এক বৈঠকে তিন তালাক?
প্রশ্নঃ আমের আশ-শাবী (রহ.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ফাতেমাহ বিনতে কায়েস (রাঃ)-কে বললাম, আপনার তালাকের ঘটনাটি আমাকে বলুন। তিনি বলেন, আমার স্বামী ইয়ামনে থাকা অবস্থায় আমাকে তিন তালাক দেয়। রসূলুল্লাহ ﷺ এটাকে জায়েয গণ্য করেন। (ইবনু মাজাহ ২০২৪)
এ হাদিস থেকে এটা বুঝা যায় কিনা যে তিনতালাক এক বৈঠকে দেয়া জায়েয এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা অনুমোদন দিয়েছেন? হাদিসটির সঠিক ব্যাখ্যা কি?
উত্তর দিয়েছেন ডঃ মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ
উত্তরঃ আপনি বলতে চাচ্ছেন যে এ থেকে বুঝা যায় রাসূলুল্লাহ্ ﷺ একসাথে তিন তালাক অনুমোদন দিয়েছেন। এ হাদিসটি ইমাম ইবনে মাজাহ তার সুনানের মধ্যে বর্ণনা করেছেন, আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.) তার মুসনাদের মধ্যে বর্ণনা করেছেন, ইমাম দারাকুৎনী (রহ.) সুনানে বর্ণনা করেছেন, আরো অনেকেই বর্ণনা করেছেন।
প্রথমত, এখানে হাদিসের যেই বর্ণনাটি ইমাম ইবনে মাজাহ (রহ.) তার সুনানের মধ্যে বর্ণনা করেছেন তার সনদে বিতর্কিত ব্যক্তি রয়েছে। ফাতেমা বিনতে কায়েস রাদি’আল্লাহু ‘আনহার তালাকের বিষয়টি একটি বিতর্কিত বিষয়। এই হাদিসের রেওয়াতগুলো যদি আমরা একসাথ করি তাহলে আমরা দেখতে পারবো এর সনদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে অর্থাৎ এই হাদিসের সনদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আহলুল হাদিসদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। ফলে আ’য়িশা রাদি’আল্লাহু তা’আলা আনহা এই হাদিসকে গ্রহণ করেননি; তেমনিভাবে ‘উমর ইবনে খাত্তাব রাদি’আল্লাহু তা’আলা আনহুও এটিকে গ্রহণ করেননি যখন তিনি আ’য়িশা রাদি’আল্লাহু ‘আনহার থেকে এমনটি শুনেছেন। এ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, এ হাদিসের সনদের মধ্যেও মতভেদ রয়েছে এবং মতনের মধ্যেও মতভেদ রয়েছে।
আসলে হাদিসের সনদের মধ্যে মতবিরোধ হয়ে থাকলে এ হাদিসটি আমরা গ্রহণযোগ্য নয় বলতে পারি কারণ এর সনদের ব্যাপারে যথেষ্ট বক্তব্য রয়েছে। কিন্তু আমরা যদি মনে করি যে বিভিন্ন শাওয়াহেদের কারণে বা হাদিসের বিভিন্ন রেওয়ায়েতের কারণে হাদিসটি সনদের দিক থেকে গ্রহণযোগ্য তাহলে আমরা দেখবো হাদিসের মতনের মধ্যে কি আছে।
এই হাদিসের মতনের মধ্যে ইরতিরাব রয়েছে। ইবনে মাজাহ যেই রেওয়াতটুকু উল্লেখ করেছেন,
فطلقها ثلاثا
অর্থাৎ তিনি বলেছেন যে আমার স্বামী আমাকে তিনতালাক দিয়েছেন বা তিনবার তালাক দিয়েছেন। এ বক্তব্য থেকে আদৌ এ কথা বুঝা যায় না যে, আল্লাহর নবী ﷺ কে তিনি বলেছেন এক মজলিসের মধ্যে বা এক বৈঠকে তিনতালাক দিয়েছেন। এ ব্যাপারে একটি রেওয়াতও সাব্যস্ত হয়নি। কারণ, সালাসান শব্দটি এখানে তাতলীকাত মা’দুদ এর আদদ হিসেবে এসেছে। অর্থাৎ আমার স্বামী আমাকে তিনবার তালাক দিয়েছেন। যদি এমনটি বুঝানো হয়ে থাকে তাহলে তার স্বামী তাকে তালাক তিনবার দিয়ে দিয়েছেন এজন্য তিনি এ অভিযোগটুকু আল্লাহর রাসূল ﷺ এর কাছে করেছেন। বাকি অন্যান্য রেওয়াতের দিকে যদি আমরা দেখি তাহলে আমরা দেখতে পাবো যে বেশিরভাগ রেওয়াতের মধ্যে এসেছে, طلقني زوجي البتة অর্থাৎ, “তার স্বামী তাকে মূলত পরিপূর্ণ তালাক দিয়ে দিয়েছে।” অর্থাৎ আল বাত্তা দিয়ে যে তালাকের মাধ্যমে বাইন হয়ে যায় সে তালাকের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এখান থেকে বুঝা যায় যে তালাকটা তালাকে বাইন হয়ে গিয়েছে যেহেতু তিনি তাকে তৃতীয়বার তালাক দিয়েছেন। তাই এ হাদিস থেকে যদিও আহলুল হাদিসদের মধ্যে কেউ কেউ এটি বুঝেছেন যে, এখানে তিন তালাকের বিষয়টি ইঙ্গিত করা হয়েছে কিন্তু হাদিসের বক্তব্য থেকে এটা বুঝা যায় না। এরপর যদি আমরা ধরে নেই যে তার স্বামী আবু ‘আমর ইবনে হাফস একসাথে তিনতালাক দিয়েছেন তাহলে আল্লাহর রাসূল ﷺ এর ক্ষেত্রে এই বিধানটি ছিল কাযা। আল্লাহর রাসূল ﷺ এর কাছে তিনি মূলত মুরাফা’আ করেছেন অর্থাৎ রাসূল ﷺ এর কাছে কোর্টে এসে তিনি বিবাদী হিসেবে অভিযোগ দায়ের করেছেন। তাই রাসূলুল্লাহ্ এখানে কাযা করেছেন আর এর দলিল হচ্ছে তিনি বলেছেন যে, আমি এমন একটা আশংকার মধ্যে আছি যে, যাদের কাছে আমি আছি তারা আমার উপর আক্রমণ করতে পারে বা আমার ক্ষতিসাধন করতে পারে। যেহেতু হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনার মধ্যে স্পষ্টভাবে এসেছে যে তিনি তার স্বামীর পরিবারের সাথে অর্থাৎ তার দেবর,শাশুড়িসহ যারা আছেন তাদের সাথে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্যে লিপ্ত হয়ে তাদের সাথে তার বিবাদ তৈরি হয়েছিল। বিবাদ তৈরি হওয়ার পরই মূলত তিনি রাসূলুল্লাহ্ ﷺ এর কাছে অভিযোগ করেছিলেন। ফলে রাসূলুল্লাহ্ ﷺ স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী তাকে তার স্বামীর ঘরে ইদ্দত পালন করতে অনুমতি দেননি। বরং তাকে বলেছেন, তুমি তোমার চাচা ইবনে উম্মে মাকতুমের ঘরে ইদ্দত পালন কর। এ হাদিস থেকে বুঝা যায় যে রাসূলুল্লাহ্ ﷺ তাকে তার স্বামীর ঘরে ইদ্দত পালন করতে দেননি এবং এই বিধানটি নবী ﷺ ফাতেমা বিনতে কায়েস রাদি’আল্লাহু ‘আনহার জন্য বিশেষভাবে দিয়েছেন। আল্লাহর রাসূল ﷺ ফাতেমা বিনতে কায়েস রাদি’আল্লাহু ‘আনহাকে আরো বলেছিলেন যে, তোমার জন্য তোমার স্বামীর পক্ষ থেকে কোনোরকম ভরণপোষণ থাকবে না। যেখানে আমরা কুরআনের আয়াত থেকে জানতে পারি যে স্বামীর উপর ইদ্দতের সময়ও ভরণপোষণ ওয়াজিব। কিন্তু আল্লাহ্ রাসূল ﷺ এর কাযা এর কারণে তিনি এ বিধান দিয়েছেন।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বুঝা যায় যদি এই ঘটনায় এক মজলিসের মধ্যে তিনতালাক হয়ে থাকে তাহলে এটি আল্লাহর রাসূল ﷺ এর কাছ থেকে কাযা যা বিচারিক বিষয় বা জুডিশিয়াল রায়। ফলে রাসূলুল্লাহ্ ﷺ এখানে বিচ্ছিনতার বিষয়টি ঘোষণা করেছেন। কিন্তু একসাথে তিনতালাকের বিষয়টি আমরা যদি সহিহ বুখারির হাদিস থেকে দেখি তাহলে দেখতে পাবো আল্লাহর রাসূল ﷺ এর সময়ে যদি কেউ একসাথে তিনতালাক দিতেন তাহলে স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী তিনি সেটিকে এক তালাক হিসেবে বিবেচনা করতেন। এখান থেকে আমরা আরো বুঝতে পারি যে, দুইটি হাদিসের মধ্যে তা’আরুয বা সংঘর্ষ নেই বা কোনধরনের কনফ্লিকশন বা জটিলতা নেই। কেননা, ফাতিমা বিনতে কায়েসের হাদিসটিতে একসাথে ততিন তিনতালাকের উল্লেখ নেই এবং ফাতেমা বিনতে কায়েসের ঘটনাটি রাসূল সালাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিশেষ কাযা ছিল যা হাদিসের সকল রেওয়াত থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের সবাইকে বিষয়টি অনুধাবন করার তৌফিক দান করুন। আমীন।