কোন কোন মাস’আলার ক্ষেত্রে ইখতিলাফ বৈধ এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অবৈধ?
প্রশ্নঃ কোন কোন মাস’আলার ক্ষেত্রে ইখতিলাফ বৈধ এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অবৈধ উদাহরণসহ জানতে চাই? এক্ষেত্রে মৌলিক মূলনীতি কি?
সম্পূরক প্রশ্নঃ আজকাল দেখা যায় ‘আলেমদের থেকে তাদের অনুসারীরাই বেশী ইখতিলাফ করে থাকেন এবং এসব ইখতিলাফকে কেন্দ্র করে মুসলিম ভাইদের মধ্যে বিরোধ, হিংসা এবং দলাদলি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এ বিষয়ে আপনার কাছ থেকে কিছু নসীহা আশা করছি।
উত্তর দিয়েছেন ডঃ মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ
উত্তরঃ ইসলামী শরিয়তের মধ্যে ইখতিলাফের এক প্রকার অনুমোদন রয়েছে। কিন্তু ইখতিলাফের এই অনুমতিটুকু মূলত এই উদ্দেশ্যে নয় যে এই ইখতিলাফের মাধ্যমে অথবা মতপার্থক্যের মাধ্যমে আমরা মতবিরোধ এবং বিচ্ছিনতার দিকে ধাবিত হবো অর্থাৎ ইফতিরাকের দিকে ধাবিত হবো। ইফতিরাক বলা হয়ে থাকে বিচ্ছিনতা বা পরষ্পরের মধ্যে বিরোধ হওয়াকে। মূলত, পরষ্পরের শত্রুতা, দুশমনি, বিরোধ করার জন্য এই ইখতিলাফ নয় বরং এটি নুসুস বা দলিলের কারণে, ফাহাম বা বুঝের তারতম্যের কারণে হতে পারে। এই ইখতিলাফটুকু একটি সুনির্দিষ্ট পরিসরে এজন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছে কারণ মানুষ দূর্বল, মানুষের বুঝ/উপলব্ধি/জ্ঞান সমান নয়। তাই সেক্ষেত্রে যদি কোনো কারণে কোনো মতপার্থক্য তৈরি হয় অথবা মতবৈচিত্র তৈরি হয় সে মতপার্থক্যটুকু ইসলামী শরিয়তের মধ্যে অনুমোদিত। তবে যেসমস্ত মাস’আলার ক্ষেত্রে ইসলামী শরিয়তের মধ্যে মতবিরোধ করার অথবা ইজতিহাদ করার বৈধতা রয়েছে সেসব ক্ষেত্রে ইখতিলাফ হতে হবে। যেসব মাসায়েল বা বিষয় কোনোভাবেই ইখতিলাফ বা ইজজতিহাদ বৈধ নয় নিম্নে সেগুলো তুলে ধরা হলোঃ-
১. যেখানে সুস্পষ্ট নস বা দলীল বা নস’য়ে কাত’ঈ রয়েছে। অর্থাৎ যেসমস্ত বিষয়ের ক্ষেত্রে অকাট্য দলীল রয়েছে এবং দলীলটি গ্রহণযোগ্য।
২. যেগুলো উসুলূস সুন্নাহ্ বা উসুলূদ দ্বীনের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়। অর্থাৎ যেসমস্ত বিষয় সুন্নাহের সাথে জড়িত বা সুন্নাহের মূলনীতির সাথে জড়িত সেগুলোর ক্ষেত্রে যে মাসায়েলগুলো রয়েছে সেগুলোর মধ্যে মতবিরোধ কোনোভাবেই বৈধ নয়।
৩. মতভেদ যদি এমন দিকে মানুষদেরকে ধাবিত করে যেটি সরাসরি নস কাত’ঈ বা অকাট্য দলীলের বিপরীত তাহলে এই ইখতিলাফ বৈধ নয়।
৪. পূর্ববর্তী ‘আলেমদের ইজমার সরাসরি বিপরীতে যদি কেউ মতভেদ করে থাকেন তাহলে তার এই ইখতিলাফটুকু কোনোভাবেই বৈধ নয় বরং সেখানে তার ইখতিলাফ বাতিল সাব্যস্ত হবে অর্থাৎ এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না।
সুতরাং উপরিউক্ত বক্তব্যগুলো থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি যে, মতবিরোধ একটি সুনির্দিষ্ট পরিসরে জায়েয হতে পারে কিন্তু মৌলিক যে বিষয়গুলো রয়েছে সেগুলোর মধ্যে মতবিরোধ কোনোভাবেই বৈধ নয়। যেসমস্ত ক্ষেত্রে মতবিরোধের সুযোগ ইসলামী শরিয়তের মধ্যে রয়েছেঃ
১. যেসমস্ত মাস’আলার ক্ষেত্রে দলিল রয়েছে কিন্তু সেটি নস যন্নী অর্থাৎ দলিলটি অকাট্য দলিল নয় বরং ধারণামূলক বা সংশয়মূলক অথবা উল্লেখিত দলীলের মধ্যে বিষয়টির সরাসরি বা পরিপূর্ণ নির্দেশনা নেই।
২. যদি এমন দলীল হয়ে থাকে যে দলীলের সিহহাত/বিশুদ্ধতা নিয়ে ‘আলেমদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে। অর্থাৎ কোনো ‘আলেম কোনো একটি মাস’আলার ক্ষেত্রে বলেছেন যে এই দলিলটি গ্রহণযোগ্য আবার কোনো ‘আলেম বলেছেন এটি গ্রহণযোগ্য নয়।
৩. মোটেই যেই মাস’আলার ক্ষেত্রে কোনোধরণের নস নেই অথবা সুস্পষ্ট দলিল নেই।
৪. ইসলামী শরিয়তের এমন কিছু বিষয় আছে যে বিষয় মূলত মাসলাহাতের উপর নির্ভর করে থাকে। অর্থাৎ মাসলাহাতে মূরসালাহ বা কমন যে মাসলাহাত/কল্যাণ রয়েছে এমন বিষয়ে ইখতিলাফ করার সুযোগ রয়েছে।
তবে ইখতিলাফের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি বর্জনীয় সেটি হচ্ছে ইখতিলাফ করার কারণে একে অপরের ইখতিলাফকে কোনোভাবেই নিন্দা করা জায়েয নেই। অথবা একটি ইজতিহাদের কারণে কোনোভাবে আরেকটি ইজতিহাদকে ত্রুটিপূর্ণ মনে করা অথবা বাতিল মনে করা এটি ইসলামী শরিয়তে বৈধ নয়। তাই যেসমস্ত ক্ষেত্রে মূলত ইজতিহাদের বা ইখতিলাফের অবকাশ রয়েছে সেসমস্ত ক্ষেত্রে একজন ‘আলেমকে অবশ্যই এটি জানতে হবে যে আমার এই ইজতিহাদটুকু কোনোভাবেই আরেকজনের ইজতিহাদকে বাতিল করবে না বা অপরজনের ইজতিহাদকে বিনষ্ট করবে না বা ভেঙ্গে দিবে না বরং তিনি অপর মুজতাহিদকে তার ইজতিহাদের কারণে সম্মান প্রদর্শন করবেন।
এরপর যে বিষয়টি আপপনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তা হচ্ছে, ভক্তদের মাঝে চলা ইখতিলাফ প্রসঙ্গে। ভক্তদের মাঝে যেই ইখতিলাফ চলছে, এটি আসলে ইখতিলাফ নয় এটি মূলত মতবিরোধ, বিচ্ছিনতা এবং গোঁড়ামি। এই ধরনের গোঁড়ামি ইসলামী শরিয়তের মধ্যে হারাম। অনেক সময় আমরা দেখতে পাই যে বিভিন্ন ‘আলেমের ভক্তরা পরষ্পরের মধ্যে গোঁড়ামি করে মতভেদ করে যাচ্ছেন যেখানে কোনো ধরনের দলীল নেই বা দলীলের ভিত্তি নেই শুধুমাত্র অমুক ‘আলেম বলেছেন বা অমুক শাইখ বলেছেন তার উপর নির্ভর করে একটি মতভেদ তৈরি করা হচ্ছে এবং সেটা নিয়ে অনেক বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে। এ ধরনের বাড়াবাড়ি ও সংকীর্ণতার কোনো সুযোগ ইসলামী শরিয়তের মধ্যে নেই। কারণ দলিলের উপর নির্ভর করেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে। তাই এক্ষেত্রে যারা গোঁড়ামি করছেন সেটা মূর্খতার কারণে হতে পারে, প্রবৃত্তির অনুসরণের কারণে অথবা বাড়াবাড়ির কারণে হতে পারে অথবা কোনো ব্যক্তিকে অধিক পরিমাণে তাকদীস বা পবিত্র বা মহান বা তাকে নির্ভুল মনে করার কারণে এ ধরনের বিভ্রাট আমাদের মধ্যে আসতে পারে। এভাবে কাউকে নির্ভুল মনে করার ইসলামে কোনো সুযোগ নেই। প্রত্যেকেরই কম বেশি ভুল হতে পারে, প্রত্যেকেরই কম বেশি জ্ঞানের অভাব থাকতে পারে অথবা প্রত্যেকেরই কম-বেশি তাহক্বীকের অবকাশ থাকতে পারে সুতরাং সেক্ষেত্রে কাউকে নিষ্কলুষ অথবা কাউকে সম্পূর্ণ অভ্রান্ত ঘোষণা করে তার সমস্ত বক্তব্যকে দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করা কোনোভাবেই জায়েয নেই। কোনো যুগে কোনো ‘আলেমও এটিকে জায়েয মনে করেন নি। তাই কোনো মাস’আলায় ‘আলেমদের বক্তব্য আসলেও আমরা সেটিকে দলীলের মাধ্যমে উপলব্ধি করার চেষ্টা করবো। দলিলের ভিত্তিতে যার বক্তব্য আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হবে আমরা তার বক্তব্য গ্রহণ করবো কিন্তু আরেকজন ‘আলেমের বক্তব্যকে আমরা কোনোভাবেই নাকচ করার চেষ্টা করবো না বা এটাকে দূর্বল করা অথবা বাতিল করার চেষ্টা করবো না। যদি সেই মাস’আলায় ইজতিহাদ বা ইখতিলাফ এর অবকাশ থাকে তাহলে আমরা মনে করবো যে উনার ইজতিহাদের কারণে উনি (‘আলেম) এই বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু কোনোভাবেই যেন কোনো ‘আলেমের সম্মানহানি না হয় সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। কারণ, ইজতিহাদের ক্ষেত্রে যতটুকু অবকাশ আছে বা যতটুকু অবকাশ ইসলাম মুজতাহিদকে দিয়েছে সেটা যদি তিনি গ্রহণ করে থাকেন তাহলে তাদের সম্মানহানি করা অথবা ইজ্জতহানি করার কাজটি কবীরা গুনাহ্ এবং ইজতিহাদের জন্য কোনো ‘আলেমকে কোনোভাবেই তিরষ্কার করা বৈধ নয়। বরং, আল্লাহর নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন যে, ইজতিহাদের ক্ষেত্রে কেউ ভুল করলেও তিনি একটি নেকী পাবেন। তাই সেটি আমাদের স্মরণ রাখতে হবে। তবে আপনার কাছে যদি কোনো ‘আলেমের ইজতিহাদ ভুল মনে হয়ে থাকে তাহলে সেটি আপনার অনুসরণ করার কোনো প্রয়োজন নেই বরং আপনার জন্য বৈধ আছে যে ইজতিহাদটি দলিলনির্ভর সেটিকে গ্রহণ করা। আপনার কাছে অন্য ‘আলেমের বক্তব্য যদি গ্রহণযোগ্য মনে হয় সেটির আপনি অনুসরণ করতে পারেন।
উপরিউক্ত ক্ষেত্রসমূহে ইখতিলাফ বা ইজতিহাদের মূল ভিত্তি হতে হবে দলিল বা দলিলের নির্দেশনা। কোনোভাবেই অন্য কোনো ভিত্তির উপর নির্ভর করে ইখতিলাফ বা ইজতিহাদ করা হলে তা ইসলামী শরিয়তে এ মর্যাদা পাবে না।
তবে ইখতিলাফের ভিত্তি যদি হয় দল, গোষ্ঠীর, ব্যক্তির তাকদীস বা ব্যক্তির পবিত্রতা বা মহত্ত্বের, কারো বিরোধিতা করা, অমুকে বলেছেন বলে আমরা তার বক্তব্য গ্রহণ করবো না ইত্যাদি ইত্যাদি তাহলে এই ইখতিলাফটুকু ইসলামী শরিয়তে মূলত গর্হিত এবং নিন্দিত হবে এবং যারা এই ধরনের ইখতিলাফ করবেন তারা গুনাহ্গার হবেন। কোনো যুগে কোনো ‘আলেম কখনো এই ধরনের ইখতিলাফ করেন নি। যুগে যুগে ‘আলেমগণ যেই ইখতিলাফ করেছেন সেই ইখতিলাফের ভিত্তি ছিল মূলত দলিল। দলিলের কারণে তারা ইখতিলাফ করেছেন অথবা দলিলের বুঝের ( দলিল থেকে তারা যা বুঝেছেন) কারণে ইখতিলাফ করেছেন। এখন আমরা দলিলের উপর ইখতিলাফ না করে অথবা দলিলের বুঝের উপর ইখতিলাফ না করে শুধুমাত্র আমাদের খায়েশ বা প্রবৃত্তির উপর ভিত্তি করে ইখতিলাফ করার যে চেষ্টাটুকু করে থাকি এটি সঠিক পন্থা বা পদ্ধতি নয় এবং হিদায়াতের পথও নয়। আল্লাহ্ তা’আলা আমাদের সবাইকে বিষয়গুলো বুঝার তৌফিক দান করুন। আমীন।