০৫ ই জুলাই, ২০১১ রাত ১১:১৭

[এর আগের পর্বটি রয়েছে এখানে:
Click This Link or https://loner356.wordpress.com/2018/04/16/কোয়ান্টাম-মেথড-১/ ]

৫. ইসলামের কিছু মৌলিক বিষয়ের পর্যালোচনা:

ইসলামের দৃষ্টিতে কোয়ান্টাম মেথডের অবস্থান বিবেচনা করার আগে আমরা ইসলামের কিছু মূলনীতি বা পরিভাষা সম্পর্কে আলোচনা করে নেব – যে বিষয়গুলোর ব্যাপারে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন ধারণা নিয়ে আমাদের বক্তব্য বোঝা কঠিন হয়ে যাবে।(আমাদের দেশের খুব কম মানুষেরই এই বিষয়গুলো নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা আছে)

৫.১.বিদ’আত:

৫.১.১. বিদ’আত কি?

আল্লামা ইব্রাহীম ইবনু মুসা আশ-শাতিবী বলেন:

‘বিদআত বলতে বুঝায় দ্বীনের মধ্যে শরীয়াতের পদ্ধতির তূল্য কোন নব-আবিষ্কৃত উদ্ভাবিত তরীকা বা পদ্ধতি, মহান আল্লাহর অতিরিক্ত ইবাদাতের আশায় যে পদ্ধতির অনুসরণ করা হয়।’ [18]

তাহলে আমরা বুঝলাম যে, বিদ’আত মূলত বর্জনের সুন্নাতের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং ইবাদাতের উদ্দীপনাতেই এর সৃষ্টি। এ ব্যাপারে ইসলামের মূলনীতিটি হচ্ছে-
ইবাদাতের ক্ষেত্রে সব কিছু হারাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা অনুমোদন দিয়েছেন তা ব্যতীত।
• দুনিয়াবী ব্যাপারে অন্য সব কিছু হালাল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা নিষিদ্ধ করেছেন তা ব্যতীত।

অজ্ঞতার বশে অনেকে প্রশ্ন করে থাকেন আল্লাহর রাসূল প্লেনে চড়েননি, তাহলে কি প্লেনে চড়া বিদআত? আমাদের দেখতে হবে আল্লাহর রাসূলের এই বর্জন কি ইচ্ছাকৃত নাকি অনিইচ্ছাকৃত? বিদ’আত সবসময় ইচ্ছাকৃত বর্জন এবং অবশ্যই ইবাদাতের সাথে সংশ্লিষ্ট।

৫.১.২. বিদ’আত চেনার উপায়:

উপরোক্ত মূলনীতির আলোকে আমরা বলতে পারি, কোন কিছুকে বিদ’আত হিসেবে চিহ্নিত করার পূর্বে নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করতে হবে-
• প্রথমেই দেখতে হবে তা ইবাদাতের সাথে সংশ্লিষ্ট কিনা। হতে পারে তা কোন কথা, কাজ বা বিশ্বাস।
• ইবাদাতের সাথে সংশ্লিষ্ট হলে দেখতে হবে আল্লাহর রাসূল ও তাঁর সাহাবীরা এই পদ্ধতি সম্পর্কে জানতেন কিনা।
• যদি না জেনে থাকেন, তবে তাঁর উৎস ওহী নয়। আর ইসলামে সকল ইবাদাতের উৎস একমাত্র ওহী।
• যদি জেনে থাকেন, তবে তাঁরা তার উপর আমল করেছিলেন কিনা। যদি না করে থাকেন, তবে সেটাই উচিত সিদ্ধান্ত, কারণ তাঁরাই শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম এবং আমাদের অনুসরণীয় আদর্শ।

৫.১.৩. বিদ’আত বর্জনের ব্যাপারে আমরা এত সংবেদনশীল কেন?

ইসলাম আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য একমাত্র জীবনব্যবস্থা:
আল্লাহ বলেন:

And whoever desires other than Islam as religion – never will it be accepted from him, and he, in the Hereafter, will be among the losers. (Qur’an, 3:85)

এই চিন্তাটা ‘আমাদের বিবেক বুদ্ধি’ দ্বারা খুব সাম্প্রদায়িক এবং অসহিষ্ণু মনে হলেও করার কিছু নেই। কারণ ইসলামের এই ‘Salvific Exclusivity’( পারলৌকিক মুক্তি শুধই ইসলামের প্রকৃত অনুসারীদের জন্য) তে বিশ্বাস করা আমাদের ঈমানের একটি অংশ। “আসলে সকল ধর্মের মর্মকথা একই – পার্থক্য শুধু অভিব্যক্তিতে বা বাহ্যিক প্রকাশে বা rituals-এ” – এই কথা যদি সত্যি হত, তবে মুহাম্মদ (সা.)-এঁর মিশনের কোন প্রয়োজনই ছিল না । মক্কার পৌত্তলিকরা সবাই আল্লাহ মানতো – আবু জাহেল, আবু লাহাব সবাই আল্লাহয় বিশ্বাস করতো – কথায় কথায় আল্লাহকে নিয়ে শপথ করতো ৷ কিন্তু তবু আমরা তাদের কাফির ও মুশরিক বলে থাকি এবং কাফির ও মুশরিকের সাথে কিছুতেই মুসলিমদের প্রেম-প্রীতি, সহ-অবস্থান, সামাজিকতা বা নির্বিচার মেলামেশা যে সম্ভব নয়, সে কথা পবিত্র কুর’আনের বহু আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত রয়েছে। রাসূল (সা.)- এঁর বহু হাদীসেও মুসলিমদের সাবধান করে দেওয়া হয়েছে। আর সেজন্যই, উদাহরণস্বরূপ, জন্মদিন বা Valentine Day উদযাপন কখনই মুসলিম সংস্কৃতির অংশ হতে পারেনা।

এজন্য কোন কিছুকে ইবাদাত হিসেবে গ্রহণ করার আগে একজন মুসলিম সম্ভাব্য সকল উপায়ে তা যাচাই বাছাই করে নেন; পরকালের ব্যাপারে “হলেও হতে পারে” জাতীয় অনিশ্চয়তাসূচক কোন মানসিকতা তার মাঝে থাকেনা। আর কোন মতবাদ যদি তাকে এই দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করতে বলে যে, সকল ধর্মই এক বা কোন কাজ করতে বলে যা অন্য কোন ধর্মের ইবাদাতের অংশ হিসেবে প্রমাণিত বা কোন কাজ যে অনুমোদিত তা বোঝানোর জন্য অন্য কোন ধর্মগ্রন্থ থেকে reference দেয়া হয় বা অন্য কোন ধর্মের প্রবাদপুরুষ কাউকে example হিসেবে দেখানো হয়, তবে তা নি:সন্দেহে আপনাকে পথভ্রষ্টতার দিকে ডাকছে।

বিদআত কুফরের দরজা খুলে দেয়:

ইসলাম একটি পূর্ণাংগ এবং ত্রুটিমুক্ত জীবনব্যবস্থা( complete and perfect)এতে সংযোজন বা বিয়োজনের কোন অবকাশ নেই। রাসূল (সা.) বলেন:
সত্যতম বাণী আল্লাহর কিতাব, সর্বোত্তম আদর্শ মুহাম্মাদের আদর্শ, সবচেয়ে খারাপ বিষয় হল নতুন উদ্ভাবিত বিষয়। প্রতিটি নতুন উদ্ভাবিত বিষয়ই বিদআত, আর প্রতিটি বিদআতই পথভ্রষ্টতা। [19]

তাই কেউ যদি দাবি করেন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য এমন কোন কাজ বা পন্থা রয়েছে যা তার মস্তিষ্কপ্রসূত, তবে তিনি প্রকারান্তরে দাবী করছেন-

# ওহী অসম্পূর্ণ, রাসূল (সা.)আমাদেরকে যা জানিয়েছেন, তার চেয়ে উত্তম কিছু তিনি আবিষ্কার করেছেন।
অথবা

# রাসূল (সা.)তার দায়িত্ব ঠিকমত পালন করেননি।

আমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি যে, উপরোক্ত দুটি চিন্তার উভয়টি বা যে কোন একটি আমাদেরকে ইসলামের বাইরে নিয়ে যায়। রাসূল (সা.) বলেন:

যা কিছু কাউকে জান্নাতের নিকটবর্তী করে অথবা আগুন থেকে দূরবর্তী করে তার এমন কিছুই নেই যা কিনা তোমাদের জন্য স্পষ্ট করে বর্ণনা করা হয়নি। [20]

• বিদআত শিরকের দরজা খুলে দেয়:

মূর্তিপূজা যে শিরকের সবচেয়ে প্রকাশ্য এবং জঘন্য রূপ এ ব্যাপারটি সর্বজনস্বীকৃত।আল্লাহ পাক আল কুর’আনে নূহের জাতির বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন সূরা নূহের ২৩ নম্বর আয়াতে। তাতে নূহের (আ)জাতির যে উপাস্যগুলোর নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তারা তাদের পূর্ববর্তী যুগের সৎকর্মশীলদের নাম। কিন্তু তাদের পূজা কিভাবে শুরু হল সেটা আমরা জানতে পারি নিচের হাদীস থেকে। একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করি-

হযরত মুহাম্মাদ ইবনে কায়েস (রহ.) বলেন যে, ঐ লোকগুলো ছিলেন আল্লাহর ইবাদাতকারী, দ্বীনদার,আল্লাহ ওয়ালা ও সৎ। তাঁরা হযরত আদম (আঃ) ও নূহ (আ) এর ছিলেন সত্য অনুসারী,যাদের অনুসরণ অন্য লোকেরাও করতো।যখন তারা মারা গেলেন। তখন তাদের অনুসারীরা পরস্পর বলাবলি করলোঃ ‘যদি আমরা এদের প্রতিমূর্তি তৈরী করে নেই, তবে ইবাদাতে আমাদের ভালভাবে মন বসবে এবং এদের প্রতিমূর্তি দেখে আমাদের ইবাদাতে আগ্রহ বাড়বে।’ সুতরাং তারা তাই করল। অতঃপর যখন এই লোকগুলোও মারা গেল এবং তাদের বংশধরদের আগমণ ঘটল, তখন শয়তান তাদের কাছে এসে বললোঃ’তোমাদের পূর্বপুরুষরাতো ঐ বু্যুর্গ ব্যক্তিদের পূজা করত এবং তাদের কাছে বৃষ্টি ইত্যাদির জন্য প্রার্থনা করত। সুতরাং তোমরাও তাই করো।’ তারা তখন নিয়মিতভাবে ঐ মহান ব্যক্তিদের পূজা শুরু করে দিল। [21]

উপরোক্ত ঘটনা থেকে নিচের বিষয় গুলো লক্ষণীয়-

# প্রথমে নূহের জাতির জন্য স্মারক বানানোর পুরো ব্যাপারটির উদ্দেশ্যই ছিল সৎ-আল্লাহর ইবাদাতে মনোযোগ বৃদ্ধি। কিন্তু এই পদ্ধতিটি ঐশী বাণী দ্বারা সমর্থিত ছিলনা।ইসলামী পরিভাষায় একে আমরা স্বচ্ছন্দে বিদ’আত হিসেবে অভিহিত করতে পারি।
# (সাধারণ) বিদ’আত রাতারাতি শিরকে পরিণত হয়না।কয়েক প্রজন্ম সময় লাগে।
# শয়তান আপাতদৃষ্টিতে ভাল পরামর্শ ই দিয়ে থাকে। ঐশী জ্ঞানের সাহায্য ছাড়া তার কুটকৌশল বোঝা কঠিন।

৫.১.৪. বিদআতপন্থী দলের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য:

Out of the Context কুরআনের আয়াত ব্যবহার:
কুরআন কোন কালেই অর্থহীণ শব্দসমষ্টি বা ধাঁধাঁ ছিলনা যে তাকে ইচ্ছামত ব্যাখ্যা করা যাবে। এর একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য এই যে একে পূর্ণাংগ একটি বই (সুন্নাতকে মানদণ্ড ধরে, যার একটি অংশ অপর অংশকে ব্যাখ্যা করে) হিসেবে বিবেচনা না করে যদি বিচ্ছিন্নভাবে নেয়া হয়, তবে সকল বিভ্রান্ত আক্বীদার মানুষই এখান থেকে দলিল দেখাতে পারবে। তাই তাফসীরের কিছু অবশ্য অনুসরণীয় মূলনীতি রয়েছে যার আলোকে কুর’আনকে ব্যাখ্যা করতে হয়। বিদ’আতপন্থী দলগুলোর একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য এই যে, তারা সবসময় কুর’আনের একটি আয়াত বা তার অংশবিশেষকে বিচ্ছিন্নভাবে (তাফসীরের মূলনীতি গুলো না মেনেই) মনগড়াভাবে উপস্থাপন করে, যাতে তা তাদের পক্ষে দলিল হিসেবে কাজ করে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা ইসলামের মূল বাণীর সাথে রীতিমত সাংঘর্ষিক।

জাল হাদীসের ব্যবহার:
রাসূল (সা) এর সুন্নাত ওহীর একটি রূপ। তাই একে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহর ইচ্ছায় মুসলিমগণ এমন সূক্ষ্ম, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অবলম্বন করেছেন যা অতুলনীয়। যুগে যুগে এই পদ্ধতি অবলম্বন করে, যে কোন যুগেই একজন মানুষ জাল ও সহীহ হাদীসের মাঝে পার্থক্য করতে পারবে। কিন্তু বিদ’আতপন্থী দলগুলোর এটা স্বভাবজাত যে, তারা সবসময় সহীহ হাদীসগুলোকে পাশ কাটিয়ে জাল হাদীসকে তাদের দলীল হিসেবে ব্যবহার করে।

৫.২. আল্লাহর অবস্থান নিয়ে ইসলামের বক্তব্য:

লোকমুখে চালু আছে যে, আল্লাহ পাক সর্বত্র বিরাজমান। তাঁর জ্ঞান ও ক্ষমতা সর্বত্র পরিব্যাপ্ত – এটা সঠিক। তবে এর অর্থ এই নয় যে তাঁর সত্তা তাঁর সৃষ্টির সাথে মিশে আছে। বরং সত্তাগত ভাবে তিনি সৃষ্টি থেকে পৃথক এবং তিনি সাত আসমানের ওপরে আছেন এবং তিনি সৃষ্টির উর্দ্ধে অবস্থানকারী। অতএব তিনি তাঁর সত্তার দ্বারা সর্বত্র বিরাজমান নন, আর মানুষের যুক্তিও তাঁর সর্বত্র বিরাজমান হওয়াকে প্রত্যাখ্যান করে, কেননা যদি তিনি সর্বত্র থাকেন, তবে অর্থ এই দাঁড়ায় যে যাবতীয় আবর্জনাতেও তাঁকে পাওয়া যাবে, কিন্তু এটা তাঁর পবিত্রতার ধারণার বিরোধী, উপরন্তু আল্লাহ পাক তাঁর কিতাবে কিংবা তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর হাদীসে কোথাও উল্লেখ করেননি যে তিনি সর্বত্র বিরাজমান। বরং তাঁর অবস্থান সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তিনি আসমানে, অর্থাৎ সাত আসমানের উর্দ্ধে অবস্থিত, আর এটাই সঠিক বিশ্বাস। এর সপক্ষে কুরআন ও হাদীসে বহু দলীল রয়েছে, আমরা এখানে দুএকটি উল্লেখ করব।

আল্লাহ পাক বলেন:
তোমরা কি নিরাপদ বোধ করছ যে যিনি আসমানে আছেন, তিনি তোমাদের সহ ভূমিকে ধসিয়ে দেবেন ফলে আকস্মিকভাবে তা প্রকম্পিত হতে থাকবে? [22]

হাদীসে বর্ণিত যে আল্লাহর রাসূল এক দাসীকে প্রশ্ন করলেন যে “আল্লাহ কোথায়?” সে জবাব দিল “আসমানে।” এরপর তিনি প্রশ্ন করলেন “আমি কে?” দাসীটি বলল: “আপনি আল্লাহর রাসূল।” ফলে নবী(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দাসীটিকে মুমিন হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন।[23]

৫.৩.ইসলামে সূফীবাদের অবস্থান:

পার্থিব লোভ লালসা ও ভোগ বিলাস যথাসম্ভব পরিত্যাগ করা ইসলাম ধর্মের একটি মৌলিক শিক্ষানীতি হলেও সন্ন্যাসবাদের কোন স্থান এখানে নেই। আজকের খ্রিষ্টধর্মে এর বহুল প্রচার থাকলেও এটা আসলে কোন ঐশী নির্দেশ নয়। ধার্মিক খ্রিষ্টানগণ যখন অনুভব করলেন বিবাহ ও ঘরসংসার করে যথেষ্ট আখিরাতমুখিতা অর্জন করা যায়না, তখন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য মানবীয় বুদ্ধি বিবেক খাটিয়ে এক নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন যার সাফল্য সহজেই অনুমেয় যখন আমরা পাদ্রীদের দ্বারা শিশুদের যৌন হয়রানির খবর দেখি। ইসলামের মাঝেও একদল মানুষ অনুরূপ নতুন পদ্ধতির সূচনা করেন যাদের আক্বীদা, কাযযকলাপ কোন কিছুই শরীয়াহ সম্মত নয়। যেমনঃ সুফীবাদের অনুসারী ও অন্যান্য কতিপয় পথভ্রষ্ট দল সৃষ্টির সাপেক্ষে আল্লাহ পাকের সত্তা ও তাঁর অবস্থান সম্পর্কে কিছু ভ্রান্ত ও কদর্য ধারণা পোষণ করে থাকে আর এ সম্পর্কে তাদের কিছু বাতিল পরিভাষা আছে।

হুলুল:
সুফী ও অন্যান্য পথভ্রষ্ট দলের পরিভাষায় হুলুল সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টার অবস্থান – গোটা সৃষ্টিজগতে কিংবা এর কোন অংশে।গোটা সৃষ্টিজগতে স্রষ্টার অবস্থানের মতবাদ এই যে স্রষ্টা সৃষ্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া সত্ত্বেও সর্বত্র বিরাজমান।
ইত্তিহাদ:
দুটো বস্তু এক হওয়াকে আরবীতে ইত্তিহাদ বলা হয়। পথভ্রষ্টদের পরিভাষায় ইত্তিহাদ হল এই ধারণা যে স্রষ্টা ও সৃষ্টি অথবা এর কোন অংশ প্রকৃতপক্ষে একই সত্তা।স্রষ্টা ও গোটা সৃষ্টি একই সত্তা হওয়ার মতবাদকে ‘ওয়াহদাতুল উজুদ'(وَحْدَة الوُجُود) বলা হয়। যারা স্রষ্টা ও সৃষ্টির কোন অংশ একই সত্তা হওয়ায় বিশ্বাসী তারা ধারণা করে যে নবী, সৎকর্মশীল, দার্শনিক প্রকৃতির লোকেরা স্রষ্টারই অংশ! এরা নোংরা বস্তুকে স্রষ্টার অংশ হওয়া থেকে বাদ দেয়। ইবনুল ফারিদ, ইবনু আরাবী প্রমুখ এই মতবাদের অনুসারী ছিল।

হুলুল ও ইত্তিহাদের ধারণা সুস্পষ্ট কুফর ও ধর্মদ্রোহিতা আর এর মধ্যে কদর্যতার দিক থেকে ইত্তিহাদ হুলুলের চেয়েও মারাত্মক, কেননা তা সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে এক সত্তায় পরিণত করেছে।

৫.৪.ইসলামে জোতিষশাস্ত্রের অবস্থান:

আল-কুরআন এবং হাদীসে দিনের আলোর মত স্পষ্ট বক্তব্যের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে গায়েবের জ্ঞান বা অদৃশ্যের জ্ঞান আল্লাহ পাকের একচ্ছত্র বৈশিষ্ট্য, এতে কারও কোন অংশীদারিত্ব নেই। গায়েবের জ্ঞানের মধ্যে রয়েছে এমন সবকিছু যা মানুষের ইন্দ্রিয়সমূহের দ্বারা জানা যায় না। সেটা হতে পারে অতীতের ঘটনা, কিংবা ভবিষ্যতের ঘটনা কিংবা দূরত্বের কারণে মানুষের জ্ঞান থেকে অন্তরালে থাকা কিছু যেমন জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি। এর মধ্যে কিছু বিষয়ের জ্ঞান আল্লাহ পাক চাইলে তাঁর সৃষ্টির কোন অংশকে জানাতে পারেন, যেমন তিনি নবীর(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মারফত আমাদেরকে জান্নাত জাহান্নামের বিবরণ জানিয়েছেন। তেমনি আল্লাহ পাক পৃথিবীতে মানুষের রিযিকের বিলিবন্টন সংক্রান্ত তথ্য ফেরেশতাগণের নিকট প্রকাশ করলে তাঁরা তা জানতে পারেন। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে নবী-রাসূল কিংবা ফেরেশতারা গায়েব জানেন, বরং গায়েবের জ্ঞানের একাংশ আল্লাহ পাক তাদেরকে জানালে তবেই কেবল তারা তা জানতে পারে। আর তাই এটি ইসলামী আকীদার একটি অন্যতম মূলনীতি যে গায়েবের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ পাকের বৈশিষ্ট্য, এই বৈশিষ্ট্য কারও প্রতি আরোপ করলে তাকে আল্লাহর সমকক্ষ করা হয়।
জ্যোতিষশাস্ত্র, রাশিচক্র এবং অনুরূপ ভ্রান্ত বিদ্যাগুলোর মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থা ও অবস্থান দেখে কোন ঘটনা, ভাগ্য বা ভবিষ্যত নির্ণয় করা। এই বিদ্যাচর্চার দুটি তাওহীদ বিরোধী দিক রয়েছে:

প্রথমত, এই ধারণা করা যে গ্রহ-নক্ষত্র মহাবিশ্বের ঘটনাবলীকে সৃষ্টি, নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে, এই ধারণা মূলত রুবুবিয়্যাতের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে শিরক করার সমতুল্য।

দ্বিতীয়ত, গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান থেকে মানুষের ভাগ্য ও ভবিষ্যত নির্ণয়ের চেষ্টা, যা কিনা আল্লাহ পাকের অদৃশ্যের জ্ঞানের একচ্ছত্র বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে অপরকে শরীক করার শামিল।

৫.৫. জ্বীন জগত:

সাধু সন্ন্যাসী, ভাগ্যগণক, যাদুটোনা চর্চাকারীদের দ্বারা সংঘটিত নানা অলোকিক ঘটনা দেখে বহু মানুষ তাদেরকে আল্লাহর প্রিয় পাত্র ভাবা শুরু করে এবং তাদের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধার আতিশয্যে তারা যা বলে তাই করতে থাকে। পুরো ব্যাপারটিই ঘটে জ্বীনজগত সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতার কারণে। মানুষের মাঝে একদল লোক যাদুটোনা, ভাগ্যগণনা জাতীয় বাতিল ও নিষিদ্ধ বিষয় চর্চার জন্য জ্বীনদের সাহায্য নেয়, তারা শয়তান জ্বীনদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য নানাপ্রকার শিরকী ও কুফরী কাজ করে, জ্বীনদের ইবাদত করে, ফলে শয়তান জ্বীনেরা তাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে তাদেরকে এই সমস্ত নিষিদ্ধ বিষয় চর্চায় সাহায্য করে। [24]

ফুটনোটসমূহ:

[18]শাতিবী, আল-ই’তিসাম ১/৫০
[19]মুসলিম ২/৫৯৩
[20]তাবারানীর আল মুজাম আল কাবীর।আলবানীর (র) এর মতে সহীহ
[21]বুখারী (৪৯২০) তাফসীর ইবনে কাসীর (১৮/১৪২-১৪৪)
[22]সুরা মূলকঃ ১৬
[23]মুসলিম (৫৩৭)
[24]আর যেদিন আল্লাহ তাদের সবাইকে সমবেত করবেন। সেদিন বলবেন, “হে জিনের দল, মানুষের অনেককে তোমরা বিভ্রান্ত করেছিলে” এবং মানুষদের মধ্য থেকে তাদের সঙ্গীরা বলবে, “হে আমাদের রব, আমরা একে অপরের দ্বারা লাভবান হয়েছি এবং আমরা পৌঁছে গিয়েছি সেই সময়ে, যা আপনি আমাদের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন।” তিনি বলবেন, “আগুন তোমাদের ঠিকানা, তোমরা সেখানে স্থায়ী হবে। তবে আল্লাহ যা চান তা ব্যতীত।” নিশ্চয় তোমার রব বিজ্ঞ, সর্বজ্ঞ। (সূরা আল আনআম, ৬ : ১২৮)

(চলবে ..ইনশা’আল্লাহ্)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *