ইসলামে নারীর অধিকারও ও মর্যাদা
আস সালামু আলাইকুম
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
মূল বক্তব্যে যাবার আগে অধিকার ও মর্যাদা শব্দ দু’টিকে একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন ৷
‘অধিকার’ শব্দটিকে ইসলামী স্কলাররা সবসময় আরেকটি শব্দের সাথে সম্পৃক্ত বলে সনাক্ত করেছেন – সেটা হচ্ছে ‘দায়িত্ব’৷ ইসলামী জীবনবিধান ও worldview-তে তাই যেখানেই অধিকারের প্রশ্ন উঠেছে, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই দায়-দায়িত্বের কথাও এসেছে ! উদাহরণস্বরূপ – একজন পুরুষকে ইসলাম, তার মৃত পিতার সম্পত্তিতে, তার বোনের প্রাপ্য উত্তরাধিকারের চেয়ে দ্বিগুণ লাভ করার ‘অধিকার’ দিয়েছে – কিন্তু সেই সঙ্গে, ঐ বোন বা মা-কে আমৃত্যু দেখাশোনা করার দায়-দায়িত্বও সেই পুরুষের কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ৷ আবার দেখুন, সন্তানের উপর বাবা-মায়ের মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত অধিকার বা হক থাকে, ইসলামী বিশ্বাস মতে বাবা-মায়ের কাছে সন্তানের যে ঋণ, তা কখনোই শোধ হবার নয় – কিন্তু, আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এই অধিকার অর্জিত হয়, সন্তান প্রতিপালনের কঠোর দায়-দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে ৷ এভাবে অন্যান্য সব ব্যাপারের মতই, একজন নারীর বেলায়ও অধিকার ও দায়িত্বের এই “যুগ্ম হিসাব নিকাশ“ প্রযোজ্য ৷ সুতরাং, ইসলাম নারীকে কতটুকু অধিকার দিয়েছে, সেটা সব সময় তার উপর অর্পিত দায়-দায়িত্বের বিপরীতে ওজন করে দেখতে হবে – তা না হলে, হিসাব নিকাশে মারাত্মক ভুলের অবকাশ থেকে যাবে – যেমনটা পশ্চিমা ইসলাম বিশেষজ্ঞদের বেলায় ঘটেছে ৷ পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা তাই মৃতের পুত্র সন্তানের তুলনায়, কন্যা সন্তানের অর্ধেক উত্তরাধিকারের দোষ ধরেছেন – কিন্তু ঐ উত্তরাধিকার থেকে, কন্যা সন্তানদের একটি পয়সাও কারও জন্য খরচ করার দায়-দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভের বিরাট সুবিধাটুকু চোখে দেখেন নি ৷ আমাদের দেশের নাস্তিকতাবাদী আঁতেলরাও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে, ঐ একই দোষে দুষ্ট – তাদের একজন এ বিষয়ে বলেছিলেন যে, আল্লাহ্ নাকি অংকে কাঁচা (নাউযুবিল্লাহ্)!! এটা হয়তো তাদের জন্য স্বাভাবিকও ৷ দোষ ধরার পূর্ব-নির্ধারিত মনোভাব নিয়ে যখন কেউ কিছু পর্যবেক্ষণ করবেন, তখন বিষয়টার গুণাগুণ তার চোখ এড়িয়ে যেতেই পারে ৷
‘মর্যাদা’ শব্দটাও আপেক্ষিক – যা কিনা reference frame বা পটভূমি নির্ভর ৷ যখনি কারো মর্যাদার প্রশ্ন আসবে – তখনি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই প্রশ্ন আসবে যে, কোন reference frame-এ মর্যাদার কথা বলা হচ্ছে ৷ আমি একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করবো ইনশাল্লাহ্ ৷ উদাহরণস্বরূপ দক্ষিণ ভারতের কোন হিন্দু ধর্মাবলম্বী সোনার দোকানদারের ক্যাশ বাক্সের উপর গণেশের যে প্রতিকৃতি থাকে, সেখানে সেটার যে মর্যাদা – মসজিদুল হারাম বা মসজিদ নববীতে নিশ্চয়ই সেই প্রতিকৃতির ঐ মর্যাদা নেই ৷ আবার দেখুন, বাৎসরিক কোন ওয়াজ মহফিলে ড:আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরের যে মর্যাদা, Indian idol বা হিন্দুস্থানী মূর্তিদের উপস্থিতিতে আয়োজিত ‘ঝাঁকানাকা’ কনসার্টে, বলাই বাহুল্য যে, তাঁর সেই মর্যাদা থাকবে না! আমাদের প্রবন্ধের শিরোনামই যদিও বলে দেয় যে, মর্যাদার প্রশ্ন আসছে ইসলামের কাঠামোতে – তবু আজকের এই পৃথিবীতে মর্যাদার নতুন নতুন যে সব নিয়ামকে ও নির্ণায়কে আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি, তাতে আমরা ভুলেই যাই যে, আজকের মর্যাদার বিষয়গুলোর বেশীরভাগের সাথে, আল্লাহ্ ও আল্লাহ্র রাসূল (সা.) যে সমস্ত গুণাগুণকে মর্যাদা দিয়েছিলেন, তার কোন সম্পর্ক নেই বললেই চলে!
অধিকার ও মর্যাদা দুটো ব্যাপারের সাথেই, আবার আরেকটি বিষয় অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত – তা হচ্ছে এই যে, একটা ইসলামী জীবনব্যবস্থায়, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে নারী ও পুরুষ, কার ভূমিকা কি? এই ভূমিকা কি এক ও অভিন্ন?? অথবা আরো সাধারণ ভাবে – যে কোন সমাজব্যবস্থায়ই এই ভূমিকা কি এক হওয়ার কথা, না ভিন্ন হওয়ার কথা ৷ আপনি যদি মনে করেন যে, আল্লাহ্প্রদত্ত পৃথিবীর এই জীবনে, নারী ও পুরুষের ভূমিকা এক ও অভিন্ন – তা হলে তা মনে করার পিছনে আপনার প্রধান যুক্তি হতে হবে এরকম যে, নারী ও পুরুষ ‘মানবতার ইউনিট’ হিসেবে হুবহু এক ও অভিন্ন – যেমন একটা বিল্ডিং এর প্রতিটি ইঁটই মূলত একই এবং প্রতিস্থাপনযোগ্য! কিন্তু আসলে কি তাই?? ইসলাম তা মনে করে না এবং আপনি যদি বিস্মৃত হয়েও থাকেন, তবে শুনে নিন যে, বিজ্ঞানও তা মনে করে না! একই প্রজাতির, অর্থাৎ, মানবসম্প্রদায়ের অভিন্ন সদস্যপদের বিচারে এবং আল্লাহ্র সৃষ্টি হিসেবে তারা সমান – কিন্তু একই সময় তারা অত্যন্ত ভিন্নও বটে ৷ একটি বেলী ফুল ও একটি গোলাপ ফুলের কথাই ধরুন – ফুলের একক হিসেবে তারা সমান – অর্থাৎ, আমরা বলবো বেলী ও গোলাপ দু’টোই ফুল, কিন্তু গুণাগুণে তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন – প্রত্যেকে নিজ গুণে বিশেষ ৷ কিন্তু আমি যদি বলি যে, তারা একই ভাবে আমাদের কাছে নিজেদের প্রকাশ করে – তবে কি কথাটা ঠিক হবে? না হবে না ! বরং আমরা বলবো – বেলীফুলের গন্ধটাই তার প্রধান বৈশিষ্ট্য – বহুদূর পর্যন্ত তার গন্ধ ছড়ায়; পক্ষান্তরে গোলাপের নজরকাড়া রং বা অবয়ব আমাদের চোখে সুন্দর দেখায় ৷ দু’টো ফুলেরই নিজস্ব গুণাগুণ রয়েছে – এবং নিজ গুণে তারা বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ ৷ ঠিক সেভাবে শরীরের গঠন, কন্ঠস্বর, চোখের চাহনী, ভ্রূর বক্রতা, ত্বকের মসৃণতা বা চলার গতির মত বাহ্যিক গুণাগুণ থেকে শুরু করে, স্নেহ-মায়া, সহিষ্ণুতা, করুণা, সৌন্দর্যজ্ঞান, মেজাজ, আনন্দবোধ, মেধা ইত্যাদির মত সকল অদৃশ্য বিষয়েও – প্রতিটি তন্তুতে ও প্রতিটি কোষে নারী ও পুরুষ ভিন্ন ও স্বতন্ত্র ৷ সেজন্যই এই পৃথিবীতে, নারী ও পুরুষের বিপরীত মেরুধর্মিতা এবং সম্পূরক ও পরিপূরক গুণাগুণের সমন্বয়ে গঠিত – একটা আদর্শ ও সুখী দাম্পত্যজীবন এত সুন্দর এবং এত প্রশান্তিময় ৷ আর এই ভিন্নতা ও স্বাতন্ত্র্যের জন্যই, আল্লাহ্ তাদের পালন করবার জন্য ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা নির্ধারণ করে দিয়েছেন ৷ সেজন্য, রণকৌশলে খুবই চৌকস একজন সেনাপতি যদি মনে করেন যে, তিনি বিশাল কৃতিত্বের দাবীদার, – অথচ, তার মা যদি প্রশ্ন তোলেন যে, তাকে ঐ রকম একজন বীর হিসেবে গড়ে তোলার পিছনে তার যে ভূমিকা রয়েছে, সে জন্য তিনিও সমধিক কৃতিত্বের দাবী করতে পারেন – তাহলে আমাদের কি কিছু বলার আছে?? অথবা, ধরুন সকল বিচারে ভীষণ ভাবে সফল কোন একটা পরিবারের, প্রতিপালন ও বিকাশে ঐ পরিবারের বাবা যদি দাবী করেন যে, তিনি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, একটা সন্তোষজনক উপার্জনের ব্যবস্থা করেছিলেন বলেই না তার পরিবার এমন সফল পরিণতিতে পৌঁছালো – তাহলে ব্যাপারটা কি ঠিক হবে ? যে মা তার জীবনের প্রতিটি দিনের সময় ও সুখ ঐ পরিবারের জন্য ‘ব্যয়’ করেছেন – স্বামী ও সন্তানের জন্য একটা নিবিড় আশ্রয়স্থল হিসেবে ঘর ও সংসারকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন এবং তা আবাদ রেখেছেন – তার অবদানকে কি আমরা ছোট করে দেখতে পারি ? পরিবারের উন্নতির জন্য তিনি যে কাজ করেছেন, তার বিনিময়ে হয়তো দৃশ্যত কোন পয়সা উপার্জন হয়নি সত্যি, কিন্তু তাই বলে কি সমাজ ও জাতি গঠনে তার অবদানকে বা তার মর্যাদাকে খাটো করে দেখা যাবে ? মোটেই না ! ইসলামী ঐতিহ্যে লালিত ও পালিতরা অতি অবশ্যই স্বীকার করবেন যে, কোন পরিবারের সন্তানদের ভালো মুসলিম তথা সুসন্তান হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে একজন ভালো মায়ের অবদান অনস্বীকার্য ও তার মর্যাদা অতি অসামান্য ৷ বিশ্বাস হারিয়ে বস্তুবাদী নাস্তিকে রূপান্তরিত হওয়া পশ্চিমা সভ্যতার পন্ডিতেরা, দেরীতে হলেও, তা বুঝতে শুরু করেছেন – যেমনটা দুজন বৃটিশ বিজ্ঞানীকে বলতে দেখা যায়:
Most women do a great amount of work at home, and most men do a different sort of work in the office or on the factory floor, and in truth one sort of work is not necessarily ‘better’ than the other. One happens to be paid, but that should not confer a special sort of honour on the work involved. Prostitutes are paid, but that does not make their work better than that of mothers. ( দেখুন: page#189, Brainsex – Anne Moir & David Jessel )
এটা অনস্বীকার্য যে, কতগুলি পেশায় বা দক্ষতায় পুরুষরা নারীদের চেয়ে শ্রেয় হবে – আর কতগুলি পেশায় বা দক্ষতায় নারীরা পুরুষদের চেয়ে শ্রেয় হবে – যেমন ধরুন ভাষা বিজ্ঞানে বা মানুষের সাথে পারস্পরিক সম্পর্কের পেশাগুলোতে (প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকতা, নার্সিং বা ফ্যাশন ডিজাইনিং) স্বভাবতই মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে ভালো করে থাকে ৷ সুতরাং, সঠিক ভাবে সন্তান প্রতিপালনের পর বা ঘর-সংসার অবহেলা না করে, কারো যদি তেমন বাড়তি সময় থাকে এবং তিনি যদি কোন বিষয়ে বিশেষ দক্ষ হয়ে থাকেন – তবে তিনি সমাজের ও সম্প্রদায়ের উন্নতিকল্পে সে বিষয়ে কাজ করতেই পারেন ৷
উপরে উল্লেখিত অধিকার, দায়িত্ব , মর্যাদা ও ভূমিকার সংজ্ঞায়নের নিরিখে আমরা তাহলে এবার ব্যাপারগুলোকে আবার সুসংহত করতে চেষ্টা করি ৷ ইসলাম আল্লাহ্র সৃষ্টি হিসেবে নারী ও পুরুষকে সমান বলে মর্যাদা দিলেও, পৃথিবীর জীবনে তাদের ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা পালন করার জন্য উপযোগী করে সৃষ্টি করা হয়েছে বলে মনে করা হয় ৷ স্বীয় ভূমিকা পালনের ব্যাপারে এবং সমাজের সার্বিক কল্যাণের জন্য কোন কোন অধিকারগুলো সহায়ক হবে – সেই দিকে খেয়াল রেখে তাই অধিকারগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে । সেজন্য অংকের ভাষায়, নারী ও পুরুষকে সমান অধিকার দেয়া হয়েছে – একথা বলা অর্থহীন ৷ বরং “উভয়কে ‘প্রয়োজনীয়’ সকল অধিকার দেয়া হয়েছে“বলাটা সমীচীন ৷ তাই একজন নারীকে – তিনি কোন পুরুষকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবেন কি না, তার পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হলেও – একজন পুরুষের মত “আহ্লে কিতাবভুক্ত” জীবনসঙ্গী বেছে নেয়ার অধিকার/স্বাধীনতা দেয়া হয়নি ৷ কারণ পিতা মুসলিম না হলে, তার সন্তানকে মুসলিম রূপে বড় করাটা, তার জন্য অসম্ভব হতে পারে ৷ একইভাবে কেবল চেহারা পছন্দ নয় বলে স্বামীর কাছ থেকে বিবাহ বিচেছদ লাভ করার অনুমতি দেয়া হলেও, পুরুষকে যে ভাবে তালাকের অধিকার দেয়া হয়েছে – নারীকে সেভাবে শর্তহীন তালাকের অধিকার দেয়া হয়নি। কারণ, ইসলামী বিধানে বিয়ের সকল আর্থিক দায়-দায়িত্ব পুরুষের এবং স্বভাবজাত ভাবেই একজন নারীর পক্ষে আবেগের বশবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণের সম্ভাবনা থাকে ৷ নারীকে সম্পূর্ণ পৃথক ভাবে নিজ ব্যবসায় পরিচালনার অধিকার দেয়া হয়েছে সত্যি, তবে তা স্বামীর কোন হক নষ্ট করার বিনিময়ে নয় ৷ নারীর মসজিদে যাবার অধিকার ও খলিফাকে সরাসরি প্রশ্ন করার অধিকার আজ আমাদের কাছে অনেকটা স্বপ্নের মত মনে হয় – কিন্তু সে অধিকার এমন একটা সময়ে নিশ্চিত করা হয়েছিল যখন চতুষপদ জন্তুর মতই নারীকে একজন পুরুষের মালিকানা থেকে অন্যজনের মালিকানায় স্থানান্তরিত করা যেতো – বাবা মারা গেলে, তার অধিকারভুক্ত নারীরা উত্তরাধিকার সূত্রে ছেলের প্রাপ্য হতো ৷
ইসলামী বিশ্বে নারীকে উত্তরাধিকারের ও সম্পত্তির মালিক হবার অধিকার দেয়ার প্রায় ১৩ শতাব্দী পরে, এই সেদিন, ১৮৭০ সালে Married Women’s Property Act-এর মাধ্যমে, বৃটেন যখন প্রথম মেয়েদেরকে সম্পত্তির মালিকানার সীমিত অধিকার দান করে আইন পাশ করলো, তখন পশ্চিমা কাফির-বিশ্বের গুণিজনেরা shocked হন এবং ঘটনাটাকে বেশ ন্যাক্কারজনক বলে নাক সিঁটকান ৷ আমেরিকান মুসলিমাহ্, সদ্য প্রয়াত, আমিনাহ্ আস্ সিলমিহ্ ১৯৯২ সালে MSA আয়োজিত এক বিতর্কে বলেছিলেন (Video:Women’s Rights and Roles in Islam – Sound Vision) যে মাত্র এক বছর আগে (অর্থাৎ ১৯৯১ সালে), যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় এক মহিলা তাঁকে তার সমস্যার কথা বলতে গিয়ে বলছিলেন যে, অর্থের জন্য তার বাড়ীখানা বিক্রী করা খুবই প্রয়োজন, অথচ, তিনি তা করতে পারছিলেন না কারণ, আঞ্চলিক আইন অনুযায়ী তার পরিবারের কোন না কোন পুরুষ সদস্যের দস্তখত অপরিহার্য – কিন্তু তার পরিবারের কোন পুরুষ সদস্যই জীবিত ছিলেন না ৷ এই সেদিন পর্যন্তও বলতে গেলে পশ্চিমা জগতে মেয়েরা সম্পত্তির মালিক হতে পারতো না – নিজের নামে লিখতে বা সাহিত্য প্রকাশ করতে পারতো না – পারতো না নিজ নামে (অন্যের উপর নির্ভর না করে), কোন ব্যবসায় বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান চালাতে ৷ (আজ যারা মধ্যযুগীয় ও মৌলবাদী বলে পরিচিত, তাদের বিশ্বে গত প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে নারীরা এই সকল অধিকার ভোগ করে আসছে বলে, আমরা হয়তো মনে করি সারা বিশ্ব সব সময়ই এমনই ছিল বুঝিবা ৷ অথচ, আজকের আলোকিত ও বিশ্বাস হারানো কাফির–বিশ্বে এই সেদিনও – অন্য সব বাদ দিয়ে – পরিচিত হবার মত নারীর একটা নিজস্ব নাম পর্যন্ত ছিল না ৷ তারা হয় বাবার নাম বা স্বামীর নামের পদবীতে পরিচিত হতো ৷ )
মাতৃত্ব ও মা-কে ইসলামে যে আসন দেয়া হয়েছে, তা থেকেই বোঝা যাবে ‘মা’ রূপী নারীকে ইসলাম কোন আসনে অধিষ্ঠিত করেছে ৷ রাসূল(সা.)-এঁর ভাষ্য মতে আল্লাহ্র কাছে নারীকুলের মাঝে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও সম্মানিত ব্যক্তিত্ব হচেছন: খাদীজা(রা.), ফাতিমা(রা.), ফেরআউনের স্ত্রী আসিয়া এবং ঈসা (আ.)-এর মা মরিয়ম(আ.) – কেন?? তারা কেউ সুন্দরী শ্রেষ্ঠা বা বিজ্ঞানী ছিলেন না – অথবা, স্বনামধন্যা কবি-সাহিত্যিক বা মহাকাশযানের যাত্রীও ছিলেন না ৷ বরং সবাই তাদের নিজ নিজ জীবনে, স্ত্রী ও মা হিসেবে অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন – তাদের কোলে এমন সব সন্তান প্রতিপালিত হয়েছিলেন, যারা আল্লাহ্র কাছে বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত ৷ এ থেকে বোঝা যায় যে, একজন নারীর সংসার-ধর্ম পালনে মা হিসেবে যে ভূমিকা, ইসলামের দৃষ্টিতে তা অন্য সবকিছুর চেয়ে অধিকতর মর্যাদাপূর্ণ ৷ ইসলামী চিন্তা-চেতনা ভুলে গিয়ে, পশ্চিমের সাথে তাল মেলানোর অথবা পশ্চিমের মত হবার হাস্যকর প্রচেষ্টায় আমরা যখন ইসলামের আধুনিকতাবাদী সংস্কারকে জরুরী মনে করে এমন বক্তব্য রাখি যে, “পর্দার ভিতর থেকে একজন নারীর পাইলট হতেও বাধা নেই“, তখন আমরা ভুলে যাই যে, কিসের বিনিময়ে একজন নারী পাইলট হবেন ? তাকে যে জন্য আল্লাহ্ এমন উচ্চ মর্যাদা দান করেছিলেন যে, সন্তান যত বড় মহাপুরুষই হোক না কেন, মাতা রূপী এই নারীর পায়ের তলায়ই তার জান্নাত নিহিত বলে আমরা জানি – মা হিসেবে পালনীয় তার সেই সম্মানিত ভূমিকা, আংশিক বা সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দিয়ে তবেই নিশ্চয় তাকে পাইলট হতে হবে!! পর্দা সহকারে অথবা পর্দা বিহীন ভাবে – যেভাবেই হোক না কেন, পাইলট হবার ফলে কোন নারীর সংসার তার অনুপস্থিতির জন্য যেটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা নিশ্চয় পর্দা দিয়ে পুষিয়ে দেয়ার উপায় নেই!! এই কথাটা আমাদের অনুধাবন করতে হবে যে সমস্যাটা পর্দায় নয় – পর্দার ব্যাপারটা সব সময়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ ! কিন্তু নারী হিসেবে তার জীবনে যে ভূমিকাটা এক নম্বর priority-তে ছিল, সেই মায়ের ভূমিকাকে অবহেলা করে – যে উপার্জনের ব্যাপারে (নিতান্ত অসহায় না হলে) তার কোন দায়-দায়িত্ব নেই বললেই চলে – সেই উপার্জনকে কিছু বাড়তি ভোগ-সুখের যোগান দিতে কোন মা যখন priority-তে নিয়ে আসবেন, তখন, অঠিক কাজটি করার জন্য তিনি নিশ্চয়ই জুলুমকারী বলে প্রতিপন্ন হবেন!! মা হিসেবে অপূর্ণ এসব নারীদের সন্তানরাও অপূর্ণ হবে – দিকনির্দেশনাবিহীন ও উদ্ভ্রান্ত ভাবে ‘বিকৃত কল্পনাসৃষ্ট’ উৎসবে মেতে উঠবে পহেলা বৈশাখের রাস্তায় – অথবা – হিন্দুস্থানী মূর্তির পূজা করতে ছুটে যাবে Indian idol-এর ‘ঝাঁকানাকা’ কনসার্টে ৷ নষ্ট গাছে নষ্ট ফলই ধরবে – তাতে অবাক হবার কোন কারণ নেই ৷
সবশেষে আমরা বলবো – উত্তরাধিকারের অধিকার, সংসার জীবনে একটা একান্ত নিজস্ব পরিসরের অধিকার, ব্যবসায় করার অধিকার অথবা একেবারে উপার্জন না করে ঘরে বসে থাকার অধিকার সহ – আল্লাহ্ প্রদত্ত সকল অধিকার ও মর্যাদা আমরা যেন মেয়েদের ফিরিয়ে দিই, যাতে তারা পরিবারে নিজেদের গুরুত্বটুকু এবং সঠিক ভূমিকাটুকু অনুভব করতে পারেন ৷ কেবল ভালো মুসলিম হিসেবে ও সুসন্তান হিসেবে সন্তানদের বড় করাটাই যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানিত একটা কাজ – যা পৃথিবীর সব সম্পদ দিয়েও কেনা যায় না – এই বোধটাও যেন তাদের আমরা দিতে চেষ্টা করি ৷ আমরা যদি আদর্শ মা হিসেবে নিজ ভূমিকা পালন করতে আমাদের মায়েদের শিক্ষিত ও সক্ষম করে তুলি, তবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতার গ্লানি মোছাটা ইনশাল্লাহ্ অনেক সহজ হয়ে উঠবে ৷ সে রকম ভালো মুসলিম সন্তানের একটা প্রজন্ম যখন তারা গড়ে তুলতে পারবেন – তখন সেই প্রজন্ম জানবে যে, তাদের মায়েদের আল্লাহ্ প্রদত্ত মর্যাদা কতটুকু এবং সাধারণভাবে নারীকুলের মর্যাদাই বা কতটুকু! তাতে নিঃসন্দেহে আখেরাতের সাথে সাথে, নারীর দুনিয়ার কল্যাণও নিশ্চিত হবে ইনশা’আল্লাহ্!