রাসূলের (সা.) ভূমিকাসমূহ – শেষ পর্ব
[এই পোস্টটা, যারা seriously ইসলাম সম্বন্ধে জানতে চান, তাদের জন্য। আমরা যখন প্রায় “নাস্তিক” একটা মস্তিষ্ক নিয়ে বড় হচ্ছিলাম, তখন চাইলেও ইসলাম সম্বন্ধে জানার তেমন সুযোগ ছিল না – বলা যায়: আজকের মত সহজলভ্য source বা resource কোনটাই তখন ছিল না। আজ তাই যারা “searching souls” – তাদের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য পৌঁছে দিতে বড় ইচ্ছা করে।]
[এই সিরিজের এর আগের লেখাগুলো রয়েছে এখানে:
- রাসূলের (সা.) ভূমিকাসমূহ –৫
- রাসূলের (সা.) ভূমিকাসমূহ – ৪
- রাসূলের (সা.) ভূমিকাসমূহ – ৩
- রাসূলের (সা.) ভূমিকাসমূহ – ২
- রাসূলের (সা.) ভূমিকাসমূহ – ১ ]
আমরা ইনশাল্লাহ্, আগের আলোচনার ধারাবাহিকতায়, রাসূল (সা.)-এঁর ৪টি প্রধান ভূমিকা সামনে রেখে আলোচনা করবো :
১)কুর’আনের ব্যাখ্যাকারী
২)স্বনির্ভর আইনপ্রণেতা
৩)নিখুঁত উদাহরণ
এবং
৪)যার আনুগত্য করতে হবে এমন ব্যক্তি।
(৪) যার আনুগত্য করতে হবে এমন ব্যক্তি -অর্থাৎ-আনুগত্যের দাবীদার হিসেবে নবীর (সা.) ভূমিকা
রাসূল (সা.) এঁর শেষ ভূমিকা যেটা আমরা এখানে আলোচনা করবো সেটা হচ্ছে এই যে, আল্লাহ নবীকে (সা.) এমন এক ব্যক্তি হিসেবে প্রেরণ করেছেন, আমাদেরকে যাঁর আনুগত্য করতেই হবে। আল্লাহ কুর’আনে বলেন:
“আমরা কখনোই এমন কোন রাসূল প্রেরণ করিনি, আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে, যার আনুগত্য করতে হবেনা।” (সূরা নিসা, ৪:৬৪)
ইসলামের বাণীকে আল্লাহ এক স্পষ্ট ও সুন্দর উপায়ে প্রেরণ করেছেন, যাতে, সমগ্র মানবকুল আল্লাহর ডাকে এবং তাঁর দিক নির্দেশনার প্রতি সাড়া দেয়। সত্য এবং মিথ্যার মাঝে থেকে বেছে নেবার স্বাধীনতা আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন। আল্লাহ কুর’আনে বলেছেন:
“তিনিই মহিমান্বিত, সর্বময় কর্তৃত্ব যাঁর; তিনি সব বিষয়ে সর্বশক্তিমান। তিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম। তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।” (সূরা মূলক, ৬৭:১-২)
আল্লাহ যেভাবে মানবকুলকে সৃষ্টি করে পরীক্ষা করেছেন যে, তারা তাঁর কিতাব অনুসরণ করছে কিনা, একইভাবে তিনি পরীক্ষা করে দেখছেন যে, তারা তাঁর নবীর সুন্নাহ অনুসরণ করে কিনা এবং তা মেনে চলে কিনা। তারা যে বিশ্বাসী, এটা কেবল তাদের জিহ্বা দ্বারা দাবী করাটা পর্যাপ্ত নয়, বরং কুর’আন এবং সুন্নাহর পরিপূর্ণ সত্যের কাছে নিজেদেরকে স্বেচ্ছায় পূর্ণ সমর্পণের মাধ্যমে তাদেরকে নিজেদের দাবীর সত্যতা প্রমাণ করতে হয়। আল্লাহ কুর’আনে বলেন:
“মানুষ কি মনে করে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ – একথা বললেই তাদেরকে পরীক্ষা না করে অব্যাহতি দেয়া হবে? আমরা তো এদের পূর্ববর্তীদেরকেও পরীক্ষা করেছিলাম; কারা সত্যবাদী এবং কারা মিথ্যাবাদী আল্লাহ তা অবশ্যই জানবেন (অথবা আল্লাহ তা অবশ্যই প্রকাশ করে দেবেন)।” (সূরা আনকাবুত, ২৯:২-৩)
অতি সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত এমন মুসলিমের সংখ্যা খুবই কম ছিল যারা কিনা কুর’আন অনুসরণের প্রথম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন অথচ সুন্নাহ অনুসরণের দ্বিতীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হগতে পারেন নি। কিন্তু হালে এমন অনেক মনুষই পাওয়া যাবে যারা দাবী করেন যে তারা কুর’আন অনুসরণ করেছেন এবং সুন্নাহ অনুসরণ করার প্রয়োজন তাদের নেই। অথচ যে কোন ব্যক্তির জন্য ঈমানের পূর্বশর্ত হচ্ছে এই থেকে কুর’আন ও সুন্নাহ দুটোই অনুসরণ করবে। কুর’আনের বহু আয়াত দ্বারা এই সম্ভাব্যতা প্রমাণ করা যায়, যার কিছু কিছু আমরা ইতোমধ্যেই আলোচনা করেছি। কুর’আনে যে কেউ এমন কথা দেখতে পাবে:
“বলুন, আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর আর তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও তবে জেনে রেখো যে নিশ্চয়ই আল্লাহ অবিশ্বাসীদের ভালবাসেন না।” (৩:৩২)
এই আয়াতে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাদেরকে প্রকারান্তরে অবিশ্বাসী ও কাফির বলা হচ্ছে। ইবন কাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন যে, এই আয়াত প্রমাণ করে এমন যে, কেউ যে কিনা রাসূলের(সা.) সাথে ভিন্নমত পোষণ করে এবং তাঁর সুন্নাহ অনুসরণ করতে অস্বীকার করে সে কাফির হয়ে যায়। আল্লাহর রাসূলকে (সা.) অনুসরণ করা ছাড়া আল্লাহর নিকটবর্তী হবার এবং তাঁর অনুগ্রহ লাভ করার আসলে আর কোন উপায় নেই। যেমনটি নিম্নলিখিত আয়াতে বলা হয়েছে:
“বলুন, তোমরা যদি সত্যিই আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর এবং আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন এবং তোমাদের গুণাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন।” (সূরা আলে-ইমরান, ৩:৩১)
আল্লাহ কুর’আনে আরো বলেন:
“কেউ রাসূলের আনুগত্য করলে সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করলো।” (সূরা নিসা, ৪:৮০)
এর সাথে রাসূল (সা.) যোগ করেছেন, যে কেউ রাসূলকে অমান্য করলো সে আল্লাহকে অমান্য করলো। এই আয়াতের আর কোন ব্যাখ্যার বা ”গুরুত্ব দেখানোর” প্রয়োজন নেই।
ইমাম শাফিঈ বলেন: “ব্যাপারটা যেভাবেই দেখা হোক না কেন, আল্লাহ ব্যাপারটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে তাঁর রাসূলকে মেনে নেয়ার ব্যাপারে তিনি বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছেন, এবং আল্লাহর রাসূলের কাছ থেকে এসেছে জেনে থাকলে কোন আদেশ অমান্য করার ব্যাপারে মানবকুলের কাউকে কোন অজুহাতের অবকাশ দেয়া হয়নি। আল্লাহ বরং দ্বীনের সকল ব্যাপারে মানুষের জন্য তাঁকে অপরিহার্য করে রেখেছেন এবং সেটার প্রমাণ হিসেবে তাঁর কিতাবে লিপিবদ্ধ কর্তব্যসমূহের অর্থ পরিষ্কার করে দেয়ার ক্ষেত্রে সুন্নাহর ব্যবহারের দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন। যেন এটা জানা যায় যে – আল্লাহর কিতাবে লিপিবদ্ধ কোন আদেশের সুনির্দিষ্ট অর্থ বের করার ব্যাপারেই হোক অথবা আল্লাহর কিতাবে উল্লেখ নেই এমন কোন বিষয়ের আইন প্রণয়নের ব্যাপারেই হোক – এর যে কোন অবস্থাই আসলে আল্লাহর আদেশ উপস্থাপন করে এবং তা তাঁর রাসূলের (সা.) আদেশের সাথে সম্পূর্ণ সঙ্গতপূর্ণ। দুটোই সকল অবস্থায় সমান বাধ্যবাধকতাসম্পন্ন।”
উপসংহার: নবীর (সা.) ভূমিকাসমূহ, সুন্নাহ অনুসরণের অপরিহার্যতা নির্দেশ করে
পূর্ববর্তী অধ্যায়ে নবীর (সা.) সুন্নাহ কর্তৃত্ব ও গুরুত্ব সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত করে কুর’আনের এমন আয়াত ও হাদীস উপস্থাপন করা হয়েছে। এই অধ্যায়ে সুন্নাহর অবস্থান ও মর্যাদা দেখাতে আরো অতিরিক্ত প্রমাণাদি উপস্থাপন করা হয়েছে। নবীর (সা.) ভূমিকাসমূহ আলোচনা করতে গিয়ে বাস্তবে এটাই দেখানো হয়েছে যে, ইসলামের জন্য সুন্নাহ একটা অপরিহার্য বিষয় এবং তা ইসলামী আইনের একটা উৎস। সত্যি বলতে কি সুন্নাহ ছাড়া কোন প্রকৃত ইসলামই নেই।
নবী (সা.) কুর’আন ব্যাখ্যা করেছেন, তাঁর ব্যাখ্যা এবং প্রয়োগ ছাড়া ঠিক কিভাবে শুদ্ধভাবে কুর’আনকে প্রয়োগ করতে হবে কারো পক্ষে তা জানার কোন উপায় থাকবে না। অন্য কথায় বলতে গেলে আল্লাহ কুর’আন নাযিল করেছেন, কিন্তু সেটা এমনভাবে নাযিল করেছেন যাতে কখনোই সেটাকে নবীর সুন্নাহ থেকে বিচ্ছিন্ন না করা যায়। আর সেরকমটা করার যে কোন রকম প্রচেষ্টার পরিণতি ভয়াবহ ও করুণ।
কুর’আন এবং হাদীস দ্বারা এটা প্রমাণ করা হয়েছে যে, নবী (সা.) ছিলেন ‘আইনের এক স্বনির্ভর উৎস’। মুসলিমরা কুর’আনকে মেনে চলতে যেরকম বাধ্য, ঠিক একইভাবে রাসূলকে (সা.) মেনে চলতেও তারা বাধ্য – কেননা [দ্বীন সংক্রান্ত] তাঁর কথা এবং কুর’আন উভয়ের উৎসমূল হচ্ছেন আল্লাহ এবং যে কেউ [এসব মেনে] আসলে আল্লাহরই ইবাদত করছে। সুতরাং কেউ যদি সঠিকভাবে আল্লাহর ইবাদত করতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই নবীর (সা.) কাছ থেকে আসা ব্যাপারগুলো অনুসরণ করতে হবে এবং মেনে চলতে হবে, কুর’আনে সে ব্যাপারগুলোর উৎস থাকুক আর না থাকুক।
নবী (সা.) ছিলেন নিখুঁত উদাহরণ। তিনি সিরাতুল মুস্তাকীম বা সরল পথ অনুসরণ করছিলেন, আর তাই কেউ যখন সেই পথ সম্মন্ধে জানতে চায় এবং সেটা অনুসরণ করতে চায়, তখন সেটার বাস্তব উদাহরণের খোঁজ করাটা তার জন্য অবশ্যকরণীয় হয়ে পড়ে। তাঁর জীবনের ধরণের চেয়ে শ্রেয় আর কোন জীবনযাত্রা হতে পারে না। একজন মুসলিম যদি সঠিক উপায়ে নবীর (সা.) অনুসরণ করে, তবে সে নিশ্চিত হতে পারে যে, সে এমন এক আচরণ করছে যা আল্লাহর সন্তুষ্টি বয়ে আনে।
সবশেষে, নবীর (সা.) আনুগত্য করা না করাটা মানবকুলর জন্য এক ধরণের পরীক্ষার ব্যাপার। কেউ কুর’আন পড়তে পারে এবং তা তার কাছে সুন্দর লাগতে পারে, কিন্তু তারপরে প্রশ্ন থেকে যায়, সে কি আসলে সেটাকে সঠিক পন্থায় বাস্তব রূপ দিতে চায়? যেভাবে নবী (সা.) দেখিয়ে দিতে চান? একই ভাবে কেউ নবীর (সা.) জীবনী পড়তে পারে এবং তাঁর চরিত্র ও সংগ্রামের বর্ণনা পড়ে চমৎকৃত হতে পারে। কিন্তু এখানেও প্রশ্ন থেকে যায়, নবী (সা.) যা আদেশ করে গেছেন, সেসবের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে কি সে ইচ্ছুক? কেউ যদি নিজেকে সমর্পণ করতে না চায়, তবে তার বাকী বোধ বা অনুভূতিগুলো অর্থহীন। কারো যদি নিজেকে সমর্পণ করার ইচ্ছা না থাকে তবে সে আসলে আল্লাহর কাছে ঐ পরীক্ষায় বিফল হবার প্রমাণ রেখে যাচ্ছে, আল্লাহ তাঁর অসীম প্রজ্ঞা ও জ্ঞানবলে মানবকুলকে যাচাই করতে চেয়ে তাদেরকে যে পরীক্ষার মাঝে রেখেছিলেন।
[Page#143~147, The Authority and Importance of Sunnah – Jamaal al-Din M. Zarabozo থেকে অনুদিত।]
[বি:দ্র: নবীর(সা.) ভূমিকা সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে চাইলে, এই সিরিজের পূবর্বর্তী ৫ টি পোস্টও অনুগ্রহপূর্বক পড়ে দেখুন]