থেকে আসেনি বরং তা আল্লাহর রাসূলের (সা.) কাছ থেকে এসেছে। আর তাই তিনি হচ্ছেন আইনের এক স্বনির্ভর উৎস।
[sb](কক)নবীর (সা.) আইন প্রণয়নের ব্যাপারে আল্লাহর অনুমোদন
নবীর (সা.) এই ভূমিকার ব্যাপারে আল্লাহর অনুমোদন এবং তাঁর মর্যাদার ব্যাপারটা, এমন সব আনুষ্ঠানিকতা যেগুলো নিশ্চিতভাবেই ইসলামের একটা অংশ বলে বিবেচিত হয় – যেগুলো নবী (সা.) প্রথমে শুরু করেছিলেন এবং আল্লাহ পরে কুর’আনে সেগুলো সমর্থন করেছিলেন – এসব দ্বারা আরো প্রতিষ্ঠিত। {অবশ্যই নবীর (সা.) এ সমস্ত কাজের অনুপ্রেরণা ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ}উদাহরণস্বরূপ সেই জানাজার সালাত যার কথা সূরা আত – সূরা তাওবায় উল্লেখ করা হয়েছে:
“আর তাদের মধ্য থেকে [মুনাফিকদের মধ্য থেকে] কারো মৃত্যু হলে আর কখনো সালাত আদায় করবেন না এবং তার কবরে দাঁড়াবেন না..।” (আত-তাওবা, ৯:৮৪)
এই আয়াত জানাজার সালাত সম্বন্ধে নাযিল হয়েছে বলে সাধারণভাবে বোঝা হয়। এই আয়াতের উপর মন্তব্য করতে গিয়ে হাবিবুর রহমান আজামী বলেন:
”এই আয়াতের নিহিতার্থ হচ্ছে এই যে, জানাজার আনুষ্ঠানিকতা সম্পাদন করা তখন শুরু হযে গিয়েছিল এবং নবী (সা.) এই আয়াত নাযিল হওযার পূর্বেই মৃতদেহ সমাহিত করার আগে জানাজার সালাত সম্পাদন করতেন; অথচ, এই আয়াতের পূর্বে নাযিল হওয়া এমন কোন আয়াতের উদাহরণ পাওয়া যায় না, যেখানে জানাজার আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপারে নবীকে (সা.) এবং মুসলিমদের কোন নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এখান থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয় যে জানাজার আনুষ্ঠানিকতার আদেশ সুন্নাহর মাধ্যমেই দেওয়া হয়েছিল। ”
হাবিবুর রহমান আজামী আর একটা উদাহরণ দিতে গিয়ে আযানের কথা বলেন। তিনি বলেন:
“এমন কেউ নেই যে নিজেকে একজন মুসলিম হিসেবে দাবী করে অথচ আযান বা সালাতের জন্য দেয়া ডাক, যা নবীর (সা.) সময় থেকে এই পর্যন্ত মুসলিমরা অনুসরণ করে চলেছেন – সেটা যে একটা ধর্মীয় আচার তা অস্বীকার করে। কুর’আনে আযানের কথা একবার উল্লিখিত হয়েছে সূরা আল মায়িদায় – নির্বোধ, অবিশ্বাসীরা যে বিদ্রুপাত্মকভাবে এটাকে অনুসরণ করে এবং ঠাট্টার অভিব্যক্তি দেখিয়ে এটাকে উপহাস করে, সেটা বলতে গিয়ে। এবং আর একটা প্রসঙ্গে সূরা জুমুআয় এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর একটি আদেশের সাথে সম্পৃক্ততা সহকারে…। যদিও এই আয়াতগুলো থেকে জানা যায় যে, আযান তখনকার মুসলিমদের ভিতরে একটা প্রতিষ্ঠিত প্রথা ছিল, কিন্তু কুর’আনে এমন একটি আয়াতও খুঁজে পাওয়া যাবেনা, যার মাধ্যমে আযানকে বিশ্বাসীদের জন্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। এটা স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায় যে, আযানের নির্দেশ কুর’আনের মাধ্যমে দেওয়া হয়নি, কিন্তু সুন্নাহর মাধ্যমে দেওয়া হয়েছিল।”
উপরের আলোচনার উদ্দেশ্য হচ্ছে এটা দেখানো যে, নবী (সা.) যা কিছুকে দ্বীনের অংশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন, তা আল্লাহ কর্তৃক অনুমোদিত। উপরের দুটো উদাহরণে নবী (সা.) যেসব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেরকমের কিছু প্রথার স্পষ্ট অনুমোদন পরিলক্ষিত হয়। কুর’আনে পাওয়া যায় না এ ধরণের কর্মকান্ড প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে কুর’আনের কোথাও নবীর (সা.) বিরূদ্ধে কোন বক্তব্য কেউ খুঁজে পাবেনা। উপরন্তু শেষ নবী, যাঁর বাণী এবং শিক্ষা কিয়ামত পর্যন্ত সবার জন্য প্রযোজ্য থাকবে, তিনি যদি এমন কোন বক্তব্য রাখতেন অথবা এমন কোন প্রথা প্রতিষ্ঠিত করতেন, যা দ্বারা দ্বীনের একটা অংশ গঠিত হওয়ার কথা ছিল না, তাহলে যে কেউ আশা করতে পারতো যে, আল্লাহ নিশ্চয়ই পরিষ্কারভাবে এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় দেখিয়ে দিতেন যে, ঐ সব আচরণগুলো দ্বীনের কোন অংশ নয় – অথবা – নবীর(সা.) দ্বীনের কোন প্রথা প্রতিষ্ঠিত করার অধিকার নেই। কেউ এ ধরণের কিছুই খুঁজে পাবে না। বাস্তবে যে কেউ কেবল উল্টোটাই খুঁজে পাবে: পূর্বে উদ্ধৃত বহু আয়াত যেগুলোতে নবী তাদের যে নির্দেশ দিয়েছেন, তা মেনে নেয়ার এবং অনুসরণ করার ব্যাপারে মুসলিমদের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। সেগুলোর সাথে সাথে বরং নবী যা প্রতিষ্ঠিত করেছেন সেগুলোর অনুমোদন বা স্বীকৃতি দেখতে পাওয়া যায়।
(খখ)কুর’আনে কোন ভিত্তি নেই এমন একটি সুন্নাহ
কুর’আনের সাথে সম্পর্কের নিরিখে স্কলারগণ সুন্নাহকে তিনভাগে ভাগ করেছেন:
১> এমন সুন্নাহ যা কিনা কুর’আনে যা রয়েছে তার উপর গুরুত্ব আরোপ করে কিংবা তাকে সমর্থন করে।
২> এমন সুন্নাহ যা কুর’আনে যেসব আদেশ নিষেধ রয়েছে সেগুলোকে ব্যাখ্যা করে।
৩> এমন সুন্নাহ, খোদ কুর’আনে যার কোন ভিত্তি নেই।
ইমাম আল শাফিঈ বলেন: “আমি এমন কোন স্কলারকে জনিনা, যিনি এই কথাটা মানেন না যে, নবীর সুন্নাহ তিনটি শ্রেণীর একটিতে পড়ে, যার দুটোর ব্যাপারে সকলের ঐক্যমত রয়েছে। …. প্রথম [শ্রেণীতে রয়েছে], এমন কর্মকান্ড যেগুলোর ব্যাপারে আল্লাহ তাঁর কিতাবে অনুমোদন দিয়েছেন – রাসূল (সা.) কেবল কিতাবে যা রয়েছে তা পরিষ্কারভাবে সুনির্দিষ্ট করে দিয়ে গিয়েছেন। দ্বিতীয় [শ্রেণীতে রয়েছে], আল্লাহর কিতাবে বর্ণিত রয়েছে এমন জটিল বিষয়সমূহ – নবী সেগুলোর প্রযোজ্য অর্থ নির্দিষ্টভাবে বলে গেছেন। এগুলো হচ্ছে সেই দুটো শ্রেণীর সুন্নাহ, যে ব্যাপারে স্কলাররা মতানৈক্য পোষণ করেন না। তৃতীয় শ্রেণীতে রয়েছে এমন সব বিষয় যেগুলো রাসূলের (সা.) সুন্নাহয় তিনি প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন এবং যেগুলো সম্বন্ধে [আল্লাহর] কিতাবে কোন বক্তব্য নেই।”
প্রথম দুটো শ্রেণীর ব্যাপারে সকল স্কলাররা একমত। তৃতীয় শ্রেণীর ব্যাপারে কিছু মতনৈক্য রয়েছে। বেশীর ভাগ স্কলারই তৃতীয় শ্রেণীর অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন। এ ব্যাপারে উদাহরণ দিতে গিয়ে তারা নিম্নলিখিত অনুশাসনগুলো উল্লেখ করেন যেগুলোর ব্যাপারে দৃশ্যত কুর’আনে কোন উৎস নেই: অবিবাহিত ব্যাভিচারীকে এক বছরের জন্য নির্বাসনের বাধ্যবাধকতা, রমাদান মাসে দিবাভাগে সংসর্গে লিপ্ত হবার কাফফারা, সোনা ও রেশম পরিধানের ব্যাপারে পুরুষের উপর নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি। আসলে সকল স্কলারই স্বীকার করেন যে, এই ধরণের সুন্নাহর অস্তিত্ব রয়েছে। তাদের কিছু অবশ্য দাবী করেন যে এমনকি এগুলোর উৎসও খুঁজতে গিয়ে কুর’আনে পৌঁছা যাবে।
যাঁরা বিশ্বাস করেন যে এমনকি এই তৃতীয় শ্রেণীর সুন্নাহর উৎসও কুর’আনে খুঁজে পাওয়া যাবে, তাঁদের মধ্যে একজন হচ্ছেন আল শাতিবী। তিনি বলেন:
“সুন্নাহর মর্মার্থ সবসময় আল্লাহর কিতাবের উৎসমূলে ফিরে যায় – কেননা এটা হচ্ছে কুর’আন যা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেনি তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা, জটিল বিষয়ের ব্যাখ্যা এবং যা কিছুকে তা (কুর’আন) সংক্ষেপে ছুঁয়ে গেছে তার ব্যাখ্যা। এটা এমন যে, এটা [সুন্নাহ] হচ্ছে কেবলই কিতাবের ব্যাখ্যা। আর আল্লাহর বাণীতে এ ব্যাপারটা ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, ‘আমরা তোমার কাছে কুর’আন নাযিল করেছি মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য যা তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছিল।’ (সূরা নাহল, ১৬:৪৪)। সুন্নাহতে এমন কোন আদেশ পাওয়া যায় না, যার অর্থ হয় একটি সাধারণ না হয় একটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশের মাধ্যমে কুর’আন কর্তৃক চিহ্নিত না হয়েছে।”
এই শতাব্দীর ইসলামী আইনতত্ত্বের একজন বিশেষজ্ঞ মুহাম্মাদ আবু জাহরা বলেন:
“কেউ কদাচিৎ সুন্নাহর এমন কোন অনুশাসনের উদাহরণ খুঁজে পাবে যার ব্যাপারে কুর’আনের প্রত্য বা পরো কোন সূত্র নেই।”
আবার এসব স্কলাররা এটা স্বীকার করবেন যে, কেউ এমন কোন সুন্নাহ খুঁজে পাবে, কুর’আনে যেটার কোন সরাসরি উৎস নেই। তারা আসলে যা দাবী করছেন তা হচ্ছে এই যে, কেউ যদি খোঁজ করে এবং গভীরভাবে চিন্তা গবেষণা করে, তাহলে প্রতিটি সুন্নাহর ব্যাপারেই তারা কুর’আনের এমন একটি আয়াত খুঁজে পাবে যা কোন না কোনভাবে নবীর সেই সুন্নাহর প্রতি ইঙ্গিত করে – যদিও বা সেই ইঙ্গিত খুব অস্পষ্টও হয়। এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, আল-শাতিবী এবং আবু জাহরার মতামত হচ্ছে দুর্বলতম মত। কখনো কখনো তাদের তত্ত্বকে গ্রহণযোগ্যতা দিতে, তাদেরকে যে অনেক দূরে সরে যেতে হয়েছে – সেটা স্বীকার করতে এমনকি আল-শাতিবী বাধ্য হয়েছেন।
কিন্তু তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে এই যে, নবীর (সা.) আনুগত্য করার ব্যাপারে কুর’আনের আদেশ হচ্ছে এক শর্তহীন আদেশ। অর্থাৎ, তিনি যা কিছু প্রচার করেছেন – তা কুর’আনের ব্যাখ্যাই হোক অথবা নতুন কোন আইন প্রণয়নই হোক – সব ব্যাপারেই তার আনুগত্য করা আবশ্যক।
আল সিয়াবী, আল তুর্কী এবং অন্যান্যরা যেমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন – বাস্তবে এ ব্যাপারে মতপার্থক্য হচ্ছে কেবলই শাব্দিক। অন্য কথায় বলতে গেলে, স্কলারদের উভয় পই সুন্নাহয় যা কিছু পাওয়া যায় তা গ্রহণ করেন। তাদের কেউই কখনোই এমন দাবী করেন নি যে, তিনি একটি সুন্নাহকে কেবল তখনই মানবেন, যদি তিনি সে সম্মন্ধে গবেষণা করে কুর’আনে সেটার উৎস খুঁজে পান।
প্রতিটি সুন্নাহরই কুর’আনে একটি ভিত্তি থাকবে এই মতের দুর্বলতা অনুধাবন করাটা কেন গুরুত্বপূর্ণ সেটা আলোচনা করা উচিত। এই মত, মানুষজনের জন্য এমন দাবী করার সুযোগ করে দেয় যে, কোন নির্দিষ্ট সুন্নাহর ব্যাপারে যদি কুর’আনে সংশ্লিষ্ট উৎস খুঁজে না পাওয়া যায়, তবে কাউকে আর সেটার অনুসরণ করতে হবে না। অপর কথায়, একটি হাদীসে যা রয়েছে, কুর’আনে তার কোন ভিত্তি নেই – তাদের এই দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে তারা ঐ হাদীস অনুসরণ করতে অস্বীকার করতে পারে – এই যুক্তি উপস্থাপন করে যে, ইসলামের ভিত্তি হচ্ছে কুর’আন এবং প্রতিটি অনুশাসনের কুর’আনে অবশ্যই কোন উৎস থাকতে হবে।
যদিও কখনো কখনো মানুষ এই যুক্তির শরণাপন্ন হয়, তবুও এই ধরণের যুক্তিতর্ক ভ্রান্ত। নবী (সা.) নিজে একটি হাদীসে এই ব্যাপারে সাবধান করে দিয়ে গেছেন যা আমরা ইতোমধ্যেই উদ্ধৃত করেছি: “শীগ্রই এমন একটা সময় আসবে, যখন একজন মানুষকে তার বিছানায় হেলান দেওয়া অবস্থায় পাওয়া যাবে এবং তাকে আমার একটা হাদীস সম্পর্কে বলা হবে এবং [তখন] সে বলবে, ‘তোমাদের ও আমাদের মাঝে আল্লাহর কিতাব রয়েছে। আমরা সেখানে যা অনুমোদিত পাই তা অনুমোদন করি। আর সেখানে যা নিষিদ্ধ দেখতে পাই, তা নিষিদ্ধ করি।’ কিন্তু আসলে আল্লাহর রাসূল (সা.) যা নিষিদ্ধ করেছেন, তা আল্লাহ যা নিষিদ্ধ করেছেন তার মতই। ” (বাইহাক্বী, আহমাদ, তিরমিযী ও ইবন মাজাহ – আলবনীর মতে সহীহ)। যেহেতু আল্লাহর রাসূল (সা.) ইসলামী আইনের এক স্বাধীন উৎস, সেহেতু কেউ এমন কিছু সুন্নত কর্মকান্ডের জ্ঞান লাভ করতে পারে, যার কুর’আনে কোন উৎস নেই বলে -অথবা- সে সম্মন্ধে কুর’আনে কোন সংশ্লিষ্ট বক্তব্য নেই বলে মনে হতে পারে। এ ব্যাপারে ইমাম শাফিঈ বলেন:
“যে সব বিষয়ে আল্লাহর কিতাবে বক্তব্য রয়েছে সেগুলো এবং অন্যান্য বিষয়ে যেগুলোর ব্যাপারে সেখানে কোন নির্দিষ্ট বক্তব্য নেই, সেসবের জন্যও নবী (সা.) সুন্নাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি যা কিছুকে সুন্নাহ বলে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন, আল্লাহ আমাদের সেগুলো মেনে চলতে বলেছেন এবং তিনি [আল্লাহ] তাঁর [নবীর (সা.)] প্রতি আনুগত্যকে তাঁর নিজের প্রতি আনুগত্য বলে গণ্য করেন। এবং তাঁকে মান্য করতে অস্বীকার করাকে তাঁর [আল্লাহর] প্রতি অবাধ্যতা বলে গণ্য করেন। সেজন্য কোন মানুষকে ক্ষমা করা হবে না।”
সবশেষে, আল-আমিন বলেন যে, এমন যদি কোন সুন্নাহ না থাকতো যেগুলোকে কোন না কোন ভাবে কুর’আনের আয়াতসমূহ থেকে বের করে আনা হয়নি, তাহলে নবীকে (সা.) মেনে চলার ধারণাটার কোন তাৎপর্যই থাকতো না। অপর কথায়, যে কেউ বাস্তবে তখন কেবল কুর’আনেরই আনুগত্য করতো, নবীর নয় – কেননা তিনি যাই আদেশ করতেন, তার উৎস হতো কুর’আনের সংশ্লিষ্ট কোন আয়াত। সেক্ষেত্রে কুর’আনের বহু সংখ্যক আয়াত যেগুলোতে নবীর (সা.) আনুগত্য করার আদেশ দেয়া হয়েছে সেগুলো বাহুল্য ও অর্থহীন হয়ে যেতো।
[Page#127~135, The Authority and Importance of Sunnah – Jamaal al-Din M. Zarabozo থেকে অনুদিত।]