ফাস্টফুড কালচার

“এক ছিল টোনা আর এক ছিল টুনি। টোনা কহিল টুনি পিঠা তৈরী কর…..”

আজ আমরা যারা মধ্যবয়স্ক বা প্রৌঢ়, তারা প্রায় সবাই হয়তো এই গল্পটা জানি। আজ যারা তরুণ বা নবীন, তাদের অনেকেই হয়তো এই গল্পটা জানবেন না – কারণ, তাদের বাবা-মায়েরা হয়তো বা তাদের “সিনড্রেলা” বা “স্নো হোয়াইট এন্ড সেভেন ডোয়ার্ফস্” সমেত পাঠক্রমে শিক্ষিত করেছেন। বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি ও নব্য-ফেরাউন-রাজ্য – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জীবনধারাকে, কুর’আনিক জীবনধারার চেয়ে পবিত্রতর জ্ঞান করে, চলনে-বলনে বা আচারে-আচরণে তাদের মত হয়ে যাবার একান্ত বাসনা চরিতার্থ করার প্রতিযোগিতায় আমরা যেভাবে দ্রুত আত্মনিয়োগ করে চলেছি, তাতে অচিরেই ঐ গল্প বা ঐ ধরনের আরো যে সব গল্প, বিদ্যাশিক্ষার কর্মকান্ডে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল – সেগুলোর যে বিলুপ্তি ঘটবে, অথবা, সেগুলো যে পুনর্লিখিত হবে, তা এক প্রকার নিশ্চিত। আমি কোন এক অলস প্রহরে একদিন ভাবছিলাম, উপর্যুক্ত গল্পটির তখন কি চেহারা দাঁড়াবে। আমার মনে হলো বুঝি এমন কিছু একটা দাঁড়াতে পারে:

এক ছিল টোনা। পড়ন্ত বয়সে উপনীত হইলেও, এখনো তাহার ঘর বাঁধা হইয়া উঠে নাই। বহু টুনির শয্যাসঙ্গী হইলেও, কাহাকেও সে নিজের সঙ্গে একত্রে ঘর বাঁধার ব্যাপারে রাজি করাইতে পারে নাই। এমন নয় যে তাহার কোন অক্ষমতা বা অপর্যাপ্ততা রহিয়াছে। কিন্তু কেবল একজন সঙ্গীর সাথে জুটি বাঁধা বা ঘর বাঁধার ব্যাপারটা সেকেলে হইয়া যাওয়ায়, টুনিকুলের কেহ এখন আর ঘর বাঁধিয়া নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধিয়া ফেলিতে চাহে না। যৌন বাসনা চরিতার্থ করিবার জন্য বা সন্তান উৎপাদনের জন্য, ঘর বাঁধাটা বাহুল্য হইয়া যাওয়ায়, টুনিগণ এখন আর কিছুতেই বিবাহের বন্ধনের বাড়তি ঝামেলায় নিজেদের আবদ্ধ করিতে চায় না।

আমাদের গল্পের টোনা শুনিয়াছে যে, তাহার দাদিমা নাকি রোজ তাহার দাদার জন্য খাবার রান্না করিতেন এবং দাদা কর্মস্থল হইতে ফিরিবার সময় হইলে, তাহার পথ চাহিয়া বসিয়া থাকিতেন। শীতের মৌসুমে দাদা বাজার হইতে গুড় ও চাউলের গুঁড়ি আনিয়া দিলে, দাদিমা নিজের হাতে তাহাকে পিঠা বানাইয়া খাওয়াইয়াছেন। আমাদের টোনার মা চাকুরিজীবী ছিলেন। মৌলিক প্রয়োজনে নয়, বরং নিজেদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য ও বিবিধ চিত্তাকর্ষক ‘জিনিস’ ক্রয় করিবার সামর্থ লাভ করার অভিলাষে তিনি প্রথম চাকুরী গ্রহণ করেন। আমাদের এই গল্পের টোনা বেশ মনে করিতে পারে যে, সে বড় হইবার পূর্বেই কিভাবে তাহাদের গৃহে রান্নাবান্নার পাট একপ্রকার চুকিয়াই গিয়াছিল। রাত্রির খাবার ছাড়া, বাকী সব বেলার খাবারই, পরিবারের সবাই যে যার মত বাহিরে সমাধা করিয়া লইত। দিনের শেষে কর্মস্থল হইতে বাবা ও মা উভয়েই পরিশ্রান্ত হইয়া ফিরিয়া আসিলে, রাত্রির খাবার কে রান্না করিবেন এবং কি রান্না করা হইবে, ইহা লইয়া প্রায়ই বচসা বাঁধিয়া যাইতো এবং গৃহের শান্তি বিনষ্ট ও বিঘ্নিত হইবার উপক্রম হইতো। শীতের মৌসুমে, কোন সন্ধ্যায়, কদাচিৎ বাবার কখনো পিঠা খাওয়ার সাধ জাগিলে, “টুনি, তাড়াতাড়ি সাজগোজ সারিয়া লও, আর সঙ্গে কিছু বাড়তি টাকা লইও – সকলে মিলিয়া আজ ‘পিঠা হাটে’ পিঠা খাইবো।” – এই বলিয়া তিনি সকলকে লইয়া বাহিরে যাইবার আয়োজন করিতেন।

চাউলের গুঁড়ি দেখিতে কি প্রকার তাহা আমাদের আজকের টোনা জানেনা। তবু, অতীত স্মৃতি রোমন্থনে, আজকের শীতকালের এই সন্ধ্যায় পিঠা খাইবার জন্য তাহার প্রাণ ব্যাকুল হইয়া উঠিল। সে মনে করিতে চেষ্টা করিল যে, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকি অঙ্গরাজ্যের লুইভিল হইতে আগত মিঃ পিটার আহমেদ প্যান, ‘প্যান-পিঠা’ নামক যে অত্যাধুনিক পিঠার দোকানখানি অতি সম্প্রতি খুলিয়া বসিয়াছেন, তাহা রাত্রিবেলা কতক্ষণ খোলা থাকে! এইসব ভাবিতে ভাবিতে অন্যমনস্কভাবে সে তাহার ক্রেডিট-কার্ডখানার জন্য হাত বাড়াইল। পিঠা খাইবার উদ্দেশ্যে গৃহ হইতে বাহির হইতে গিয়া, তাহার গৃহিণী নাই বিধায়, তাহার যাত্রাসঙ্গী হইবার মত যে কেহ নাই – এই বাস্তবতা মনে হইতে তাহার মনখানি বিষন্নতায় ছাইয়া গেল।

মাননীয় পাঠক! প্রথম দৃষ্টিতে উপরের গল্পকে কল্পনাবিলাস মনে হলেও, ওরকম একটা সামাজিক অবস্থানে পৌঁছাটা আমাদের জন্য এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। সামাজিক দুষ্কর্মের ব্যাপারে, অনেক দিক দিয়ে আমরা ইতোমধ্যেই বিশ্ব-নিয়ন্তা কু্ফফার শ্রেষ্ঠ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রতিযোগিতায় নামার যোগ্যতায় উন্নীত হয়েছি। উদাহরণ স্বরূপ, পাঠক হয়তো জেনে থাকবেন যে, বাংলাদেশের হয়ে জাতিসংঘে কর্মরত জনৈকা কূটনীতিকের ব্যবসায়ী স্বামী সবান্ধব, নিউ ইয়র্কের একটি নাইটক্লাবে ল্যাপ ড্যান্সার বার-বণিতাদের নিয়ে ফূর্তি করে ও মদ্যপান করে একরাতে প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার ডলার (বা প্রায় ৭৬ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা) ব্যয় করে সেখানকার খবরের কাগজের খবর হবার বিরল সম্মান লাভ করেছেন। যে দেশের মানুষের মাথাপিছু বাৎসরিক আয় ৪৪৪ ডলার, সে দেশের একজন নাগরিক হয়ে এমন একটা দুর্লভ সম্মানের অধিকারী হতে পারাটা নিঃসন্দেহে চাঞ্চল্যকর একটা ব্যাপার । এছাড়া হালে, এক বঙ্গ-ললনার নগ্ন দেহ-সৌন্দর্যের ছবি, সেখানকার এক পর্ণোগ্রাফিক ম্যাগাজিনে ছাপা হওয়াতে কুফফারের কাছে আমাদের দেশের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চয়ই আরো সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে!** তাহলেই ভেবে দেখুন অচিরেই টোনা-টুনির গল্পের সমকালীন রূপ কি দাঁড়াতে পারে।

যাহোক্, আমি টোনা-টুনির গল্প দিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম একারণে যে, টোনা-টুনির আদি গল্পটাতে সংসার পাতার এবং সংসারের দৈনন্দিন কর্মকান্ডের একটা কথাচিত্র ছিল। আমরা যে দিকে ধেয়ে চলেছি তাতে, ঐ কথাচিত্রে বর্ণিত সংসার ধর্ম এবং সংসার কর্ম, দুটোই হয়তো অচিরেই একদিন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। একটা বিল্ডিং বা স্থাপনাকে যেমন বহুবিধ উপায়ে ভাঙ্গা যায় এবং সেই ভাঙ্গনের সূচনা যেমন দৃশ্যমান ভাবে বাইরের দিক থেকে করা যায় অথবা লোক চক্ষুর অন্তরালে যেমন সন্তর্পণে ভিতরের দিক থেকেও করা যেতে পারে – তেমনি একটা জীবন ব্যবস্থাকে বহুদিক থেকে ধ্বংস করে দেয়া যায় – কখনো বল প্রয়োগ করে বাইরে থেকে, যেমন উত্তর আমেরিকার রেড-ইন্ডিয়ানদের জীবনব্যবস্থা এবং জীবনের ধরনকে বল প্রয়োগের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছিল ‘সাদা-চামড়া’ ইউরোপীয়রা। আবার ধরুন চটকদার জীবনযাত্রার প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়ে কোন সভ্যতা (ভিতর থেকে নিজেই) ক্ষয় হতে হতে একদিন dominant culture-এ বিলীন হয়ে যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ ফিলিপিন্সের সংস্কৃতির কথা বলা যায়, যা কিনা আমেরিকান dominant culture-এ বিলীন হয়ে গেছে (দক্ষিণ ফিলিপিন্সের কিছু সেকেলে মুসলিম জনগোষ্ঠী এর ব্যতিক্রম, যে জন্য আজ তাদের চরম মূল্য দিতে হচ্ছে)।

Footnote**:উভয় খবরের জন্য দেখুন – যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত “সাপ্তাহিক বাঙালী” পত্রিকার ১৩ই জুন ২০০৪ সংখ্যা

ফাস্টফুড কালচার – ২ [২৯ শে অক্টোবর, ২০১০ রাত ১১:৫২]

পৃথিবীতে গত প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে, যত কালচার বা সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য আবহমান, সেগুলোকে ঢালাও ভাবে দু’টো প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়: ইসলামী কালচার (বা ইসলামী ঐতিহ্য) এবং জাহিলী কালচার (বা জাহিলী ঐতিহ্য)। ইসলামী ঐতিহ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে পরিবার, পারিবারিক বন্ধন এবং (মুসলিম) সম্প্রদায় ভিত্তিক (community based) সামাজিকতার কর্মকান্ড। এই ইসলামী ঐতিহ্যের জন্য পশ্চিমা কাফির সভ্যতা থেকে আগত সর্ব-সাম্প্রতিক ব্যাধি “ফাস্ট ফুড কালচার” বা “ফাস্ট ফুড সংস্কৃতি” অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক ও মারাত্মক। কিন্তু গভীর দুঃখ, অনুশোচনা ও দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে এই যে, গবাদি পশুর মত গড্ডালিকা প্রবাহে এবং ভোগ-সুখের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেয়া দেশের সুবিধাবাদী নাগরিক জনসংখ্যার কথা বাদ দিলেও, যারা ইসলামী ঐতিহ্যের ও মুসলিম সমাজের নৈতিকতার অতন্দ্র প্রহরী হবার কথা – সেই ‘আলেম-উলামাগণ বা ইসলামপন্থীরাও ব্যাপারটা সম্বন্ধে একদমই অসচেতন এবং উদাসীন। এর কিছু সঙ্গত কারণও আছে অবশ্য। সাধারণ যুক্তিতে মনে হতে পারে যে, আমার উপার্জন যদি হালাল হয় – আর যে মাংস দিয়ে বার্গার বা সসেজ বানানো হচ্ছে, তা যদি হালাল হয়ে থাকে (যদিও আমাদের দেশে, সেগুলো হালাল না হবারও যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে – তবু আপাতত তর্কের খাতিরে ধরে নিচ্ছি যে, সেগুলো সব হালালই) তাহলে সমস্যা কোথায়? আসুন আমরা একে একে সমস্যাগুলো ভেবে দেখি:

১)একটা পরিবার বা সংসার কি? সেখানে কি কি উপাদান প্রয়োজনীয়? এসব নিয়ে ভাবতে গিয়ে ইতিহাসের সূচনালগ্ন পর্যন্তও যদি পেছনে চলে যাওয়া যায়, তবে দেখা যাবে, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে একজন পুরুষ এবং একজন নারী মিলে যে ঘর বাঁধবে, সেটাই হবে সংসার বা পরিবারের ভিত্তি। সেখানে তাদের মাঝে তাদের সন্তানেরা এসে সেই পরিবারের পরিসর ক্রমে বৃদ্ধি পাবে। পরিবারের এই কাঠামোতে সহজাত ও স্বভাবগত ভাবেই আগে পুরুষ বাইরে যেত শিকার করতে বা খাদ্য যোগাড় করতে – নারী সন্তান পালন সহ ঘরোয়া ব্যাপারগুলোর দায়িত্ব পালন করতো। এরপর শেষ নবী(সা.)-এঁর মাধ্যমে প্রদত্ত বিধান মতে, ইসলামে নারী-পুরুষের দায়িত্বের ভাগা-ভাগি মোটামুটি একই লাইন বরাবর হয়েছে বলেই বলা যায়। উত্তরাধিকার, সম্পত্তি ও সম্পদের মালিকানার অধিকারসহ নারীকে বেশ কিছু যুগান্তকারী অধিকার ইসলাম দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু উপার্জন বা জীবিকা সংগ্রহের দায়-দায়িত্ব থেকে বলতে গেলে তাকে সম্পূর্ণরূপেই অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। সন্তানকে সত্যিকার “মুসলিম” হিসেবে বেড়ে ওঠার ব্যাপারে তৈরী করার গুরু দায়িত্ব মায়ের উপর বর্তায় এবং ইসলামী মতে সংসারে সন্তান প্রতিপালনই হচ্ছে সত্যিকার অর্থে নারীর মুখ্য দায়িত্ব। বাইরের ঝড়-ঝাপটা ও খরতাপ থেকে পুরুষ তার পরিবার নামক একান্ত আপন দুর্গ বা রাজ্যকে সর্বতোভাবে সুরক্ষা করবে – পক্ষান্তরে নারী সেই পরিবার, সংসার বা ঘরকে পুরুষ তথা সন্তান-সন্ততির জন্য এক স্নেহশীল, শান্তিপূর্ণ ও কোমল আশ্রয়স্থল হিসেবে তিলে তিলে গড়ে তুলবে। ভালো অভিব্যক্তির অভাবে আমি “তিলে তিলে” কথাটা বল্লাম । আমি বলতে চাইছিলাম যে, বহু বছর, মাস, দিন ও ক্ষণের স্নেহ-মমতায়, যত্নে ও সাধনায় একটা সংসারের সাজানো বাগান গড়ে ওঠে। কোন পরিবারের গৃহে যত আসবাবপত্র বা ব্যবহার্য রয়েছে – দৈবাৎ কোন উপায়ে ধরুন যদি সবকিছু এক ঘন্টার ভিতর জড়ো করা যেত তাহলে কি ব্যাপারটা এক হতো? না, মোটেই না! যেমন ধরুন কোন মা হয়তো বলেন, “আমার ছোট মেয়েটার বয়স যখন ৪ বছর, তখন সে পাশের বাসা থেকে ঐ শিউলি ফুলের গাছের চারাটা এনে, ওখানে লাগানোর আব্দার জানায়। তারপর ঐ চারাটা দিনে দিনে বড় হলো – আমার মেয়ের শোবার ঘরের জানালার ধারে একসময় সেটা একটা পরিপূর্ণ শিউলি ফুলের গাছে পরিণত হলো। একসময় যখন শরৎকালে ফুল আসতে শুরু করলো, তখন মেয়েটা ভোর রাতে সবার অজান্তে ঘুম থেকে উঠে সেই ফুলগুলোর ঝরে পড়ার দৃশ্য দেখতো।….”

এখন ধরুন ঐ একই মহিলার বাসায়, কেউ হঠাৎ একদিন বড় ও পূর্ণ একটা শিউলি ফুলের গাছ এনে লাগিয়ে দিলেন – ব্যাপারটা কি এক হলো? ঐ পরিবারের সদস্যদের হৃদয়ে কি দু’টো গাছের ব্যাপারে একই ধরনের অনুভূতি থাকবে? কখনোই না! home ও house-এর মাঝে তফাৎ এখানেই ।

আমাদের বুঝতে হবে যে, মা যখন তার স্বামী-সন্তানের জন্য রান্না করেন, সেই রান্নায় বা রান্না করা খাবারে তার স্নেহ, মায়া, মমতা ও ব্যক্তিগত অনুভূতি মাখানো থাকে। সকালে তিনি যখন প্রথম রান্না ঘরে ঢোকেন, তখন থেকে নিয়ে রাতে খাবারের পাট চুকে যাওয়া পর্যন্ত তার মাথায়, কে কোনটা খেতে পছন্দ করে, কার কোন খাবারটা প্রয়োজন (যেমন ধরুন দুধ/ডিম), কে কোনটা (যেমন ধরুন ঝাল) খেতে পারে না – ইত্যাদি ব্যাপার ঘুরতে থাকে। তিনি রান্না সেরে অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকেন, কখন তার স্বামী বা সন্তানেরা খাবার জন্য ঘরে ফিরে আসবে – একই ভাবে গৃহিণী/মা পথ চেয়ে আছেন ভেবে স্বামী/সন্তানেরা যথাশীঘ্র সম্ভব ঘরে ফিরে আসার চেষ্টা যে করবে, তা বলাই বাহুল্য। বিশেষ ঋতুতে উত্তপ্ত কুক্কুরীর সাথে মানব জননীর তফাৎটা এখানেই – কুক্কুরী তার উত্তাপের ফসল পেট ঝেড়ে খালাস করে দিলেই মোটামুটি ভাবে মুক্ত। সন্তানের জন্য মানব জননীর স্নেহ, মমতা ও দায়িত্ব আমৃত্যু বজায় থাকবার কথা। পারিবারিক বন্ধনের স্থায়ীত্বে , মা কর্তৃক রোজকার এই খাবারের আয়োজন এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ঘরের খাবার ছেড়ে ‘ফাস্টফুড কালচার’-এ আসক্ত হওয়াটা অনেকটা – নিজ স্ত্রীকে ছেড়ে যৌন বাসনা চরিতার্থ করতে বেশ্যার কাছে যাবার মত ব্যাপার। এটা ঠিক যে, ক্ষুধার মতই যৌন বাসনা একটা basic instinct বা মৌলিক প্রবৃত্তি – কিন্তু এর নিবৃত্তির পন্থার মাঝে এমন কিছু পার্থক্য রয়েছে, যা মানুষকে ইতর প্রাণীকুল থেকে আলাদা করে ‘আশরাফুল মখলুকাত’ বলে পরিচয় দান করে। স্বামীর কথা স্মরণ রেখে সমাধা করা দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কাজে – যেমন ধরুন রান্না বা স্বামীর জন্য একটা সোয়েটার বুনার মত সাদামাটা কাজেও – দাম্পত্য জীবনে সুখী ও পরিতৃপ্ত একজন স্ত্রীর স্নেহ-মমতা, ভালোবাসা এবং হ্যাঁ, এমনকি যৌনবোধও সুচারুরূপে মিশে থাকতে পারে। অথচ, উভয় ক্ষেত্রেই দৈহিক সংসর্গের একটা ব্যাপার রয়েছে – এই যুক্তিতে বেশ্যার সাথে সংম্পর্কের সাথে কি দাম্পত্য সম্পর্কের কোন তুলনা হতে পারে? নিশ্চয়ই না! তেমনি পারিবারিক আয়োজনের ‘ঘরের খাবার’ এবং ‘ফাস্টফুড’, উভয় দ্বারা ক্ষুধার উপশম হতে পারে, এই যুক্তিতে দুটো ব্যাপারকে এক করে দেখা যাবে না।

যে সমাজে ‘ফাস্টফুড কালচার’ প্রতিষ্ঠিত, সেখানে যে কারো – যখন খুশী, যেখানে খুশী, যা খুশী এবং যতটুকু খুশী খাবার স্বাধীনতা ও ব্যবস্থা রয়েছে – variable কেবল একটাই – অর্থ। একটা মুসলিম সমাজে ‘ফাস্টফুড কালচার’ প্রতিষ্ঠা লাভ করার ব্যাপারটা, অনেকটা আজকাল যে ভাবে বিশাল অট্টালিকাসমূহ নিঃশব্দে ভিতর থেকে ভেঙ্গে ফেলা হয়, সে ধরনের ব্যাপার হবে। ঐ সব demolition প্রক্রিয়ায় কোন শব্দ হয়না এবং বিল্ডিং-এর ধ্বংসাবশেষ নিঃশব্দে বিল্ডিং-এর নিজ পরিসীমার মাঝেই ভিতর দিকে ধ্বসে পড়ে। মুসলিম পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক নিয়ম-নীতিকে নিঃশব্দে ভেঙ্গে ধূলোয় মিশিয়ে দেয়ার ব্যাপারে, ‘ফাস্টফুড কালচার’ নীরব বিপ্লবের মাধ্যমে সাধারণ ভাবে যা অসাধ্য মনে করা হয়, তা অনায়াসে সাধন করতে পারে। এজন্যেই আব্দুল্লাহ্ হাকিম কুইকের মত বিশ্ববরেণ্য ‘আলেমগণ যখন মক্কায় কুফফারের ‘ফাস্টফুড চেইন’-এর শাখা খোলার দুঃসংবাদ বর্ণনা করেন, তখন তাঁদের কন্ঠ স্বজন হারানো ব্যাথায় ও দুঃখে অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে।

পবিত্র কুর’আনে ১৬:৮০ আয়াতে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’লা, মানুষকে দেয়া তার নিয়ামতের ভিতর “মানুষের জন্য তার গৃহকে শান্তি ও প্রশান্তির স্থল হিসেবে নির্ধারণ করা” – এই ব্যাপারটাকে অন্যতম একটি বলে বর্ণনা করেছেন। আমাদের যাদের আজ একখানি গৃহ আছে বা একটা পরিবার আছে – আমরা ব্যাপারটাকে অবধারিত বা granted বলে ধরে নিই। অথচ কুফফার-স্বর্গ ও সমৃদ্ধির স্বর্গ মার্কিন মুল্লুকের শিকাগো, নিউ ইয়র্ক বা ফিলাডেলফিয়ার মত শহরগুলোর ভূগর্ভস্থ রেল লাইনের দুধারে কত গৃহহীন মানুষ যে জীবন যাপন করছে, তা জানলে এবং তা নিয়ে ভেবে দেখলে আমরা বুঝতাম যে, সারাদিনের কাজের শেষে ফিরে আসবার জন্য একখানা গৃহ থাকা বা পরিবার থাকা কত বড় সৌভাগ্যের বিষয়। যে সমাজে ‘ফাস্টফুড কালচার’ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, সেখানে প্রথমেই যে পরিবর্তন আসে তা হচ্ছে
খাবারের সময়ে এবং খাবারের জন্য বাড়ী ফেরার তাগিদ ও প্রয়োজনীয়তা বোধ না হওয়া। উদাহরণ স্বরূপ একটা কলেজ/ইউনিভার্সিটিতে পড়া ছেলে বা মেয়ে হয়তো তার মূল কাস ও প্র্যাক্টিকেলের মাঝখানের ৩ ঘন্টা সময়ে, তড়িঘড়ি করে বাড়ী আসতো দুপুরের খাবার খেতে। এখন ‘ফাস্টফুড কালচার’-এর বদৌলতে তার কলেজ বা ডিপার্টমেন্টের সামনেই হয়তো ‘ডাবল বার্গার’, ‘ চিকেন ব্রোস্ট’, ‘ফিলে অফ ফিশ’ ইত্যাদি চমকপ্রদ নামের সব ‘ফাস্টফুড’ পাওয়া যায় – সুতরাং সে ওখানেই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে দুপুরের খাবারটা সেরে নেয়। এভাবে একে একে, আমাদের sample পরিবারের যারা দিনের বেলায় বাইরে থাকেন, তাদের সবাই হয়তো বাইরে খেতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবেন। মা বেচারী প্রথম দিকে হয়তো ভাববেন যে, দিনের বেলায় রান্নার কোন প্রয়োজনীয়তা আর রইলো না – তারপর এক সময় হয়তো তার মনে হতে পারে যে, সংসারে দিনের বেলায় ঘর পাহারা দেয়া ছাড়া তার নিজেরই আর কোন প্রয়োজনীয়তা রইলো না! এভাবে – সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত যোগ্যতার তারতম্যে – একসময় তার মনে হতে পারে তিনি একটা চাকুরী করলেই পারেন, অথবা, ‘মহিলা সমিতি’ জাতীয় কোন সংস্থায় যোগ দিয়ে, এদেশের নিগৃহীত নারী সমাজ – যাদের সারা দিন কেবল রান্না ঘরেই কেটে যায়, তাদের ‘মুক্তির পথ’ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে পারেন। অথবা, এমনও হতে পারে যে, নিঃসঙ্গতা কাটাতে তিনি প্রায়ই নিউ মার্কেটের মত জায়গাগুলোতে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতে পারেন এবং অন্যদের মত তিনিও দুপুরে ‘ফাস্টফুড’ দিয়ে তার দুপুরের আহার পর্বটা সেরে নিতে পারেন।

এভাবেই ‘ফাস্টফুড কালচার’ প্রথমে পরিবারের ভিতকে আলগা করে ক্রমে পরিবারের ধ্বংস সাধনের বাকী কর্মকান্ডগুলোকে সহজ করে দেবে। উদাহরণস্বরূপ দেখুন ‘ফাস্টফুড কালচার’-এ অভ্যস্ত একটা পরিবারের গৃহিণী অর্থহীন ভাবে ইতিউতি বিচরণ করতে গিয়ে, সহজেই একটা পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে পারেন – কারণ বাড়ীতে তার দায়-দায়িত্ব যেমন কম হবে, তেমনি পরিবারের সদস্যদের ভিতর ভাবের আদান প্রদান কমে গিয়ে নিজেদের মাঝের স্নেহ-মমতার বন্ধনও অনেকখানি আলগা হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। এছাড়া তার অবসরও হবে অনেক বেশী – জীবনটা তার জন্য ‘বোরিং’ হয়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক। কোন পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য – বাড়ীতে ফেরার তাগিদ নেই বলে আপনার ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলেটি হয়তো তার ‘গার্ল-ফ্রেন্ডের’ সাথে কোন ‘ফাস্টফুড জয়েন্টে’ বসে, তার সাথে নিজের ব্যভিচারসুলভ সম্পর্ক চর্চা করতে পারবে অনায়াসে। এভাবে কোন পরিবারের সদস্যরা যদি দিনের একটি খাবার (বা meal), যে যার মত বাইরে খেতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন, তবে দিনের সব খাবার যে যার মত বাইরে খাওয়াটা স্বাভাবিক মনে হওয়াটা কেবল সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে! আর তা যখন হবে, তখন ঘর ও সংসার দু’টোকেই বাহুল্য মনে হতে পারে।

যারা সিঙ্গাপুরের জীবনযাত্রার ধরনকে একটু খেয়াল করে পর্যবেক্ষণ করেছেন, তারা অনুভব করতে পারবেন যে, আমাদের এই রচনার প্রস্তাবনা সে দেশের পটভূমিতে কত সত্যি! আজ সেখানকার সরকার, অশনি সংকেত অনুধাবন করে বিয়ে করার জন্য, সংসার পাতার জন্য এবং ঘর বাঁধার জন্য সরকারী ব্যবস্থাপনায় বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। যারা সিঙ্গাপুরে গিয়েছেন, তারা জেনে থাকবেন যে, সেখানকার জনসংখ্যার অধিকাংশই ঘরে রান্না না করে বাইরে খাওয়াটাই পছন্দ করে। যারা সে দেশে ঘর পাতেন, ‘ফাস্টফুড কালচার’-এর মত অভিশপ্ত আচার-আচরণ তাদের দাম্পত্য জীবনের বন্ধনকে এতই আলগা করে রাখে যে, সংসারে একে অপরকে বিশ্বাস করা বা নিজ সঙ্গীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকার পরিবেশই গড়ে উঠা দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। সেখানকার খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনের পাতাসমূহের বিশাল অংশ জুড়ে চও বা প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরদের বিজ্ঞাপন থাকে – যাদের প্রধান কাজ হচ্ছে অবিশ্বস্ত স্বামী/স্ত্রী একে অপরের অনুপস্থিতিতে কি করছেন সে বিষয়ে গোয়েন্দাগিরি করা।

ফাস্টফুড কালচার – ৩ [৩০ শে অক্টোবর, ২০১০ রাত ১০:০৭]

এর আগের পর্বটায় আমরা কথা বলছিলাম “ফাস্টফুড কালচারের” সমস্য নিয়ে। সাধারণ যুক্তিতে মনে হতে পারে যে, আমার উপার্জন যদি হালাল হয় – আর যে মাংস দিয়ে বার্গার বা সসেজ বানানো হচ্ছে, তা যদি হালাল হয়ে থাকে – তাহলে সমস্যাটা কোথায়? আমরা প্রথম সমস্যাটা নিয় গত সংখ্যায় আলোচনা করেছি! আসুন আমরা একে একে বাকী সমস্যাগুলো সমস্যাগুলো ভেবে দেখি:

২)এরপর আসছে “ফাস্টফুড কালচারের” অর্থনৈতিক দিকটা। প্রাথমিক ভাবে একটা দরিদ্র দেশে যখন আট-ঘাট বেঁধে ‘ফাস্টফুড কালচার’ চালু হয় – তখনকার সময়টায় বানিয়ারা আঁচ করতে পারে যে, ঐ দেশে “গরীবের ঘোড়ারোগের” অবকাশ রয়েছে। যে করেই হোক, মানুষের হাতে – নাগরিক মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের হাতে কিছু বাড়তি পয়সা এসেছে বা আসছে (আমাদের দেশে যেমনটা গার্মেন্টস শিল্পের কল্যাণে এসেছিল)। ফাস্টফুডকে তখন ‘জাতে ওঠার’ প্রতীক হিসেবে প্রতিফলিত করা হয়। ‘ফাস্টফুড’ যে আসলে ‘জাঙ্ক-ফুড’ – খাদ্যের গুণ ও মান বা পুষ্টির নিরিখে উন্নত বিশ্বে বা চিকিৎসকদের খাতায় তা যে অত্যন্ত নিম্নমানের খাবার বলে বিবেচিত – এসব কারো ভাববার অবকাশই থাকে না। উড়ু– উড়ু– একটা “কি হনু রে!!” ভাবের বশবর্তী হয়ে, সঠিক মূল্যের ৩ গুণ দিয়েও কিছু একটা খাওয়াকে, অনেকেই অত্যন্ত বাহাদুরীর একটা কাজ মনে করে। স্পষ্ট মনে করতে পারি, ঢাকায় যখন কতিপয় দোকানে, প্রথম, কোমল পানীয়ের ঝর্ণার প্রচলন হলো – তখন শুধু আধুনিকতার অনুভূতি লাভ করতে, উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা যে দামে এক গ্লাস কোমল পানীয় পান করেছে – ১ লিটারের বোতল কিনলে, সেই দামে হয়তো তা থেকে ৩ গ্লাস কোমল পানীয়ের ভাগ পাওয়া যেত। একই ভাবে বাড়ীতে ডাল-ভাত রান্না করলে খাবারের জন্য মাথা পিছু ব্যয় যা হতো, ‘ফাস্টফুড’ দিয়ে দিনের যে কোন meal সমাধা করলে, স্বাভাবিক ভাবেই খরচটা অনেক বেশী হবে।

এখানে ভাববার বিষয় হচ্ছে এই যে, প্রাথমিক ভাবে দুনিয়ার সব বিচারেই যে কোমল পানীয়কে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এক বাহুল্য বলে চিহ্নিত করা হবে, সেই কোমল পানীয় তিনগুণ দাম দিয়ে কিনে খাবার জন্য যে বাড়তি অর্থের প্রয়োজন, সেই বাড়তি অর্থ আসবে কোথা থেকে? অথবা পরিবারের সদস্যদের যে কোন একটা meal বাইরে খাবার জন্য ঐ পরিবারের অর্থায়নের উপর যে বাড়তি চাপ আসবে – সেই বাড়তি অর্থ আসবে কোথা থেকে? আপনি যদি সত্যিই বিশ্লেষণ করতে পারতেন, তাহলে হয়তো দেখতেন যে, এই বাড়তি টাকার যোগান দিতে গিয়েই – যার ঘুষ না খেয়ে জীবন চলছিল, তার হয়তো ঘুষ খেতে হবে – বা, যে গৃহিনীর চাকুরী না করে চলছিল, তার হয়তো চাকুরী করাটা প্রয়োজন হয়ে দাঁড়াবে – অথবা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ক্লাসের যে মেয়ের অধ্যয়ন, কোন অভাববোধ ছাড়া অত্যন্ত নিরবচ্ছিন ভাবে চলছিল; হঠাৎই বন্ধুদের সাথে বেইলী রোডে নতুন খোলা সুইস স্ন্যাক্সের দোকানে আড্ডা মারতে যেতে না পারার গ্লানি ও হীনমন্যতা কাটিয়ে উঠতে না পেরে, বাড়তি কিছু আয়ের জন্য সে হয়তো তার ব্যবসায়ী কাজিনের কোরীয় কায়েন্টদের “সঙ্গ” দিতে রাজি হয়ে গেল।

এই গল্পের অন্য পিঠের কাহিনী একাধারে করুণ ও হাস্যকর। যারা এসব ‘ফাস্টফুড’ জয়েন্ট বা আউটলেটগুলো খোলে, তারা তাদের ধূর্ততা ও ক্রূর বুদ্ধিবলে জানে যে, তাদের যে target group – অর্থাৎ কোন জনসংখ্যার নির্বোধ ও চিন্তাশক্তি লোপ পাওয়া সেই অংশ; যারা কিনা তাদের মানসে লালিত “উন্নত জীবনের ইমেজধারী প্রভুদের” মত হবার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় ব্যস্ত সেই target group-কে ঠিক কি ভাষায় সুড়সুড়ি দিলে, তারা কোন নির্দিষ্ট ‘ফাস্টফুড’-এর প্রতি আসক্ত হবে বা কোন নির্দিষ্ট ‘ফাস্টফুড জয়েন্টে’ খাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে এবং সে সব জায়গায় খেয়ে এবং পরবর্তীতে অন্যের কাছে সেই ‘খাওয়ার’ গল্প করে “কি হনু রে!” ভেবে পুলকিত বোধ করবে।

ঘটনাটা আমি স্পষ্ট মনে করতে পারি, যদিও অনেক ক’টা বছর আগের কথা – এলিফেন্ট রোডের তথাকথিত একটা অভিজাত/আধুনিক রেঁস্তোরাকে কেমন জোড়াতালি একটা ‘ফাস্টফুড’-এর দোকানের রূপ দেয়া হয়েছিল। মেরিন একাডেমী থেকে ছুটিতে এলে, বুয়েটে পড়া আমার এক বন্ধু আমাকে ঐ দোকানে নিয়ে গিয়েছিল আপ্যায়ন করতে। একটি বার্গারের মূল্য (তখনকার বাজারে) ৫০টাকা শুনে আমি যখন সম্বিত ফিরে পাবার চেষ্টা করছি, তখন ঐ বন্ধু “ফ্রেশ লাইম” নামক পানীয় অর্ডার করলো – পরিবেশন করা হলে আমার কাছে তা অতি সাধারণ (বরফশীতল) লেবুর সরবত বলে মনে হলো – যার দাম ছিল (তখনকার বাজারে) ২০টাকা। আমি ভাবছিলাম নিতান্ত মধ্যবিত্ত পটভূমির আমার ঐ বন্ধুর মা, চাইলেই তখনকার সময়ে বেশী হলে বড়জোর ১ টাকা খরচ করে, তাকে এক গ্লাস লেবুর সরবত করে দিতে পারতেন। তাহলে দেখুন কিভাবে মধ্যবিত্ত কোন তরুণকে “কি হনু রে!” বোধ দিয়ে, কোন দ্রব্যের ২০ গুণ দাম হাতিয়ে নেয়া যায়!! ঐ ‘ফাস্টফুড’-এর দোকানের একমাত্র যে বিশেষত্ব আমার মনে আছে তা হলো পরিবেশটা খুব অন্ধকার ছিল – টেবিলে টেবিলে মোম জ্বালিয়ে দেয়া হতো। তাতে আমি যা বুঝি, অপরিচ্ছন্ন আসবাবপত্র সহ খাবার পরিবেশনের নানাবিধ দোষও ঢাকা পড়তো – কিন্তু সেজন্য ক্রেতার বাড়তি পয়সা গোনার তো কোন কারণ দেখি না। এটা বলতে গেলে “ফাস্টফুড কালচারের” সূচনার দিকের কথা। এখন তো অবস্থা আরো করুণ !! যে কোন নাজাসাতের উপরও ‘মিকি মাউস’ বা ‘স্পাইডারম্যান’-এর একটা প্রতিকৃতি সম্বলিত মোড়ক লাগিয়ে বাজারে ছাড়লে তা হয়তো মুহূর্তেই বিক্রী হয়ে যাবে।

যারা এসব “ফাস্টফুড” বাজারজাত করে, তারা জানে যে, এসব খাবারের অধিকাংশই কি সাংঘাতিক রকম অপূর্ণ খাবার এবং খাদ্যপ্রাণ বিবর্জিত – আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, তাদের ছেলেমেয়েদের তারা কখনো এসব ‘জাঙ্ক-ফুড’ খেতে দেয় না, বরং নিজ সন্তানদের তারা শাক-শব্জী সমেত whole meal খেতে বলবে – শুধু তাই নয়, সম্ভবত কেবল organic (সার ছাড়া ফলানো) শাক-শব্জীই খেতে বলবে। অনেকটা – (আমার আর একটা লেখায় আমি এর আগে যেমন বলেছিলাম) কলম্বিয়ার অনেক ড্রাগ লর্ডের ছেলেমেয়েরা যেমন ড্রাগ নেয়া তো দূরে থাক, ধূমপান পর্যন্ত করে না বরং দেখা যাবে হয়তো তারা হার্ভার্ড বা এম,আই,টি থেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত – তেমন ব্যাপার।

৩) ইংরেজীতে একটা কথা আছে, “you are what you eat” – একথার উপর ভিত্তি করেই দেখবেন মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণের পেশায় যারা নিয়োজিত, তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করবেন, আপনি কোন ধরনের মাংস খেতে পছন্দ করেন – চিকেন, ল্যাম্ব না বীফ। সাধারণভাবে দেখা যায় যে, আপনি যদি চিকেন পছন্দ করেন, তা হলে বেশী শারীরিক পরিশ্রমের কাজগুলোতে আপনার স্বভাবগত অনীহা থাকবে। আবার আপনি যদি বীফ বা গরুর মাংস বেশী পছন্দ করেন, তাহলে এটা সম্ভাব্য যে, আপনি শরীরী কাজগুলোতে অন্যদের তুলনায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন। এই প্রসঙ্গে এতগুলো কথা এজন্য বল্লাম যে, আপনি যা খাবেন তার যে একটা সরাসরি ছাপ পড়বে আপনার চরিত্রের উপর – সে কথাটা বুঝাতে।

“ফাস্টফুড” খেতে গিয়ে আপনি যদিওবা একটা প্রাথমিক বাছাই করতে পারেন – চিকেন, মাটন না বীফের তৈরী খাদ্য খাবেন – কিন্তু সত্যিকার অর্থে আপনি ঐ খাদ্যের উৎপত্তি, মান বা উপাদানসমূহ সম্বন্ধে একদমই নিশ্চিত হতে পারবেন না। পাঠক হয়তো জেনে থাকবেন যে বেকিং-এ (জিলাটিন, মনো গ্লিসারাইড, ডাই গ্লিসারাইড, এনিমেল শর্টেনিং), রান্নার সামগ্রীতে(তেলে, মার্জারিনে বা চর্বিতে মিশ্রিত অবস্থায়), এপিটাইজার/সস ইত্যাদিতে (জিলাটিন, ওয়াইন ভিনেগার), ফ্রোজেন পিজার পনিরে (রেনেট, জিলাটিন, মনো গ্লিসারাইড, ডাই গ্লিসারাইড, এনিমেল শর্টেনিং), আইসক্রীমে (জিলাটিন, মনো ও ডাই গ্লিসারাইড, স্টেরেট) ও চকোলেটে (মনো ও ডাই গ্লিসারাইড, জিলাটিন, চর্বি) এমন অনেক উপাদান রয়েছে যেগুলোর উৎস শূকর হবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। সন্দেহজনক উপাদানগুলির সব ক’টির উৎস যে কেবলই শূকর, এমন কোন কথা নেই – যেমন গ্লিসারাইড উদ্ভিজও হতে পারে, আবার সিনথেটিকও হতে পারে – কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সাধারণত শূকর উৎসের উপাদানগুলো আবার তুলনামূলকভাবে সস্তাও। সুতরাং ‘ফাস্টফুড’ মুখে তোলার আগে, আপনার জানার অনেক কিছু রয়েছে, কিন্তু আপনি কি মনে করেন যে, আপনার পক্ষে সেসব জানা সম্ভব? যে দেশের মানুষ, ঐতিহ্যগতভাবে ঈদের সাথে সম্পৃক্ত সিমাই বা লাচ্ছা সিমাই, শূকরের চর্বি দ্বারা ভাজা জেনেও অকুন্ঠভাবে বাজারজাত করতে পারে, সে দেশের মানুষ ১০ গুণ মুনাফা অর্জনকারী কোন দ্রব্যের উপাদানের কোন ত্রুটি সম্বন্ধে সাধারণভাবে (বিশেষ ব্যতিক্রমের কথা বলছি না আমরা) আপনাকে অবহিত করবে বলে আপনার মনে হয়? তাহলে দেখুন হারাম তো বটেই – “you are what you eat” নিয়ম মতে আপনার চরিত্রে শূকরসুলভ বৈশিষ্ট্য যোগ হবার যথেষ্ট আশংকা রয়েছে!

এ তো গেল একটা দিক। এবার আরেকটা দিকে আসি। ‘ফাস্টফুডে’ যে সব মাংস ব্যবহার করা হয়, সেগুলো সাধারণত ফার্ম থেকে আসে – আর বিশ্বজুড়ে ব্যবসায়িক কারণে profit maximization করতে গিয়ে গরু-ছাগল বা মুরগীর ফার্মে এসব প্রাণীকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে মোটা করার কাজে Growth Hormone ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই Growth Hormone মূলত প্রাণীজ স্ত্রী-হরমোন। বেশী হারে খাদ্যের সাথে এই হরমোন গ্রহণের ফলে, মানুষের শরীরে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে। আমার সহকর্মী সিঙ্গাপুরী এক ক্যাপ্টেনের বোনের ছেলে, আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন একটি “ভাজা-মুরগী” চেইনের খাবারের প্রতি ছেলেবেলা থেকে অত্যন্ত আসক্ত ছিল। বয়ঃসন্ধির আশেপাশে কোন এক সময় তার বক্ষদেশ স্ফীত হতে শুরু করলে তাকে সেজন্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হয়। ডাক্তারের মতে ঐ “ভাজা-মুরগী” চেইনের মুরগী-বাহিত Growth Hormone তার বক্ষের স্ফীতির জন্য দায়ী। পাঠক হয়তো জেনে থাকবেন যে, আজকাল পশ্চিমা দেশের মেয়েদের, শিশু মস্তিষ্কসম্পন্ন ৯/১০ বছরের শরীরে যুবতীর যৌবন, রীতিমত একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে – এই সমস্যা বা সে সব দেশে বর্ধিত হারে সমকামী প্রবণতার জন্য মাংস ও দুগ্ধজাতদ্রব্য বাহিত Growth Hormone-কে একটা কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন চিকিৎসকরা।

অন্য যে কোন শিল্প-সামগ্রীর মতই ‘খাদ্যদ্রব্য’ এখন হচ্ছে একটা শিল্প-সামগ্রী। অন্য শিল্প-সামগ্রীর মতই খাদ্যদ্রব্যও তাই যত কম খরচে, যত বেশী উৎপাদন করা যায় এবং যত বেশী লাভে তা বিক্রী করা যায়, সে ব্যাপারে খাদ্যশিল্পের বিশাল বহুজাতিক কোম্পানীগুলো সদা তৎপর ও সজাগ দৃষ্টিসম্পন্ন। বলা বাহুল্য যে, এসব দ্রব্যাদি উৎপাদন-স্থলে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়ে থাকে এবং আজকের ‘বিশ্বায়নের’ এই যুগে এটা ধরেই নেয়া হয় যে, এসব দ্রব্যাদি সেখানেই যাবে যেখানে এসবের বাজার রয়েছে। আজ তাই ব্রাজিলের একটা ডেইরি বা পোল্ট্রি ফার্মে ‘উৎপাদিত’ মাংস বা ‘মাংসজাত’ খাদ্যদ্রব্য যেমন ‘সসেজ’, ‘নাগেট’ বা বার্গারের ‘প্যাটি’ – হয়তো দেখা যাবে সৌদী আরবে বাজারজাত হচ্ছে; ঠিক যেমন ভারতের বা বার্মার মৎস্য খামারে উৎপাদিত রুই বা পাঙ্গাস মাছ আজ বাংলাদেশে বাজারজাত হচ্ছে। উৎপাদন-প্রান্তে profit maximize করার প্রচেষ্টার কাছে, বিক্রয়-প্রান্তের ক্রেতাদের ইচ্ছা/অনিচ্ছার ব্যাপারটা অত্যন্ত গৌণ হয়ে দাঁড়ায় – যা বড়জোর কাগজে কলমে আনুষ্ঠানিকতার গুরুত্ব পেতে পারে। গতবছর ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রাপ্ত একটা খবরে বলা হয়েছিল যে, ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যে সব হালাল গো-মাংস বাজারজাত করা হয়েছিল, তার ৭৫% এসেছিল pork fed cows অর্থাৎ, খাদ্য হিসেবে যাদের শূকরের মাংস দিয়ে প্রতিপালন করা হয়েছিল, সেসব গরুর উৎস থেকে । আমাদের দেশে বাইরে থেকে যে সব দানবাকৃতি রুই, পাঙ্গাস বা মাগুর আসে, সেগুলোকে কিভাবে প্রতিপালন করা হয়, তা আমি নতুন করে বলে স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল পাঠকদের বিবমিষার উদ্রেক করতে চাই না। এছাড়া দেশে বা বিদেশে ‘ফাস্টফুডে’ ব্যবহৃত মাংসের যোগানদাতা পশুগুলির জবাই করার প্রক্রিয়া যদি শুদ্ধ বলে ধরেও নিই, তবুও কিমা, প্যাটি, সসেজ ইত্যাদি যখন বানানো হয় তখন একটা পশুর কি নেয়া হয় আর কি বাদ দেয়া হয় – সেটা রীতিমত গবেষণা ও investigative journalism-এর বিষয়। আমাদের দেশে, এই ঢাকা শহরেই জ্যান্ত মুরগীর বাজারে বিক্রীর অপেক্ষায় থাকাকালীন সময়ে, যে সব মুরগী মরে যায় – সেগুলো যে সন্তর্পণে ‘চালু’ বা ‘গণ’ হোটেলগুলোর মেন্যুতে স্থান পায় – এমন কথা শুনে আসছি একযুগেরও বেশী সময় আগে থেকেই, যখন সত্যিকার অর্থে – আজকের দিনের নাজুক ব্রয়লার মুরগীর মত খাদ্য-শিল্পের অস্তিত্ব ছিল না।

এবার আসুন খাদ্যশিল্প সংরক্ষণের দিকটাতে। বহু বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের কোন টিভি চ্যানেলে দেখা একটা মজার বিজ্ঞাপন বেশ মনে করতে পারি। কোন এক বার্গার কোম্পানী তার নিজের বার্গারের গুণাগুণ বর্ণনার আগে, সাধারণভাবে বাজারে যে সব বীফ বার্গার পাওয়া যায় সেগুলার বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করছিল। একজন লোক একটি চাকতি সদৃশ জিনিস দেখিয়ে বলছিল যে, ওটা হচ্ছে বাজারে প্রচলিত বার্গারে ব্যবহৃত একটা মাংসের ‘প্যাটি’ – প্রথমে সে তা দেয়ালে ছুঁড়ে দেখালো যে তা অক্ষত ও অখন্ডই রয়ে গেল – অর্থাৎ, তা কি রকম শক্ত! তারপর সেটাকে দিয়ে দুটো দল ‘আইস্-হকি’ খেললো এবং খেলা শেষেও দেখা গেলো মাংসের ঐ চাকতিখানি অক্ষত ও অখন্ড রয়ে গেছে – তখন লোকটি বললো যে, তাদের বার্গার ঐ ধরনের পাথরসম ‘প্যাটি’ দিয়ে তৈরী নয় বরং ‘তাজা’ বীফের তৈরী ইত্যাদি ইত্যাদি। পাঠকের অবগতির জন্য বলছি: উৎপাদিত খাদ্য সংরণ, সুস্বাদুকরণ ও এর শোভাবর্ধনে এমন সব রাসায়নিক দ্রব্যাদি ও এমন সব পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়ে থাকে, যেগুলো মানবদেহের ও স্বাস্থ্যের জন্য মোটেই সহনীয় বা হিতকর নয়। (চিনি বা লবণের মত কিছু প্রাকৃতিক সংরক্ষণকারী পদার্থ ছাড়া) preservative বলতে যে সব রাসায়নিক দ্রব্যাদিকে বোঝায়, তার অধিকাংশই আমাদের জন্য ক্ষতিকর । স্বাদ বা গন্ধ আকর্ষণীয় করে তোলার জন্যও এমন অনেক রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করা হয়, যেগুলো আমাদের জন্য মারাত্মক মাত্রায় ক্ষতিকর – বহুল ব্যবহৃত Mono Sodium Glutamate হচ্ছে এধরনের একটি উপাদান। আর খাদ্যে ব্যবহৃত কৃত্রিম রং যে খারাপ – তা সচেতন পাঠক মাত্রই জেনে থাকবেন। পশ্চিমা দেশে অনেক শিশুদের ‘হাইপার-একটিভ’ বা ‘অস্বাভাবিক রকমের চঞ্চল’ হবার জন্য ‘ফাস্টফুড’ বা ‘জাঙ্কফুডে’ ব্যবহৃত রাসায়নিক সামগ্রীকে দায়ী করা হয়। ‘হাইপার-একটিভ’ বাচ্চাদের মানবিক গুণাগুণ প্রায় ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক ভাবে বিকশিত হয়না – বরং বেশী চঞ্চল হবার কারণে, তাদের প্রাণশক্তির অপচয় হয় এবং অন্য ক্ষেত্রে পূর্ণতা লাভ করতে তারা হয়তো ধীরগতি হয় – যেমন বাচ্চা হয়তো দেরীতে কথা বললো অথবা অমনোযোগী স্বভাবের হলো ।

আমি এত কথা বলছি আপনাকে শুধু এটুকু বোঝাতে যে – আপনি, আপনার দেশ বা আপনার জাতি যত বেশী ‘ফাস্টফুড কালচারে’ অভ্যস্ত হয়ে উঠবেন, নিজের খাদ্যের ব্যাপারে সঠিক তথ্য সংগ্রহে এবং তার মান নিয়ন্ত্রণে আপনার অপারগতা ততই বৃদ্ধি পাবে।

আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করতে আল্লাহ্ আমাদের নিষেধ করেছেন। আল্লাহ্ তা‘লা তাঁর সৃষ্ট প্রকৃতিকে বিকৃত করার ব্যাপারটাকে, “মানুষকে দিয়ে করানো শয়তানের ইচ্ছার কাজ বলে বর্ণনা করেছেন” (কুর’আন, ৪:১১৯)। কিন্তু মানুষ আরো বহু কিছুর মতই খাদ্যদ্রব্যকে, নিজের লোভের যোগান দিতে যে ভাবে যথেচ্ছ পরিবর্তন করে চলেছে, সেটাকে নিঃসন্দেহে আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করার প্রয়াস বলা যেতে পারে। যেমন, দুধের ‘খারাপ হয়ে যাওয়া’ রোধ করতে এবং তা দূরদূরান্তে বাজারজাত করতে যে ভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়, তাতে দুধের মূল গুণাগুণ অনেকাংশেই নষ্ট হয়ে যায়। এটা নিঃসন্দেহে আল্লাহর সৃষ্টির বিকৃতি সাধন। একইভাবে স্ট্র-বেরী যাতে সহজেই পচে না যায় এবং স্ট্র-বেরীর ‘শেলফ্-লাইফ’ যাতে বৃদ্ধি করা যায়, সেজন্য সেগুলোকে রশ্মি দিয়ে ‘মেরে’ ফেলা হয়, তখন তারা মৃত ফলে পরিণত হয় । সুন্দর দেখানোর জন্য বা বড় আকারে প্রচুর ফলনের জন্য এখন শাক-শব্জি, ফল-মূল বা শস্য ইত্যাদিকে Genetically Modified(GM) করা হচ্ছে – অর্থাৎ ‘জিন’ পর্যায়ে পরিবর্তন সাধন করে নানা অস্বাভাবিক গুণাগুণ যোগ করা হচ্ছে। এসব বিকৃতির পরিপূর্ণ অনিষ্টকর পরিণাম জানতে হয়তো আরো কিছু সময় লাগবে – তবে ইতোমধ্যেই সারা বিশ্বের সচেতন মানুষ এসব বিকৃতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। এই তো সেদিন যুক্তরাষ্ট্রের Taco (এক প্রকার মেক্সিকান খাবার) বিক্রেতা এক স্বনামধন্য ‘ফাস্টফুড’ চেইন-শপের বিরুদ্ধে GM-ভূট্ট্রা দ্বারা প্রস্তুত খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়েছেন বলে অভিযোগ তুলে মামলা দায়ের করলেন এক ক্রেতা। এছাড়া দেখুন যে উপায়ে, উদাহরণ স্বরূপ, ব্রয়লার মুরগী প্রতিপালন করা হয় – তা নিঃসন্দেহে আল্লাহর সৃষ্টি ‘মুরগী প্রজাতির’ প্রাকৃতিক “লাইফ-সাইকেল” বা “জীবন-চক্রের” বিকৃতি। উপরন্তু হরমোন প্রয়োগও নিঃসন্দেহে সৃষ্টির বিকৃতি। এসবই করা হয় কেবল একটা উদ্দেশ্যে – সম্ভাব্য সর্বাধিক মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে। আমাদের বিশ্বাসমতে আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করার প্রচেষ্টা থেকে কখনো মঙ্গলময় কিছু আসবে না – আর তা যে সত্যি তা উপরে আলোচিত বিষয়াবলী থেকে সহজেই অনুমান করা যায়। (প্রসঙ্গত মনে পড়লো, বাংলাদেশ, স্বাধীনতার পরবর্তী কয়েক বছরের মাথায় হঠাৎ উন্নত বিশ্বে ব্যাঙের পা রপ্তানী করতে শুরু করলো। ব্যাঙ যেহেতু আমাদের দেশে খাওয়া হয় না এবং তা প্রচুর পরিমাণে পাওয়াও যেত – সুতরাং উৎসাহের ও লোভের আধিক্যে ভবিষ্যতের কথা না ভেবে এমন ভাবে ব্যাঙ নিধন শুরু হলো যে, অল্পদিনের ভিতরই সবাই বুঝলেন যে, পোকামাকড়ের আধিক্যে এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। আল্লাহর সৃষ্টি, প্রাকৃতিক পরিবেশকে এখানে বিকৃত করা হচ্ছিল।)

পবিত্র কুর’আনে অন্তত চারটি আয়াতে (২:১৬৮, ৫:৮৮, ৮:৬৯, ১৬:১১৪) আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘লা খাদ্যের কথা বলতে গিয়ে حَلَالًا طَيِّبًا [“হালালান তায়্যিবান”] অর্থাৎ, lawful and good বা ‘বৈধ ও উত্তম’ খাবারের কথা বলেছেন। এছাড়া – “আল্লাহ্ তোমাদের যে সব ‘উত্তম খাবার’ দান করেছেন তা থেকে আহার কর” – এরকম কথা বলা হয়েছে অন্তত আরো চারটি আয়াতে(২:৫৭, ২:১৭২, ৭:১৬০, ২০:৮১)। খাঁটি খাদ্যের/পানীয়ের কথা বলা হয়েছে অন্তত সাতটি আয়াতে (৫:৪, ৫:৫, ১১:৮৮,১৬:৬৬, ১৭:৭০, ৪৫:১৬, ৪৭:১৫)। উপরন্তু স্বাস্থ্যকর (wholesome) খাবার ও পানীয়ের কথা উল্লেখিত হয়েছে অন্তত আরো তিনটি (৪:১৬০, ১৬:৬৭, ৭৭:২৭) আয়াতে। এ থেকে বোঝা যায় যে, খাবার হালাল হবার বাধ্যবাধকতার সাথে সাথে তা যেন ‘উন্নত উৎসের’ ‘খাঁটি’ হয়, ‘উত্তম’ হয় এবং ‘স্বাস্থ্যকর’ হয় সে ব্যাপারেও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। পাঠকের অবগতির জন্য আমরা নীচে, উপর্যুক্ত আয়াতসমূহের একটি আয়াত(২:১৬৮) অর্থসহ তুলে দিলাম:

يَا أَيُّهَا النَّاسُ كُلُوا مِمَّا فِي الْأَرْضِ حَلَالًا طَيِّبًا وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ

“হে মানুষ, জমিনে যে সব হালাল ও পবিত্র দ্রব্য রহিয়াছে, তাহা খাও এবং শয়তানের প্রদর্শিত পথে চলিও না; সে তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু ।” (সূরা বাক্বারা, আয়াত ২:১৬৮)

ফাস্টফুড কালচার – শেষ পর্ব

৩১ শে অক্টোবর, ২০১০ রাত ১০:৩৫

এর আগের পর্বটায় আমরা কথা বলছিলাম “ফাস্টফুড কালচারের” সমস্যা নিয়ে। সাধারণ যুক্তিতে মনে হতে পারে যে, আমার উপার্জন যদি হালাল হয় – আর যে মাংস দিয়ে বার্গার বা সসেজ বানানো হচ্ছে, তা যদি হালাল হয়ে থাকে – তাহলে সমস্যাটা কোথায়? আমরা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সমস্যাগুলো নিয়ে গত সংখ্যাগুলোয় আলোচনা করেছি! আসুন আমরা চতুর্থ তথা শেষ সমস্যাটা আজ ভেবে দেখি:

৪) কিছুদিন আগে আমার আপনজন একজন মা, তার মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলেন ‘O’-level পরীক্ষার হলে। মেয়ের পরীক্ষা শেষে বাড়ী ফিরে এসে আমাকে বলছিলেন যে, পরীক্ষা দিতে আসা ছেলে-মেয়েগুলোকে (বিশেষত ছেলেগুলোকে) দেখে তার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল – তার অবচেতন মনে কোথাও একটা কিছু খটকা লাগছিল – অথচ, তিনি তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারছিলেন না, কেন তার অস্বস্তি লাগছিল। পরে তিনি বোঝেন যে, পরীক্ষা দিতে আসা ছেলেগুলো হয় plump (বা নাদুস-নুদুস) অথবা obess (বা স্থূলকায়) দেখে তার অস্বস্তি হচ্ছিল। এর আগে নিজের ছেলে বা তার ভাগ্নেকে নিয়ে তিনি যখন এস,এস,সি পরীক্ষার প্রথম দিনে হলে গিয়েছেন – তখন আমাদের দেশের ঐ বয়সের ছেলেরা গতানুগতিক দেখতে যেমন হয়, অর্থাৎ রোগা পটকা – পরীক্ষা দিতে আসা ছেলেগুলোকে তেমনই দেখেছেন। অথচ, ‘O’-level পরীক্ষার হলে একটা বিশেষ শ্রেণী থেকে আসা ছেলেমেয়েগুলোকে দেখে, তাদের আমাদের সন্তান বলে মনে হচ্ছিল না – যেন কোন ভিন গ্রহবাসী মনে হচ্ছিল। তার মেয়ে, (আলহামদুলিল্লাহ্) স্কুলের শিক্ষার বাইরে কোন প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে না পড়ে ‘O’-level দিয়ে থাকলেও, এ ব্যাপারে সে সত্যিই এক বিরল প্রজাতি। ইংরেজী মিডিয়াম স্কুলের উপরের ক্লাসে পড়া ৯৯% ছেলেমেয়েই প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়ে। প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে যাওয়া এবং ঢাকার কোন ‘অভিজাত’ ইংরেজী মিডিয়াম স্কুলের উপরের ক্লাসে অধ্যয়নরত কোন একটি ছেলের একমাসের পড়াশোনার খরচ অনায়াসে ৩০,০০০/- হতে পারে। মাননীয় পাঠক! কোন সৎ আমলার কথা বাদই দিলাম, মোটামুটি সৎ কোন মাঝারি শ্রেণীর ব্যবসায়ীর জন্যও ব্যাপারটা কত দুঃসাধ্য, সেটা অনুধাবন করতে কারো কষ্ট হবার কথা নয়। বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু ‘বাৎসরিক’ আয় ৩৫,০০০ টাকার মত। আমার তো মনে হয় দুর্নীতি সংক্রান্ত যে কোন তদন্ত এসব ইংরেজী মিডিয়াম স্কুল সূত্র থেকেই শুরু হতে পারে। যাহোক্, একথা তাহলে নিরাপদেই ধরে নেয়া যায় যে, দেশের স্বনামধন্য ইংরেজী মিডিয়াম স্কুলগুলোতে যারা সন্তান পাঠান, তাদের অধিকাংশই, বালজাকের সেই বিখ্যাত বাণী: “Behind every fortune there is a crime” মোতাবেক অসৎ, দুশ্চরিত্র, জনসম্পদ আত্মসাতকারী ও সুবিধাবাদী। তাই আমাদের সর্ব-সাম্প্রতিক “ঘোড়ারোগের” একটি – ‘ফাস্টফুড-প্রীতি’ নিঃসন্দেহে তাদেরই বেশী মানায় এবং তাদের সন্তানরাই সে সব বেশী afford করতে পারে। এজন্যই পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশের একটি – বাংলাদেশের – এই বিশেষ শ্রেণীর ছেলেমেয়েরা মেদবাহুল্য বা obesity সমস্যায় ভোগে।

কুফফার-শ্রেষ্ঠ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে “অতিশয় স্থূলতা” বা obesity একটা জাতীয় রোগ হতেই পারে, কারণ সে দেশের নাগরিকেরা পৃথিবীর জনসংখ্যার ৫% হলেও, তারা পৃথিবীর সম্পদের ৬০% ভোগ করে থাকে এবং সেদেশের ছেলেমেয়েরা একদিনে গড়ে ২২বার খাবারের সংস্পর্শে আসে – বলতে পারেন গবাদি পশুর মত সব সময়ই তাদের মুখ নড়তে থাকে। কিন্তু এশিয়ার অপেক্ষাকৃত গরীব দেশগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে “বার্গার-সংস্কৃতি” রফতানী করাতে, এসব দেশেও obesity, এক জাতীয় সমস্যার রূপ ধারণ করছে। এই তো সেদিন, ‘এশিয়ার নতুন প্রজন্মের মাঝে “অতিশয় স্থূলতা” সমস্যাকে’ প্রচ্ছদে স্থান দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত একটি আন্তর্জাতিক সাপ্তাহিকী। প্রচ্ছদের ছবিটা ছিল কতিপয় অতিশয় স্থূলকায়া চীনা বালিকার/তরুণীর – কমব্যাট জ্যাকেট পরিহিত অবস্থায় তারা কুচকাওয়াজরত – বুঝিবা তারা গণচীনের সামরিক বা আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যা। যে চীন, অন্নের সংস্থান করার মুখের সংখ্যা সীমিত রাখতে – পরিবার প্রতি মাত্র একটি সন্তানের আইন পাশ করতে পারে, সেখানে “অতিশয় স্থূলতা” বা obesity একটা সমস্যা হওয়াটা নিয়তির কি নির্মম এক পরিহাস! বহির্বিশ্বের কাছে সত্যিকার অর্থে নিজেদের উন্মুক্ত করার দেড় দশকের মধ্যেই, একদিকে অন্য অনেক কিছুর বেসরকারীকরণের সাথে সাথে দুর্নীতির যেমন ফ্রি-স্টাইল বেসরকারীকরণ ঘটেছে, তেমনি ঐ দেশের সংরক্ষিত বাজার উন্মুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সাংস্কৃতিক-প্যাকেজ’ আমদানির জন্য। বলা আবশ্যক যে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা গণচীনের বিশাল বাজারে জেঁকে বসা অন্যতম প্রধান ব্যবসায় হচ্ছে ‘ফাস্টফুডের’ ব্যবসায় – আর সেই সুবাদে তাদের এই “অতিশয় স্থূলতার” সমস্যা।

উপরে আলোচিত খাওয়া-দাওয়া বিষয়ক ব্যাপারগুলো সম্বন্ধে ইসলামের নবী (সা.) কি বলেছেন বা তিনি কি মনে করতেন, আজ আমরা হয়তো তা আর মনেও করতে পারি না। তা না হলে মোল্লা/মৌলবীদের সাথে বা ইসলামজীবীদের সাথে, দাওয়াত খাওয়া বা ভুরিভোজনের এমন নিবিড় সম্পর্ক কি থাকতে পারতো? রোজার মাসে, রোজা ভাঙ্গার পরে খাবারের মহোৎসবে আত্মনিয়োগ করে আমরা কি আমাদের ওজন বাড়াতে পারতাম?? আমরা তো কেবল লম্বা কুর্তার ঝুলে নবীর সুন্নত দেখতে পাই! আমরা কি জানি যে, অতিরিক্ত খাওয়াকে নবী(সা.) কাফিরের বৈশিষ্ট্য বলে বর্ণনা করেছেন?? আমি নীচে দুটো হাদীস তুলে দিচ্ছি, যেগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেবে যে, আমাদের নবী(সা.) অতিরিক্ত খাওয়া দাওয়াকে কত অপছন্দ করতেন:

# Sahih Al-Bukhari HadithHadith 7.305 Narrated by Nafi

Ibn ‘Umar never used to take his meal unless a poor man was called to eat with him. One day I brought a poor man to eat with him, the man ate too much, whereupon Ibn ‘Umar said, “O Nafi’! Don’t let this man enter my house, for I heard the Prophet saying, ‘A believer eats in one intestine (is satisfied with a little food), and a kafir (unbeliever) eats in seven intestines (eats much food).’ ”

উপরে বর্ণিত এই হাদীসে রাসূল(সা.) বলেছেন যে, একজন বিশ্বাসী এক পেটে খায় – অর্থাৎ অল্প খাবারে সন্তুষ্ট থাকে। অথচ, একজন কাফির সাত পেটে খায় – অর্থাৎ, তার অনেক খেতে হয়। উপর্যুক্ত হাদীসের বর্ণনা করতে গিয়ে স্কলাররা বলেন যে, আখেরাতে বিশ্বাস নেই বলেই, কাফির পৃথিবী থেকে ভোগ-বিলাস, সুখ-স্বাচ্ছন্দ এবং ঐশ্বর্য-সম্পদ সম্ভাব্য সর্বাধিক আহরণ করার জন্য মরীয়া হয়ে ওঠে – তারই প্রতিফলন ঘটে তার ‘খাই খাই’ মনোভাবে ও আচরণে।

##Sahih Al-Bukhari HadithHadith 3.819 Narrated by Zahdam bin Mudrab

I heard Imran bin Husain saying, “The Prophet said, ‘The best people are those living in my generation, then those coming after them, and then those coming after (the second generation).’ ” Imran said “I do not know whether the Prophet mentioned two or three generations after your present generation. The Prophet added, ‘There will be some people after you, who will be dishonest and will not be trustworthy and will give witness (evidences) without being asked to give witness, and will vow but will not fulfill their vows, and fatness will appear among them.”

দ্বিতীয় হাদীসটিতে দেখুন, নবী (সা.) বলছেন যে, প্রথম তিন প্রজন্মের মুসলিমদের পরেই, কিছু মানুষ অসৎ ও অবিশ্বস্ত হবে – তারা মিথ্যা সাক্ষী দেবে এবং প্রতিজ্ঞা করে তা রক্ষা করবে না। আর এর সাথে সাথেই আরো যে ‘খারাপত্ব’ মানুষের মাঝে দেখা দেবে বলে তিনি বলেছেন, সেটাকে সহজ বাংলায় বলতে চাইলে বলতে হবে যে, মানুষের মাঝে ‘মেদ-ভূঁড়ি’ দেখা দেবে বলে তিনি ভবিষ্যৎ বাণী করেছেন! পাঠক, ভেবে দেখুন! আল্লাহ্-প্রদত্ত অসাধারণ দৈব-দৃষ্টিগুণে, খারাপ ব্যাপারগুলোর সাথে ‘মেদ-ভুঁড়ি’ বা ‘স্থূলত্বকে’ তিনি কি সুন্দর সম্পৃক্ত করে গেছেন – প্রায় দেড় হাজার বছর পরে আজকের আলোচনার প্রস্তাবনায় আমরা যা দেখানোর চেষ্টা করলাম এতক্ষণ ধরে।

মাননীয় পাঠক! আমাদের আলোচনার প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি আমরা। অক্টোপাসের যেমন অনেক কয়টি শুঁড় বা tentacles রয়েছে, তেমনি কুফরের যে দানব মুসলিম উম্মাহকে আজ আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে এবং ক্রমাগত নিষ্পেষিত করে চলেছে, তারও অনেক ক’টি শুঁড় রয়েছে। বহু শুঁড় বিশিষ্ট কুফরের এই দানবকে আসলে হত্যা করে সম্পূর্ণ পরাজিত করতে হবে – তা না হলে এর একটি শুঁড়কে কেটে, এর কাছ থেকে মুক্তি পাবার কোন উপায় নেই। তবু আমি চেষ্টা করেছি ‘কুফরি-কালচারের’ বহুমাত্রার বিপদের একটি বিপদকে অন্তত পাঠকের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে। আমি জানি আপনি ‘আকাশ-সংস্কৃতির’ আগ্রাসনের বিহিত না করে, কেবল “ফাস্টফুড কালচার” ত্যাগ করে বেশীদূর অগ্রসর হতে পারবেন না। তেমনি ধরুন আপনি আকাশ সংস্কৃতি বর্জন করলেন কিন্তু কুফফারের শিক্ষা ব্যবস্থায় ডুবে রইলেন – আপনি কি দ্বীন কায়েম করতে পারবেন ? পারবেন না! আপনাকে বুঝতে হবে যে, দ্বীন ইসলামের মতই কুফরও হচ্ছে একটা integrated system এবং integrated whole বা পরিপূর্ণ ব্যবস্থা – বলা যায় ইসলামের ‘এন্টি-থেসিস’। তাই সেই ব্যবস্থার হাত থেকে মুক্তি পেতে হলে সেটাকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করতে হবে – খানিকটা ত্যাগ করে লাভ নেই।

This Post Has One Comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *