প্রশ্নঃ মহিলা ঋতু থেকে পাক হয়েছে কিন্তু গোসল করেন নাই তার আগেই স্ত্রী মিলন হয়েছে এতে কি গুনাহ হবে?

উত্তর  দিয়েছেন ডঃ মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ

উত্তরঃ ধন্যবাদ আপনাকে, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছেন। প্রথম কথা হচ্ছে আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন সূরা আল বাকারার ২২২ নম্বর আয়াতের মধ্যে হায়েজ বা ঋতুবর্তী নারীর বিধান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الْمَحِيضِ قُلْ هُوَ أَذًى فَاعْتَزِلُوا النِّسَاءَ فِي الْمَحِيضِ وَلَا تَقْرَبُوهُنَّ حَتَّىٰ يَطْهُرْنَ فَإِذَا تَطَهَّرْنَ فَأْتُوهُنَّ مِنْ حَيْثُ أَمَرَكُمُ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ

“আর তারা তোমাকে প্রশ্ন করে হায়েয বা ঋতু সম্পর্কে। বল তা অপবিত্র। সুতরাং, তোমরা হায়েযকালে স্ত্রীদের থেকে দূরে থাক এবং তারা পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তাদের নিকটবর্তী হয়ো না। অতঃপর যখন তারা পবিত্র হবে তখন তাদের নিকট আস, যেভাবে আল্লাহ্ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। নিশ্চয় আল্লাহ তাওবাকারীদেরকে ভালোবাসেন এবং ভালোবাসেন অধিক পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে।”

ঋতুবর্তী মহিলাদের কয়েকটি অবস্থা হতে পারে। যেমন,

১ম অবস্থাঃ হায়েজ অবস্থায় অথবা রক্তস্রাব আছে এমন অবস্থায় তাদের সাথে সহবাস করা সম্পূর্ণরূপে হারাম। আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা স্পষ্টকরে নিষেধ করেছেন যে, “হায়েজ অবস্থায় তোমরা নারীদের থেকে নিজেদেরকে বিরত বা দূরে রাখো।” অর্থাৎ প্রথম নির্দেশ হচ্ছে দূরে থাকা।

২য় অবস্থাঃ রক্তস্রাব বন্ধ হয়েছে কিনা এ বিষয়ে যদি কোনো সন্দেহ থাকে তাহলে এ অবস্থায়ও সমস্ত ‘উলামায়ে কিরামের ঐক্যমতে স্ত্রী সহবাস করা সম্পূর্ণরূপে হারাম। কারণ, এ ধরনের সন্দেহের ক্ষেত্রে ইয়াকীন বা দৃঢ়প্রত্যয় ধরে নিতে হবে অবশ্যই রক্তস্রাব রয়ে গিয়েছে এবং পরিপূর্ণরুপে ত্বহারাত হাসিল হয়নি। তাই এটাকে ইয়াকীন ধরে স্ত্রীসহবাস থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে।

৩য় অবস্থাঃ রক্তস্রাব বন্ধ হয়ে গিয়েছে এটি কনফার্ম কিন্তু তিনি এখনো ত্বহারাত বা পবিত্রতা অর্জন করেননি অর্থাৎ গোসল করেননি এ অবস্থায় স্ত্রীসহবাস বৈধ কিনা এ মাস’আলায় ‘আলেমদের মধ্যে মতপার্থক্য বা মতভেদ রয়েছে। সূরা আল বাকারার ২২২ নং আয়াতে আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তিনটি নির্দেশ দিয়েছেনঃ

১. হায়েজ অবস্থায় মহিলাদের থেকে তোমরা নিজেদেরকে দূরে রাখো অর্থাৎ কোনোভাবেই তোমরা স্ত্রীমিলন করবে না।

২. তোমরা তাদের নিকটবর্তী হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা পবিত্র হবে। এটি আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার নিষেধাজ্ঞারর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।

৩. যদি তারা পরিপূর্ণরুপে পবিত্রতা অর্জন করে অর্থাৎ গোসল করে তাহলে তোমরা তাদের কাছে আসো যেভাবে তোমাদেরকে আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা নির্দেশনা দিয়েছেন সেভাবে।

এই আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে যে আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এখানে আমাদেরকে তিনটি নির্দেশনা দিয়েছেন। এ আয়াতের তাফসীরের মধ্যে আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদি’আল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, “যদি তারা গোসল করে তাহলেই মূলত তাদের সাথে স্ত্রীমিলনের কথা বলা হয়েছে।” আব্দুল্লাহ্ ইবনে ‘আব্বাসের এই রেওয়ায়ত থেকে ‘উলামায়ে কিরাম বলেছেন যে দুটি শর্তে মূলত আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা স্ত্রীর সাথে মিলনের অনুমোদন দিয়েছেনঃ

১. রক্তস্রাব বন্ধ হতে হবে ও
২. গোসল করতে হবে।

সুতরাং এদুইটি শর্তের মধ্যে যেকোনো একটি শর্তও যদি পূরণ না হয় তাহলে স্ত্রীর সাথে সহবাস করা হারাম। এ বিষয়ে ইবনে কুদামা আল মাক্বদেসী (রহ.) মুগনিতে উল্লেখ করেন যে আবুল কাসেম খিরাকী (রহ.) তার মুখতাসারের মধ্যে উল্লেখ করেছেন, “যদি তার রক্তস্রাব বন্ধ হয়ে যায় তারপরেও তার সাথে সহবাস জায়েয নেই যতক্ষণ পর্যন্ত সে গোসল না করবে।” এ বক্ত্যটুকু ইবনে কুদামা মাক্বদেসী (রহ.) বলেন ইবনুল মুঞ্জির (রহ.) এ বক্তব্যের উপর ইজমা নকল করেছেন। আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ আল মাররুযি (রহ.) বলেন, “এই মাস’আলার মধ্যে ইতিপূর্বে কোনোধরনের ইখতিলাফ ছিল এটা আমার জানা নেই।” এখান থেকে বুঝা যাচ্ছে মূলত অধিকাংশ ‘উলামায়ে কিরামের বক্তব্য হচ্ছে এ অবস্থায় রক্তস্রাব বন্ধ হয়ে গেলেও গোসল না করা পর্যন্ত তার স্ত্রী মিলন করার কাজটি বৈধ হবে না বরং হারাম হবে।

অপরদিকে আমরা দেখি আরেকদল ‘উলামায়ে কিরাম যাদের মধ্যে অন্যতম ইমাম আবু হানিফা (রহ.) রয়েছেন, তারা বলেছেন, যদি রক্তস্রাব বন্ধ হয়ে যায় আর এটি যদি কনফার্ম হয় এবং এ ব্যাপারে যদি কোনো সন্দেহ না থাকে তাহলে আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা যে নির্দেশ দিয়েছেন সেটি এখানে কার্যকরী হতে পারে। যেহেতু সূরা আল বাকারার ২২২ নম্বর আয়াতের মধ্যে ২য় যে নির্দেশনা আল্লাহ্‌ দিয়েছেন যে তারা ত্বহারাত হাসিল করা পর্যন্ত তোমরা তাদের নিকটবর্তী হবেনা এটার অর্থ হচ্ছে তাদের রক্তস্রাব বন্ধ হয়ে গিয়েছে এটা কনফার্ম হলেই তোমরা তাদের নিকটবর্তী হতে পারবে। এখানে ইঙ্গিত করা হচ্ছে, রক্তস্রাব বন্ধ হলে নিকটবর্তী হওয়াটা বৈধ হওয়ার দিকে। তবে আল্লাহ্‌ তা’আলার নির্দেশনা হচ্ছে তারা পরিপূর্ণ গোসল করলে এবং পবিত্রতা অর্জন করলে তোমরা তাদের সাথে অবাধে আসতে পারবে এবং তাদের সাথে মিলন বৈধ হয়ে যাবে। এটি আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশনা কিন্তু এখানে প্রতিবন্ধকতাটুকু হচ্ছে রক্ত বন্ধ না হওয়া। রক্ত বন্ধ হয়ে গেলেই তাদের সাথে স্ত্রীসহবাস জায়েয এ বক্তব্যটুকুও একদল ‘উলামায়ে কিরাম দিয়েছেন। এক্ষেত্রে কেউ কেউ মনে করেন যে, রক্ত বন্ধ হয়ে গেলে এবং এটি পরিপূর্ণ নিশ্চিত হলে স্ত্রীমিলন জায়েয আছে। তবে উত্তম হচ্ছে গোসল করে নেয়া। এটি অধিকাংশ ‘উলামায়ে কিরামের নিকট উত্তম।

তবে অধিকাংশ ‘উলামায়ে কিরাম বলেছেন যে, গোসলের পূর্বে স্ত্রীমিলন করার কাজটি হারাম। এক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করাই উত্তম। যদিও কুরআনে কারীমের সরাসরি নির্দেশনা থেকে এটা বুঝা যায়, যদি রক্তস্রাব বন্ধ হয়ে যায় তাহলে তাদের সাথে মিলনের বিধান বৈধ হতে পারে। কিন্তু পূর্বের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি যে সালাফে সালেহীন গোসল করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন এবং গোসল না করে মিলনের ব্যাপারটি সালাফে সালেহীন অনুমতি দেননি। এটাই অত্যন্ত যুক্তিসংগত। কারণ, যদিও রক্তস্রাব বন্ধ হয়ে যায় কিন্তু তারপরও সম্ভাবনা থেকে যায় যেকোনো ধরনের অপবিত্রতা থেকে যাওয়ার যেহেতু আসলে অপবিত্রতার বিষয়টি আপেক্ষিক তাই অপবিত্রতা থেকে যেতে পারে। ফলে আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন,

يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْمَحِيضِ قُلْ هُوَ أَذًى

“হে নবী লোকেরা আপনাকে প্রশ্ন করবে হায়েজ বা রক্তস্রাব সম্পর্কে আপনি বলুন এটি হচ্ছে অপবিত্র।” সুতরাং এক্ষেত্রে অপবিত্রতা রয়ে গেলে স্বামী এবং স্ত্রী উভয়েরই ক্ষতির আশংকা রয়েছে। তাই রক্তস্রাব বন্ধ হয়ে গেলে এবং গোসল করে পবিত্রতা অর্জন হাসিল করেই স্ত্রীমিলন বৈধ হওয়ার বিধানটি অত্যন্ত সঙ্গত ও যৌক্তিক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *