পেশা ও ইসলাম: কিভাবে সঠিক সমন্বয় সাধন করতে হবে
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আস সালামু আলাইকুম!
আজকের আলোচনার প্রস্তাবনা এরকম একটা কিছু: ধর্ম–কর্ম ও কাজ বা পেশার ভেতর একটা সমন্বয় কিভাবে ঘটানো যায়! ইসলামী সমাজের প্রেক্ষাপটে বা মুসলিম জীবনের ভিত্তিতে, এরকম একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করা প্রায় অসম্ভব। অন্য যে কোন সমাজব্যবস্থা – যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলিম না হয়ে অন্য যে কোন ধর্মাবলম্বী অথবা নাস্তিক – সেখানে আলোচনার জন্য এরকম একটা বিষয়বস্তুর যৌক্তিকতা বা যথার্থতা থাকত। কেন, তা না হয় একটু খোলাখুলিই আলাপ করা যাক।
প্রথমত, বুঝতে হবে যে, ইসলাম কোন ধর্মের নাম নয়, যেভাবে Christianity একটা ধর্মের নাম। ইসলাম হচ্ছে এক পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা বা দ্বীনের নাম; যার আওতায় সত্যি বলতে কি, মুসলিম জীবনের অন্য সব কিছুর মতই, কাজকর্ম বা পেশাও অন্তর্ভুক্ত। ইসলামের কাছে আত্মসমর্পণ করা কোন মুসলিমের কাছে তাই ইসলামের পাশাপাশি ইসলামবিরুদ্ধ বা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক কোন ব্যাপার বেছে নেয়ার অবকাশই নেই। উদাহরণস্বরূপ আমরা যুক্তরাষ্ট্রের পটভূমিতে একজন পেশাজীবীর কথা চিন্তা করতে পারি: যুক্তরাষ্ট্রের average নাগরিকের কাছে, কাজ-কর্ম বা পেশা এবং ধর্মকর্ম সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি জগৎ বা বলয় – যাদের ভিতর কোন intersection নেই। আর তাই সত্যিকার অর্থে বিশেষ কোন বিরোধও নেই। এ ব্যবস্থার একজন মানুষের বেছে নেবার বিষয় হচ্ছে, কাজেকর্মে সে কতটুকু সময় ব্যয় করবে, আর প্রার্থনায় সে কতটুকু সময় ব্যয় করবে – প্রায় সময়ই যা কিনা সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক। যে নিজেকে খুব ভাল খ্রীস্টান মনে করে, সে হয়ত প্রতি সপ্তাহের রবিবারে দুঘন্টার জন্য চার্চে যাবে, যে নিজেকে অতটা ভাল খ্রীস্টান মনে করে না, তার হয়ত বছরে একবার বা দুইবার Christmas বা Easter উপলে চার্চে গেলেই চলে। কিন্তু নিজেদের মুসলিম বলতে চাইলে, আমরা যেমন রোজকার পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের বদলে এক ওয়াক্ত নামায পড়তে পারি না, তেমনি প্রতি সপ্তাহের জুমু‘আর বদলে কেবল মাসে একদিন জুমু‘আ পড়ে নিয়ে দায়মুক্ত হতে পারি না। আমাদের পেশা বা জীবন, জরুরী ভিত্তিতে এমন কোন দাবী রাখতে পারে না যে, আমরা সালাতকে একপাশে রেখে কেবল কাজকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করতেই থাকব। পাগল, শিশু ও ঘুমন্ত বা অজ্ঞান ব্যক্তি ছাড়া সবাইকে সালাত আদায় করতেই হবে – পছন্দ হোক বা না হোক।
আমরা তাহলে আজকের প্রস্তাবনাকে একটু ঘুরিয়ে এভাবে বলি: দুনিয়ার কাজকর্ম ও আখিরাতের জন্য কাজকর্মের মাঝে মুসলিম হিসেবে আমরা কিভাবে সমন্বয় ঘটাবো। দুনিয়াতে যে আসেনি, বা পৃথিবীতে যার জন্ম হয়নি, তার কোন আখেরাত নেই। অর্থাৎ, দুনিয়াই হচ্ছে আখিরাতের ভিত্তি – যারা গণিত জানেন, তাদের আরও সহজে বোঝাতে গেলে বলা যেত যে, আখেরাত হচ্ছে দুনিয়ার function। দুনিয়ার জীবনটাতে সুন্দর ও সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে ন্যূনতম যেটুকু প্রয়োজন, অন্তত সেটুকু লাভ করতে পারলে আমরা দুনিয়ায় টিকে থাকব এবং আখেরাতে অনন্তকালের জীবনের জন্য পাথেয় সঞ্চয় করতে ইবাদতে আত্মনিয়োগ করতে পারব।
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের ৫১:৫৬ আয়াতে বলেছেন যে, তিনি জ্বীন ও মানুষকে তাঁর ইবাদত ছাড়া অন্য কোন কারণে সৃষ্টি করেননি। মুসলিম বিশ্বাস মতে তাই, আল্লাহ যে আমাদের পৃথিবীর জীবন দিয়েছেন, তার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর ইবাদত করা – অবিশ্বাসীদের মত কেবল Life enjoy করা নয়। একটি মাত্র জীবনে ভোগ–সুখের যত মাত্রা রয়েছে, তার সব ক’টির সম্ভাব্য সর্বাধিক সদ্ব্যবহার করা উচিত – এটা কোন মুসলিমের বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য হতে পারে না। ইবাদত অর্থ দাসত্ব, বা কারও সকল আদেশ প্রশ্নাতীতভাবে মেনে চলা। এখানে বলা হচ্ছে যে, ইবাদতের জন্য না হলে, আল্লাহ্ মানুষ বা জ্বীন সৃষ্টিই করতেন না – কিন্তু উপর্যুক্ত আয়াতের অর্থ এই নয় যে, কেউ সারাদিন বসে শুধু যিকির করবে অথবা সমাজ সংসার ত্যাগ করে জঙ্গলে চলে গিয়ে আল্লাহর নাম জপবে। একজন মুসলিম যখন সব ব্যাপারে আল্লাহর বিধিনিষেধ মেনে চলবে, তখন উপার্জন বা কারো সাথে হাসিমুখে কথা বলা সহ সকল কাজই ইবাদতে পরিণত হয়। তবে ফিকহ শাস্ত্রবিদরা মানুষের যাবতীয় কর্মকান্ডকে যেরকম দুভাগে ভাগ করেছেন, সে অর্থে আমরা আমাদের সকল কর্মকান্ডকে ইবাদত ও মু’আমালাত এই দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। আমরা যখন আখিরাত, অদৃশ্য ও অদৃষ্টকে সত্য জ্ঞান করে আল্লাহর কোন আদেশ পালন করতে, তাঁর নৈকট্য লাভ করতে বা তাঁর কাছে কিছু চাইতে আত্মনিয়োগ করি, তখন সেটা ইবাদতের পর্যায়ে পড়ে। আর স্ত্রী-পুত্রের জন্য অন্নসংস্থান করতে আমরা যখন কাজে যাই, অথবা ছিঁড়ে যাওয়া জুতা সারাতে যখন মুচির কাছে যাই, তখন আমরা এই কাজগুলোকে মু’আমালাত বলব, কেননা এই কাজগুলো দৃশ্যত পৃথিবীর জীবনে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অথবা টিকে থাকার জন্য করে থাকি আমরা। কিন্তু আগে যেমন বলেছি, সরাসরি ইবাদতের কাজ না হলেও, এসব কাজও যদি আমরা আল্লাহর বিধানের আওতায় থেকে করি, তবে আমরা আখিরাতে নিশ্চয়ই প্রতিদান আশা করতে পারি। স্ত্রীপুত্রের জন্য উপার্জনের কথাটাই ধরুন – যখন আল্লাহর হুকুম মেনে হালাল পথে উপার্জন করে আমরা স্ত্রী–পুত্রের জন্য ব্যয় করব, তখন সেই ব্যয়কে “সাদাক্বা” বলে গণ্য করা হবে (বুখারী)। কিন্তু এখানে কথা আসতে পারে যে, আমরা স্ত্রী-পুত্রের জন্য কতটুকু উপার্জন করবো, অথবা, উপার্জন করতে গিয়ে জীবনের সময়ের কতটুকু ব্যয় করব। রাসূল(সা.) তিরমিযি শরীফের হাদীসে বর্ণনা করেছেন যে, প্রাচুর্য – যা কাউকে কর্তব্য ভুলিয়ে রাখে – তার চেয়ে যা পরিমাণে স্বল্প অথচ পর্যাপ্ত, তা শ্রেয়। এই পর্যাপ্ত কথাটাকে আমরা এখন টেনে হিঁচ্ড়ে এত বড় করে ফেলেছি যে, উচ্চভিলাষী কোন এক্সিকিউটিভের কাছে আজ একখানা BMW S.U.V-কে পর্যাপ্ত মনে হতে পারে – আমি যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলছি না, বরং পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশের একটি বাংলাদেশের কথাই বলছি, যেখানে গড়ে একজন মানুষ সারাবছর কাজ করলে ৭০,০০০ টাকার মত আয় করে। পর্যাপ্ত কতটুকু সেটা বোঝার জন্য তাহলে বিশ্বাসী হিসেবে আমাদের রাসূল(সা.), তাঁর অনুগামী ও অনুসারীদের কাছে ফিরে যেতে হবে। বিশ্বাসী হিসেবে এবং মুসলিম হিসেবে তাঁরা আমাদের paradigm বা set standard হবার কথা। আমি জানি, তাঁরা যা পর্যাপ্ত মনে করতেন, আজ সেটাকে পর্যাপ্ত মনে করাটা আমাদের কাছে বিভীষিকাময় মনে হতে পারে – কারণ আমাদের paradigm বা set standard হচেছ এখন পশ্চিমা বস্তুবাদী ও অবিশ্বাসী সভ্যতা। তবু আমি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কতটুকুকে পর্যাপ্ত মনে করব, সেটুকু বোঝানোর একটা চেষ্টা নেব।
একখানা মসজিদের কথাই ধরুন। একখানা মসজিদের purpose কি? মূলত মসজিদের purpose হচ্ছে সেখানে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে পড়া এবং সপ্তাহের জুমার দিন সহ যে কোন সামাজিক ও সম্প্রদায়ভিত্তিক আয়োজনের স্থান সংকুলান করা। সেজন্য পর্যাপ্ত কি? একখানা ঘর, যা রোদ-বৃষ্টি থেকে সংরক্ষিত, যা মোটামুটিভাবে অতিরিক্ত গরম বা আবদ্ধতাবশত অস্বস্তিকর নয়, ব্যস এতটুকুই পর্যাপ্ত। এরপরের মিনার, গম্বুজ, মেহরাব, মার্বেল পাথরের মেঝে, টাইলস সমৃদ্ধ অজুখানা, কার্পেট সবই বাহুল্য। এখানে কতটুকু পর্যাপ্ত তা ভাবতে গিয়ে আমি বলতে পারতাম: which serves the purpose। এভাবে দেখতে পারলে ব্যক্তিজীবনে আমাদের কতটুকু পর্যাপ্ত সেটা বুঝতে পারা খুব কষ্টকর হবার কথা নয়। অন্নের কথাই ধরুন, পরিবারের সবাই সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর একটা জীবনযাপনের জন্য যতটুকু খাওয়া প্রয়োজন, সেটাকেই আমরা পর্যাপ্ত বলব। একটু বাড়িয়ে ধরলেও সেই পর্যাপ্তের আওতায় বড়জোর তিনবেলার তিনটি স্বাভাবিক meal আসবে – আরো specific ভাবে বলতে গেলে দুপুরের খাবার ভাত, একটি তরকারী ও ডাল সমেত পর্যাপ্ত হবার কথা – যদিও প্রতিদিনের মেনুতে এ ধরনের খাবার রাসূল(সা.) ও তাঁর সাহাবীদের কাছে মদীনার সেই স্বর্ণযুগে অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু ভেবে দেখুন, আমি যেটাকে পর্যাপ্ত বললাম আমাদের কজন সেটাকে পর্যাপ্ত ভাবতে পারে?
দুনিয়ার জন্য এবং আখেরাতের জন্য কর্মকান্ডের উদ্দেশ্যে সময় বন্টন তাহলে এই পর্যাপ্তকে কেন্দ্র করেই নির্ধারিত হতে হবে। পর্যাপ্তের বাইরে সম্পদ আহরণ করতে গিয়ে আমরা যে কেউ যখন সময় ব্যয় করব, তখন আমাদের ভাবতে হবে আমরা কিসের পরিবর্তে কি বেছে নিচ্ছি বা কিসের বিনিময়ে কি trade করছি। আপনি সময় না দেয়াতে আপনার ছেলে বা মেয়েটি যে বিপথগামী হচ্ছে – সেই ক্ষতিটার বিনিময়ে আপনি অন্যত্র সময় দেয়াতে যে বাড়তি ঐশ্বর্য লাভ করেছেন, সেটা worth কিনা তা ভেবে দেখা জরুরী। কারণ, আপনার সন্তানকে আপনি একজন পূর্ণাঙ্গ মুসলিম হিসেবে বড় করতে না পারলে, আখিরাতে আল্লাহর কাছে আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে। কাজেই দুনিয়ায় যা অর্জন করতে গিয়ে আপনি আখিরাতে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়ালেন, তা অর্জন করা আপনার জন্য কতটুকু আবশ্যকীয় ছিল, পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিতে আপনি তা বিচার করতে পারলে – দুনিয়াভিত্তিক ও আখিরাতমুখী কর্মকান্ডের ভিতর আপনি একটা সমন্বয় সাধন করতে পারবেন।
অন্য সকল সম্প্রদায়ের কথা বাদই দিলাম, আমরা মুসলিমরা একটা জিনিস প্রায়ই ভুলে যাই যে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে দুনিয়ার এ জীবনটা আমাদের জন্য ক্ষণস্থায়ী এবং ট্রানজিট স্বরূপ। বিশ্বাসী হিসেবে আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে এই transitory জীবনের কোন সাফল্যেরই কোন অর্থ নেই। কারণ আখেরাতের অনন্ত জীবনে আমরা যেমন এখান থেকে তা বয়ে নিয়ে যেতে পারব না – তেমনি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে না পারলে, এর জন্য বা এর বিনিময়ে সেখানে আমরা কোন প্রতিফলও পাবো না। যেমন ধরুন আপনি, বিল গেটসের মত সফল কোন ব্যক্তি হতে পারলেন – আপনার জীবনের সমস্ত প্রচেষ্টা ও শ্রম সেই লক্ষ্যে ব্যয় করে। কিন্তু আল্লাহর কাছে তা গ্রহণযোগ্য না হওয়াতে আপনি যে নিশ্চিত জাহান্নামী হবেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের সময়কার একটা ছোঁয়াচে রোগ, যা পশ্চিম থেকে আমাদের মাঝে সংক্রমিত হয়েছে, সেটা হচ্ছে: দুনিয়ার বস্তুভিত্তিক সাফল্য ও মর্যাদাকে in itself একটা কিছু মনে করা। সমন্বয়ের প্রশ্নটা এজন্যই আসে। আমরা পশ্চিমাদের মত যেমন সিজারকে সিজারের এবং জিসাসকে জিসাসের অংশ দেয়ার কথা বলে ধর্মীয় আচার আচরণ ও সুখস্বাচ্ছন্দ্যের জন্য জাগতিক প্রচেষ্টাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো জগৎ হিসেবে দেখতে পারি না, তেমনি আল্লাহর সন্তুষ্টিকে সামনে রেখে জীবনের প্রতিটি প্রচেষ্টাকে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ ও বিধিবিধানের সাথে aligned করতেও পারি না। ফলে স্বভাবতই ব্যালেন্স করার প্রশ্ন জাগে বা সমন্বয় করার প্রয়োজন দেখা দেয়। পক্ষান্তরে ইবাদত ছাড়াও মু’আমালাতের প্রতিটি ব্যাপারকেও আমরা যদি আল্লাহর পছন্দ-অপছন্দের মাপকাঠিতে বিচার করে নিতাম, তাহলে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আমাদের সকল প্রচেষ্টা সমন্বিত হত। আমি একটি উদাহরণ দিচ্ছি। মনে করুন কেউ সৎ ও হালাল উপায়ে মাসে ১০ হাজার ডলার উপার্জন করতে পারে। এ ব্যাপারটিকে তিনি কি চোখে দেখবেন? তার জীবন ধারণের জন্য হয়ত এক হাজার ডলারই পর্যাপ্ত। তাহলে তিনি কি নিজেকে গুটিয়ে নেবেন? তার উপার্জন ক্ষমতাকে কমিয়ে নিয়ে এসে তিনি এক হাজার ডলারের পর্যায়ে নিয়ে আসবেন?? আমরা বলবো যে, তিনি রাসূলের(সা.) যুগের ধনাঢ্যদের দিকে তাকিয়ে দেখবেন, তারা উপার্জন করেছেন, কিন্তু বিলাসিতা করেননি। বাড়তি উপার্জনকে সম্প্রদায়ের কাজে নিয়োজিত করেছেন। পৃথিবী থেকে যাবার সময় খালি হাতে যেতে হবে, একথা সব সময় স্মরণ রেখেছেন এবং আল্লাহর দ্বীনের জন্য প্রয়োজনে সর্বস্ব ব্যয় করেছেন। তাহলে আজো আমাদের কেউ যদি স্ত্রী সন্তানের হক নষ্ট না করে, এবং আল্লাহর বিধানকে লংঘন না করে পর্যাপ্তের অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করতে পারেন, তবে তিনি তা করবেন, কিন্তু বিলাসিতায় ডুবে না গিয়ে, ব্যয়কে যথাযথ রেখে অতিরিক্তটুকু আল্লাহর সন্তুষ্টির কথা স্মরণে রেখে কমিউনিটির কল্যাণে নিয়োগ করবেন। তাহলেই তার দুনিয়ার কর্মকান্ড ও আখিরাতের সাফল্যের উদ্দেশ্যে প্রচেষ্টার ভিতার কোন বিরোধ থাকবে না। তার গোটা জীবনটাই তখন আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সমন্বিতভাবে নিয়োজিত হবে।
বর্তমান সময়ের মুসলিমদের জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখলে আমরা প্রায়ই দেখি, আপাত দৃষ্টিতে যথেষ্ট বিশ্বস্ততা ও সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কর্মক্ষেত্রের কার্যকলাপ বা পেশার সাথে দ্বীনের বিরোধিতা বা দ্বন্দ্ব অপরিহার্য হয়ে ওঠে, এবং তখনই সমস্যার মূলে না গিয়ে, stop-gap measure এর মত করে একটা ধামাচাপা সমাধানের চেষ্টা করা হয় – আর সমন্বয় সাধনের প্রশ্ন আসে সেটা থেকেই! প্রশ্ন উঠতে পারে বিশ্বস্ততা বা সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও, আমরা কেন আল্লাহর আদেশ/নিষেধ ও সন্তুষ্টি বরাবর নিজেদের aligned করতে পারবো না বা পারছি না। এর উপস্থিত কারণ হচ্ছে জীবনের করণীয় ব্যাপারগুলোর priority নির্ধারণ করতে না পারা – যার উৎস আবার দ্বীন সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান না থাকার মাঝে নিহিত। আমরা সাধারণত দ্বীন inherit করি, তারপর হঠাৎ একসময় সময়ের প্রয়োজনে বা বিবেকের তাড়নায় দ্বীনের পক্ষাবলম্বন করতে আমরা activist বনে যাই। দ্বীন শিক্ষার foundation না থাকায় আমরা priority ঠিক করতে না পেরে বিপ্তিভাবে ছোটাছুটি করি। ৫১:৫৬ আয়াতে আল্লাহ যা বলেছেন, সেটা সহ কুরআনের প্রতিটি কথা সত্য জ্ঞান করা আমাদের ঈমানের শর্ত। ঐ একটি আয়াত থেকেই বোঝা যায় যে, সর্বাবস্থায় আল্লাহর ইচ্ছা, সন্তুষ্টি আমাদের এক নম্বর priority-তে থাকার কথা। দ্বীন শিক্ষর অপর্যাপ্ততার জন্য আমরা হয়ত ঐ আয়াতের শব্দগত অর্থ বিশ্বাস করলেও তার ব্যাপ্তি সম্বন্ধে ভাবি না।
একটা উদাহরণ দিয়ে আমি আমার বক্তব্য শেষ করব। একজন অত্যন্ত মেধাবী IT প্রফেশনাল একটি কোম্পানীতে উঁচু বেতনে সততার সাথে চাকরী করেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়েন, যাকাত দেন, রোযা রাখেন। ইসলাম নিয়ে চিন্তা করেন, স্ত্রী-পুত্রকে সময় দেন, পরিবারকেও তার জ্ঞান মতে ইসলাম সম্মত উপায়ে পরিচালিত করার চেষ্টা করেন। আপাত দৃষ্টিতে এ পর্যন্ত সবই ঠিক আছে। এখন আমি বললাম যে, তিনি একটা সিগারেট কোম্পনীতে চাকুরী করেন। এখন কি আর সব ঠিক থাকল? থাকল না। কারণ ঐধরনের একটা ক্ষতিকর হারাম বস্তু প্রস্তুতকারী কারখানায় চাকুরী করা হারাম! জ্ঞানের অভাবে হোক আর বিলাসিতার মোহেই হোক, আমাদের উদাহরণের ব্যক্তিটি আল্লাহর সন্তুষ্টির সাথে তার জীবনকে align করতে পারেননি। আর এজন্যই পরস্পরবিরোধী বিষয়ের মাঝে তার জীবনে দ্বন্দ্ব থাকা অবশ্যম্ভাবী এবং সেক্ষেত্রে সমন্বয়ের প্রশ্ন আসতে বাধ্য। তিনি যদি সঠিক দ্বীনশিক্ষা লাভ করে থাকতেন, তবে তিনি জীবনের সঠিক priority ঠিক করতে পারতেন। এবং আল্লাহকে এক নম্বর priority-তে রেখে বাকী সবকিছুকে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী সাজাতে পারতেন। আমল যেমন জ্ঞানের ভিত্তিতে করতে হবে, ইসলামের উপর যে কোন কাজও তাই সঠিক জ্ঞানের ভিত্তিতেই হতে হবে। তবেই তা পরস্পর-বিরোধিতা, দ্বন্দ্ব মুক্ত হবে ইনশাল্লাহ্!
Good writing Sir