আমাদের নিঃসঙ্গতা

“দিন পরে যায় দিন, বসি পথ পাশে…………”
একটা রবীন্দ্র সঙ্গীতের লিরিক। এই গানটা বা আরো অনেক গানের মূলে রয়েছে, মানুষের নিঃসঙ্গতাবোধ! সকল পরিণত মানুষের মাঝেই শেষ হয়ে যাবার বা ফুরিয়ে যাবার একটা অনুভূতি আসে। ”পরিণত” কথাটা আপেক্ষিক – তবু বলা যায় যে, মানুষ যখন থেকে তার সীমাবদ্ধতা ও insignificance বুঝতে শুরু করে, তখন থেকেই তাকে পরিণত বলা যায় [এটা যদিও ”পরিণত” বয়সের ডাক্তারী সংজ্ঞা নয়]। এ সময় থেকে মানুষ হয়তো নিঃসঙ্গ বোধ করতেও শুরু করে। এই নিঃসঙ্গতাবোধ আবার তার মাঝে একধরনের অস্থিরচিত্ততারও জন্ম দেয়। সে তখন একটা আগ্রহ থেকে আরেকটা আগ্রহে, একটা ভালো লাগা থেকে আরেকটা ভালো লাগাতে – এমন কি কখনো কখনো একটা বন্ধুত্ব থেকে আরেকটা বন্ধুত্বে switch over বা অবস্থান বদল করতে থাকে। বার বার সে ভাবে, আবারো, রবীন্দ্রনাথের কথায়: ”যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না”।

একজন [প্রয়াত] আলজেরীয় লেখকের একটা বর্ণনায় পড়েছিলাম যে, মানুষ তার নিঃসঙ্গতাবোধের বশবর্তী হয়ে, অনকেটা অর্থহীন ভাবে যখন দিগন্তের দিকে তাকায়, তখন তার নিজেকে আরো নিঃসঙ্গ এবং আরো শূন্য মনে হয়। সে ঐ শূন্য দিগন্তের দিকে একটা সময়ের বেশী আর তাকিয়ে থাকতে পারে না। নিঃসঙ্গতাবোধ বা একাকীত্ব কাটাতে সে তখন আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকায় এবং তার তথা এই মহাবিশ্বের সবকিছুর আদি-অন্তের কথা হয়তো ভাবতে শুরু করে, ভাবতে শুরু করে জীবনের উদ্দেশ্যের কথা বা আদৌ কোন উদ্দেশ্য আছে কি না সে কথা ! অথবা, অন্যথায়, দিগন্ত থেকে তার চোখ নেমে আসে পৃথিবীতে – পার্থিব জগতে। সে তখন পার্থিব ব্যাপার নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বস্তু বা জিনিস অর্জন বা উপার্জনের “মূষিক দৌড়ে” সে নিজিকে ন্যস্ত করে। ঐ লেখক বলেছিলেন যে, সাধারণত প্রাচ্যের মানুষজন দিগন্ত থেকে উপরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে ভালোবাসে, তারা ভাবতে ভালোবাসে – জীবন নিয়ে আর জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে। আর পশ্চিমের লোকজন নাকি দিগন্তের নীচে চোখ নামিয়ে আনতেই বেশী পছন্দ করে – ফলে তারা “জিনিস” সংগ্রহ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অন্তসারশূন্য শূন্যতা আর অর্থহীনতা বুকে নিয়ে তারা অর্থের পেছনে ছুটতে থাকে।

আলজেরীয় লেখকের ঐ কথাগুলো বা প্রাচ্য ও পশ্চিমের মানুষের স্বভাবের বিভাজন রেখার বিশ্লেষণ, হয়তো আজ থেকে ৪০/৫০ বছর আগে মোটামুটি ঠিকই ছিল – কিন্তু এখন তা আর প্রযোজ্য নয় বলেই মনে হয়। আধুনিকতা-উত্তর সময়ের ইন্টারনেট ভিত্তিক “উন্নত” যোগাযোগ ব্যবস্থা, “নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারে” গোটা পৃথিবীর মিলে-মিশে প্রায় একাকার হয়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে আমরা সবাই আজ শরীরী সুখ-স্বাচ্ছ্যন্দ ও সে সবের “উপকরণ” উপার্জন ও যোগাড় করতে ব্যস্ত। কিন্তু একটা সমস্যা আগের চেয়ে আরো প্রকট হয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস – তা হচ্ছে আমাদের নিঃসঙ্গতা। এটা ঠিক যে, পৃথিবীর আর সকল দেশের মতই, আমাদের দেশে বিনোদন শিল্পের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। আজ কত কয়টা টিভি চ্যানেল আপনাকে “চাঙ্গা” রাখতে রাতদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে, কত কয়টা “এফ.এম” রেডিও স্টেশন আপনার সেবায় নিয়োজিত, নতুন প্রজন্মের মোবাইল ফোনের বদৌলতে এমনকি নিম্নবিত্ত গার্মেন্টস শ্রমিকদেরও দেখা যায় পথে হাঁটার সময়টুকুও বিনোদন সেবা গ্রহণ করে চলেছেন, লিঙ্গের বিভাজন রেখা আজ প্রায় বিলীন হতে চলেছে; আর তাই যৌবনের উচ্ছলতায় শিষ্টাচারের সীমা রেখা অতিক্রান্ত হতে দেখা যায় যত্রতত্র এবং যখন তখন – তবু, এত কিছু সত্ত্বেও, সব কিছু ছাপিয়ে যেন বরফশীতল নিঃসঙ্গতায় ছেয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। আর সেই নিঃসঙ্গতার সবচেয়ে স্পষ্ট manifestation দেখা যায় ব্লগগুলোতে।

ব্লগ লেখা-লেখি আমাদের দেশের জন্য বেশ নতুন ব্যাপার। বেশ ক’বছর আগে যখন ইংরেজী/বিদেশী ব্লগের সাথে প্রথম পরিচিত হই – তখনই খেয়াল করেছি যে, পৃথিবীর প্রায় সকল “সুখ-সামগ্রী” পয়সা-দিয়ে-কিনতে-পারা মানুষগুলোও কত অসহায় রকমের নিঃসঙ্গ। আর সেই নিঃসঙ্গতা কাটাতে কি সব আবোল তাবোল লিখে চলেছে পাতার পর পাতা ভরে, ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে। আমাদের দেশেও ব্লগিং ব্যাপরটা মোটামুটিভাবে তাই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে, আসলে কি “কেবল-একদিকে-বয়ে-যাওয়া” জীবনের মহা-মূল্যবান সময়গুলো এভাবে খরচ দেয়া worth? এভাবে আসলেই কি নিঃসঙ্গতা দূর হয়?

[চলবে…….]

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *